কর্নেল বুঝলেন, তার চেহারা দেখে হেকিম খাঁটি ইউরোপবাসী বলে ভুল করেছে। এটা স্বাভাবিক। এ ভুল তাকে দেখে সবাই করে। যাই হোক, এ সুযোগে তিনি ইউরোপীয় হয়ে গেলেই মঙ্গল। বললেন—জি হাঁ হেকিমসায়েব। আমি বাংলা মুল্লুকে অনেক বছর আছি কিনা। তবে উর্দুও বলতে পারি।
এরপর দুর্জন উর্দুভাষায় কথা বলতে বলতে নদীতে নামলেন। সে-সব কথাবার্তা হল এই :
আমি যে হেকিম, তা কীভাবে বুঝলেন?
কেন? আপনার হাতে গাছের শেকড় আর ওই খুরপি।
ঠিক, ঠিক।
তাছাড়া এখানে এসে আপনার কত নাম শুনেছি। আপনার দাওয়াই খেলে মড়াও নাকি উঠে বসে।
তা মা বাবা আর খোদার দয়ায় ওকাজটা আমি ভালোই পারি।
দেখুন হেকিমসায়েব, আমার কোমরে প্রায়ই খুব ব্যথা হয়। দাওয়াই দেবেন?
নিশ্চয় দেব। ওই তো আমার কাজ। তবে আমার দাওয়া-খানায় যেতে হবে।
তাই যাব। তবে দয়া করে আসুন, ওই বাংলোয় আমি যাচ্ছি। একটু চা খেয়ে যাবেন।
বেশ তো চলুন।
নদী পেরিয়ে দুজনে বাংলোয় পৌঁছলেন। কর্নেল চৌকিদারকে চায়ের আদেশ দিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে মুখোমুখি বসলেন।
ফকির বলেছিল, হেকিম লতিফ খাঁ বদমেজাজি লোক। কিন্তু তাকে মোটেও তেমন মনে হল না কর্নেলের। লোকটি যে ভদ্রবংশীয় ত তার আদবকায়দা আর কথার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে।
কথায়-কথায় কর্নেল একসময় বলল—আচ্ছা হেকিমসায়েব, শুনেছি এখানে নাকি এক মস্তো জায়গিরদার ছিলেন। আপনি তারই বংশধর?
লতিফ খাঁ মাথা উঁচু করে বলল—আপনি ঠিকই শুনেছেন।
আচ্ছা খা-সাহেব, ইতিহাসের কেতাবে পড়েছিলাম এখানে আপনার পূর্বপুরুষদের আমলে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ মমি করা হত। তা কি সত্যি?
হেকিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—কিছুটা সত্যি। আপনি বিদেশি। আজ আছেন, কাল নেই। তাই সে গোপন কাহিনি আপনাকে বলছি।
বলে হেকিম লতিফ খাঁ এই কাহিনি শোনাল :
আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা। জায়গিরদার মুইনুদ্দিন শাহ তাল-তমাসের মনে সুখ ছিল না। কারণ তার কোনও পুত্রসন্তান নেই। তাই তিনি আরব ও পারস্যের নানা মুসলিম তীর্থে ফকির ও অলৌকিক শক্তিধর সাধকের কাছে পুত্র কামনায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে খোঁজ পেলেন, মিশরদেশের এক সাধক আজম শাহের কাছে গেলে তার মনস্কামনা পূর্ণ হতে পারে।
মুইনুদ্দিন তখনই মিশরে গিয়ে সেই সাধকের শরণাপন্ন হলেন। অনেক কাকুতি-মিনতির পর আজম শাহ বললেন—ঠিক আছে। আজ রাতদুপুরে তুমি আমার আস্তানায় একা এসো। তোমাকে আমি একটা অত্যাশ্চর্য জিনিস দেব। সেটা নিয়ে গিয়ে তুমি ও তোমার স্ত্রী ধুয়ে জল খাবে। তাহলে তোমাদের পুত্রলাভ হবে। কিন্তু সাবধান, এই জিনিসটি অপার্থিব একটি রত্নবিশেষ। একটি কৃষ্ণবর্ণ ধাতুনির্মিত ছোট পেটিকার মধ্যে এটা রেখে দেবে। আর দেখ মানুষ মরণশীল প্রাণী। তোমার পুত্রও একদিন মারা যাবে। তার যখনই মৃত্যু হোক, তার কবরের মধ্যে ওই রত্নসমন্বিত পেটিকাটিও অবশ্য সমাহিত করতে হবে। নতুবা সাংঘাতিক বিপদ ঘটবে।
