এই মোক্ষম সুযোগ। ন্যাড়ার দু হাত খোলা। শুধু পা দুটো তখনও বাঁধা। ডালকুত্তাটা চামচিকের দিকে ঝাঁপ দেওয়া মাত্র সে কম্বলটা তার ওপর ফেলে দিল। কম্বলে জড়িয়ে-মড়িয়ে ডালকুত্তার তখন ভীষণ রাগ হয়েছে। সে গরগর গোঁ গোঁ গর্জন করতে করতে যত লাফালাফি করে কম্বল তত জড়িয়ে যায়।
সেই সুযোগে ন্যাড়া ঝটপট দু পায়ের বাঁধন কেটে ফেলেছে। তারপর এক লাফে খাট থেকে নেমে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে।
বেচারা ডালকুত্তা তখন কম্বল জড়ানো অবস্থায় গড়াতে গড়াতে কেন কে জানে—হয়তো জীবনে এমন বিদঘুটে ব্যাপার কখনও ঘটেনি তার; সেই আতঙ্কে খাটের তলায় ঢুকে পড়ল।
ন্যাড়া এতক্ষণে নিশ্চিন্তে ঘরের ভেতরটা দেখতে থাকল।
ঘরটায় আলো খুব কম। ঘুলঘুলি থেকে একটুখানি রোদের ছটা এসে ঢুকেছে মাত্র। সে একটা জানলা খুলে দিল। একতলাতেই রয়েছে। জানালার ওপাশে জঙ্গুলে জায়গা। তার ওদিকে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। ডাইনে-বাঁয়ে একটু তফাতে কলকারখানা রয়েছে।
এদিকে ঘরের ভেতরে কতকালের পুরোনো আসবাবপত্র আর ছেড়া তোষক, নারকেল ছোবড়ার গদি আর একদঙ্গল বালিশ পড়ে রয়েছে! মনে হল, এটা কোনও পোড়ো বাগানবাড়ির পেছনের দিক।
ন্যাড়া দরজা টেনে দেখল বাইরে থেকে আটকানো আছে। অমনি সে নিরাশ হয়ে গেল। জানালার রড খুব পুরু আর শক্ত। সে বেরুবে কেমন করে?
সে ভাবতে থাকল। একটু পরে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। কোনা থেকে কয়েকটা ছেড়া বালিশ এনে সে বিছানায় লম্বালম্বি রাখল। এখন একটা কম্বল দরকার। ডালকুত্তাটা কম্বল মুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে রয়েছে এবং মাঝে মাঝে অদ্ভুত চাপা শব্দ করছে! অন্যসময় হলে ন্যাড়া হেসে কুটিকুটি হত।
কোনা খুঁজতে গিয়ে ন্যাড়া একটা ছেড়া তুলো বেরকরা লেপ পেয়ে গেল। সে সেটা এনে বালিশের ওপর ঢাকা দিল। দেখলে মনে হবে, শ্রীমান ন্যাড়াই যেন আগের মতো শুয়ে আছে। মাথাঅবদি ঢেকে রেখেছে। জানালা বন্ধ করেছে বলে হঠাৎ বাইরে থেকে ঢুকে ওরা ব্যাপারটা টের পাবে না সম্ভবত। অন্তত টের পেতে একটু দেরি তো হবেই। ততক্ষণে ন্যাড়া …
হ্যাঁ, এবার তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে।
কোনার দিকে তোশক আর গদির আড়ালে ন্যাড়া গিয়ে লুকিয়ে বসে রইল।
তারপরে বসে আছে তো আছেই। কেউ আসে না। না কমলাক্ষ, না মাধব—কিংবা ওদের সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা—যে ন্যাড়াকে খাবার দিতে আসে।
ভালকুত্তাটা কি আরামে ঘুমোচ্ছে এবার?
ঠিক তাই। কম্বলের মজাটা টের পেয়ে গেছে সে। তাই আর সাড়াশব্দ নেই।
কতক্ষণ কেটে গেল তারপর তালা খোলার শব্দ হল। ন্যাড়া সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হল।
দরজা খুলে সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা ঢুকল। তার হাতে যথারীতি একটা থালা। তাতে ভাত-তরকারি রয়েছে। ন্যাড়াকে খাওয়াতে এসেছে।
সে খাটের কাছে এসে ডাকল—কই খোকাবাবু, ওঠ। খেয়ে নাও।
অমনি ন্যাড়া ঠিক খরগোশের মতো একলাফে উঠেই দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেল। লোকটার হাত থেকে ভাতের থালা পড়ে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল চাপা গলায়—পালাচ্ছে! পালাচ্ছে! ধর, ধর!
