অজিতেশ বললেন—তা আর বলতে। তবে আমারই ভুল। ভেবেছিলুম, কাল সকাল থেকে পাহারার ব্যবস্থা করব। বুঝতে পারিনি, আজ রাতেই কেউ কবরে হামলা করবে।
গুপ্ত কবর আগের মতো ঢেকে দেওয়ার একটু পরে সেপাইরা ফিরে এসে জানাল—ওদের পাকড়াও করা যায়নি। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন।…
০৮. ন্যাড়ার কারসাজি
নেহাত খিদে সইতে পারে না বলে ন্যাড়া ওদের দেওয়া খাবার খেয়েছে। খাবার সময় অবশ্য হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছিল মাধব। তবে খুনে ডালকুত্তাটা সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে রয়েছে। কুতকুতে চোখে ন্যাড়াকে দেখছে তো দেখছেই।
এভাবে একটা দিন একটা রাত কেটে গেল। পরদিন সকালে কমলাক্ষ ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বললেন—বাবা নেড়ু, আজ সন্ধ্যার মধ্যেই তুমি ছাড়া পাবে। তবে সেটা নির্ভর করছে তোমার ছোটমামার ওপর। সে যদি জায়গামতো বাকসোটা রেখে যায়, তবেই। নৈলে ….
ন্যাড়া ভয়েভয়ে জিগ্যেস করল–নৈলে কী হবে?
কমলাক্ষ তার প্যান্টের পকেট থেকে সেই ছুরিটা বের করে বললেন—স্রেফ জবাই হয়ে। যাবে। বুঝলে তো?
ন্যাড়া আঁতকে উঠে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল-কেন কমলকাকু? আমার কী দোষ?
কমলাক্ষ নিষ্ঠুর হেসে বলল—তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া। তুমি না বললে তো শংকর ব্যাটা বাকসোর হদিশ পেত না।
ন্যাড়া মনে-মনে বুদ্ধি এঁটে বলল—আচ্ছা কমলকাকু, আমি যদি নিজের হাতে ছোটমামাকে চিঠি লিখে দিই যে বাকসোটা ফেরত দাও, নৈলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে?
কমলাক্ষ খুশি হয়ে বলল-খুব ভালো কথা। এই তো চাই।
বলে সে একটুকরো কাগজ আর ডটপেন এনে দিল। ন্যাড়ার হাতের বাঁধনও খুলে দিয়ে বলল, ঝটপট লিখে ফেল দিকি তাহলে!
এই সময় মাধব ঘরে ঢুকে ব্যস্তভাবে বলল—সর্বনাশ হয়েছে কমলদা! কমলাক্ষ চমকে উঠে বলল-কী? কী হয়েছে মাধব?
এইমাত্র লিটনগঞ্জ থেকে আমার লোক ট্রাঙ্ককল করে খবর দিল। মাধব ব্যস্তভাবে বলতে থাকল। বটতলার কবরে কড়া পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। আর তার চেয়েও সাংঘাতিক কথা, আজিমুদ্দিনের মমিকরা মড়ার মুণ্ডুটা নাকি কে কেটে নিয়ে গেছে। আমার লোকেরা কবর খুঁড়ে সেটা আবিষ্কার করেছে, হঠাৎ পুলিশ হাজির।
কমলাক্ষ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলল—বলো কী মাধব! এই তো সেদিনই কফিন খুলে দেখলুম, মুণ্ডু রয়েছে। হঠাৎ মুণ্ডুটা কাটল কে? কেনই বা কেটে নিয়ে গেল?
মাধব চাপা গলায় বলল— এ নিশ্চয় ব্যাটা হাসান ফকিরের কীর্তি। শেষবার ব্যাটা বলেছিল না? কালো বাকসোর চাবি মমিকরা লাশের মধ্যেই কোথাও আছে!
হ্যাঁ। বলেছিল বটে। কিন্তু আমরা তো হাতড়ে দেখেছিলুম। পাইনি!
এখন মনে হচ্ছে চাবিটা মুণ্ডুর মধ্যেই ছিল।
হুম! কিন্তু কে তাহলে মুণ্ডু কেটে নিয়ে গেল?