মুইনুদ্দিন সেই অত্যাশ্চর্য কৃষ্ণবর্ণ রত্নপেটিকা নিয়ে দেশে ফিরলেন। সাধক তাকে পেটিকার চাবি দিয়েছিলেন। চাবির সাহায্যে পেটিকা খুলে রত্নটি বের করে ধুয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে সেই জল পান করলেন।
পরবৎসর তাঁর পুত্রলাভ হল। সাধকের নাম অনুসারে তার নাম রাখলেন আজিমুদ্দিন।
কিন্তু দুঃখের কথা, বারো বছর বয়সে সেই সুন্দর ছেলেটি এক অজ্ঞাত ব্যাধিতে মারা পড়ল। শোকে ভেঙে পড়লেন মুইনুদ্দিন।
তিনি মিশরে গিয়ে ওইসময় একজন কারিগরের খোঁজ পেয়েছিলেন—যে মৃতদেহ মমি করতে জানত। তাকে তিনি খেয়ালবশে সঙ্গে করে এনেছিলেন।
আজিমুদ্দিনের মৃতদেহ মমি করার ইচ্ছা হল হতভাগ্য পিতার। মিশরবাসী সেই লোকটি তার আদেশ পালন করল। কিন্তু সাধক আজমশাহের নির্দেশে সেই রত্নপেটিকা কবরে রাখতে হবে। সাধারণ কবরে রাখলে তা চুরি যাবার আশঙ্কা ছিল! কারণ এই আজব পেটিকা ও রত্নের কথা ততদিনে রটে গিয়েছিল।
তাই ভূগর্ভে গোপন কবর দেওয়া হল আজিমুদ্দিনকে। রত্নপেটিকাটিও তার কবরের মধ্যে রাখা হল।….
হেকিম লতিফ খাঁ চুপ করলে কর্নেল বললেন–তারপর?
আর কী?
সেই গুপ্ত কবরের সন্ধান। নিশ্চয় আপনি রাখেন?
মুহূর্তে হেকিমের মেজাজ বদলে গেল। বিকৃতমুখে বললেন—না। আপনাকে যে কাহিনি বললুম, তা আমার বাবার কাছে শোনা। কিন্তু এই গাঁজাখুরি গল্পে আমার একটুও বিশ্বাস নেই।
চৌকিদার ইতিমধ্যে চা এনে দিয়েছিল। হেকিম চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তেমনি বিকৃতমুখে হেসে ফের বলল—দয়া করে এ সম্পর্কে আমায় আর কোনও প্রশ্ন করবেন না সায়েব! যদি কোমরের বেমারির দাওয়াই চান, আমার সঙ্গে আসতে পারেন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন—এক ভদ্রলোক দেখা করতে আসবেন। তাই এখন যাওয়ার অসুবিধা আছে। সন্ধ্যায় যাবখন।
আচ্ছা আদাব। বলে হেকিম লতিফ খা বেরিয়ে গেল।
কর্নেল অবাক হয়ে বসে রইলেন। মমি করার ব্যাপারটা হেকিম কিছুটা সত্যি বলে স্বীকার করল। কিন্তু বাকিটা গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিল কেন?
অথচ আজিমুদ্দিনের কবরে সত্যি একটা অদ্ভুত ধাতুতে তৈরি কালো পেটিকা পাওয়া গেছে। এবং সেটা কর্নেল স্বচক্ষে দেখেছেন। কর্নেল আগাগোড়া ব্যাপারটা ভাবতে থাকলেন। ঘণ্টা দুই পরে ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে বললেন—হ্যালো। কর্নেল বলছি।
কর্নেল, আমি অজিতেশ।
কী খবর ডার্লিং?
খবর সাংঘাতিক! একটু আগে তোপখানার কাছে পোড়ো একটা বাড়িতে একটা লাশ পাওয়া গেছে। টাটকা খুন। তাকে ছোরা মেরে পালিয়েছে কেউ। নিহত লোকটা…