ন্যাড়া পাশের ঘর থেকে ততক্ষণে বারান্দায়, বারান্দা থেকে একটা উঠোনে—তারপর উঠোনের ওপাশে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ছোট্ট একটা গলিতে পৌঁছে গেছে।
সেখান থেকে সে সোজা দৌড় লাগাল। তারপর একেবারে গঙ্গার ধারে গিয়ে পড়ল। ঘন আগাছার জঙ্গল ওখানটা। তার নিচে অথৈ জল। ন্যাড়া বুঝতে পারল না, কোনদিকে যাবে।
জঙ্গলটার শেষে একটা কারখানার পাঁচিল দেখা যাচ্ছিল। সে মরিয়া হয়ে সেদিকেই দৌড়ুল। এইসময় তার কানে এল, পেছনে কোথাও গরগর গর্জন করছে বুঝি সেই হিংস্র ডালকুত্তাটাই।
সে ঝোপের আড়ালে উঁকি মেরে যা দেখল, তাতে তার আতঙ্ক বেড়ে গেল। সেই কুৎসিত চেহারার লোকটা ডালকুত্তাটা নিয়ে জঙ্গলে তাকে ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে।
ন্যাড়া কারখানার পাঁচিলের কাছে এসে বাঁদিকে তাকাল। একটা বটগাছের তলায় নৌকা বাঁধা রয়েছে।
সে দৌড়ে গিয়ে নৌকোয় উঠল। দুজন লোক বুড়ো জেলে ও তার ছেলে সব খাওয়াদাওয়া সেরে বিড়ি টানছিল। অবাক হয়ে ন্যাড়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
ন্যাড়া ব্যাকুলভাবে বলল—আমাকে বাঁচাও। ডালকুত্তা নিয়ে ওরা আমাকে ধরতে আসছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে!
বুড়ো জেলে তীরের আগাছার জঙ্গলটা দেখে নিয়ে ব্যস্তভাবে বলল—খোকাবাবু, তুমি ছইয়ের ভেতর লুকিয়ে পড়ো। আমি দেখছি।
ন্যাড়া ছইয়ের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে রইল।
একটু পরে তীরের দিকে আওয়াজ এল—ও বুড়ো! এদিকে একটা ছেলেকে দেখেছ?
বুড়ো মাথা নেড়ে বলল—না কর্তা! দেখিনি তো! তারপর সে তার ছেলেকে ইশারা করল নৌকোর কাছি খুলতে।
নৌকোটা মাঝগাঙের দিকে এগিয়ে চলল। বুড়োর ছেলেটা একটু হেসে ন্যাড়াকে জিগ্যেস করল—কী হয়েছে বলো তো খোকাবাবু?
ন্যাড়া বলল-বলব। আগে আমাকে দূরে কোনও ঘাটে পৌঁছে দাও।
বুড়ো জেলে হাল ধরে বসেছিল। বলল—বুঝেছি। ছেলেধরার পাল্লায় পড়েছিলে। আজকাল ছেলেধরার উৎপাত হয়েছে।
ন্যাড়া ছইয়ের ভেতর নিরাপদে বসে দেখতে পাচ্ছিল, কমলাক্ষর লোকটা তখনও আগাছার জঙ্গল ছুঁড়ে হন্যে হচ্ছে।…
০৯. ফকিরের পুনরাবির্ভাব
লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় তখন কর্নেল, শংকর, অজিতেশ গম্ভীর মুখে আলোচনা করছিলেন। ন্যাড়াকে বাঁচাতে হলে আজই রাতে বি. টি. রোডের ধারে খ্রিস্টান কবরখানার কাছে কালো বাকসোটা রেখে আসতে হবে। একটু আগে শংকরের কাছে কলকাতা থেকে হারাধন ট্রাঙ্কক করেছে। শংকর তাকে জানিয়েছিলেন, কোনও নতুন ঘটনা ঘটলে যেন তক্ষুনি লিটনগঞ্জের ডাকবাংলোয় ফোন করে। হারাধন জানিয়েছে, কিছুক্ষণ আগে একটা উড়ো চিঠি কেউ গেটের লেটারবক্সে রেখে গেছে। চিঠিটা শ্ৰীমান ন্যাড়াই লিখেছে।