মাধব একটু ভেবে বলল— সেটা জানতে হলে ব্যাটা হাসান ফকিরকে ধরে আনা দরকার। ওর পাগলামির নিকুচি করেছে। আমি এখনই আমার লোককে ট্রাঙ্ককল করে হুকুম দিচ্ছি, ফকিরকে যেভাবে হোক এখানে নিয়ে আসতে হবে।
চিন্তিতমুখে কমলাক্ষ বললেন—যা করার শিগগির করো!
মাধব বেরিয়ে গেল। তখন ন্যাড়া বলল—তাহলে চিঠি লিখি কমলকাকু?
হ্যাঁ, লেখো। বলে কমলাক্ষ কাগজ-কলম এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন-যা বলি, লেখো।
ন্যাড়া গোটাগোটা হরফে লিখতে থাকল :
ছোটমামা, আজ রাত বারোটায় গঙ্গার ধারে খ্রিস্টান কবরখানায় অর্জুন গাছের তলায় কালো বাকসোটা রেখে যাবে। তাহলে আধঘণ্টা পরে এরা আমাকে তোমার বাড়ির গেটে পৌঁছে দেবে। যদি একথা না শোনো, তাহলে এরা আমার মুণ্ডু কেটে ফেলবে। ইতি ন্যাড়া।
চিঠিটা কমলাক্ষ কয়েকবার পড়ার পর ভঁজ করে পকেটে পুরলেন। তারপর আগের মতো ন্যাড়ার হাত দুটো খাটের দুপাশে পায়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে বেরিয়ে গেলেন। ভয়ংকর ডালকুত্তাটা পাহারায় রইল।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ন্যাড়ার চোখে পড়ল খাটে তার মাথার পাশে বালিশের একধারে যেখানে কমলাক্ষ বসেছিলেন, সেখানে কমলাক্ষের সেই ছুরিটা পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ন্যাড়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কমলাক্ষ তখন ন্যাড়াকে ভয় দেখাতে ছুরিটা বের করেছিলেন। কিন্তু ন্যাড়া নিজের হাতে শংকরবাবুকে চিঠি লিখতে চাইলে খুশির চোটে ছুরিটা পকেটে না ঢুকিয়ে ওখানেই রেখে কাগজ কলম আনতে গিয়েছিলেন টেবিলে। তারপর ভুলেই গেছেন ছুরিটার কথা।
ন্যাড়া ছুরিটার দিকে তাকিয়ে ফন্দি আঁটতে থাকল।
ভয় শুধু ডালকুত্তাটাকে। নড়লেই সে নাকি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর।
শীত বলে দয়া করে ওরা ন্যাড়াকে একটা কম্বল দিয়ে গেছে। ন্যাড়া ভাবল, কম্বলটা হয়তো কাজে লাগানো যায়। সে খুব আস্তে কাত হয়ে শোবার ভান করল। ওইটুকু নড়াচড়াতেই ডালকুত্তাটা গরগর করে উঠল। কিন্তু সে ন্যাড়ার পায়ের কাছে খাটের পায়ার সঙ্গে শেকলে বাঁধা রয়েছে। চেনটা অবশ্য যথেষ্ট লম্বা। ন্যাড়া কম্বলমুড়ি দিল এবার। কিন্তু এতে ডালকুত্তাটা আপত্তি করল না।
এবার সে কম্বলের খানিকটা অংশ কৌশলে বালিশের পাশে রাখা ছুরির ওপর চাপাল। তারপর মুখটা বাড়িয়ে কম্বলের ভেতর ছুরির বাঁটটা কামড়ে ধরল। এখন আর অসুবিধে হল না। ছুরিটা খুব ধারালো। দাঁতে বাঁট কামড়ে ডান হাতের দড়ির বাঁধনে ফলাটা সাবধানে কয়েকবার ঘষতেই বাঁধন কেটে গেল।
ডালকুত্তাটা মাঝে মাঝে গরগর করছে বটে, তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতলব নেই বলেই মনে হচ্ছে।
বাঁ হাতের বাঁধন কাটতে দেরি হল না ন্যাড়ার। এবার সে কম্বলের ফাঁক দিয়ে ডালকুত্তাটার দিকে তাকাল। ডালকুত্তাটা তার দিকে তাকিয়েছিল। এই সময় হঠাৎ ঘুলঘুলি থেকে একটা চামচিকে উড়ে এসে ডালকুত্তাটার কাছে পড়ল। অমনি সে গরগর করে ঝাঁপিয়ে গেল চামচিকেটার দিকে।