আমাদের কর্তব্য শুধু ত্যাগ—গ্রহণ নয়। যদি আমার মাথায় খেয়াল না চাপত, তাহলে আমি কখনই এখানে আসতাম না। এতে আমার কাজের সহায়তা হবে, এই আশায় আমি ধর্মমহাসভায় যোগদান করেছি, যদিও আমার দেশবাসী যখন আমাকে পাঠাতে চেয়েছিল, তখন আমি সর্বদা আপত্তি করেছি। আমি তাদের বলে এসেছি, ‘আমি মহাসভায় যোগদান করতে পারি বা নাও পারি, তোমাদের যদি খুশী হয়, আমাকে পাঠাতে পার।’ তাঁরা আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। বাদ-বাকী আপনি করেছেন।
হে সহৃদয় বন্ধু, সর্বপ্রকারে আপনার সন্তোষ বিধান করতে ন্যায়তঃ আমি বাধ্য। আর বাকী পৃথিবীকে—তাদের বাতচিতকে আমি গ্রাহ্য করি না। আত্মসমর্থন সন্ন্যাসীর কাজ নয়। আপনার কাছে তাই আমার প্রার্থনা, আপনি ঐ পুস্তিকা ও চিঠিপত্রাদি কাউকে দেখাবেন না বা ছাপাবেন না। বুড়ো মিশনরীগুলোর আক্রমণকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। কিন্তু আমি দারুণ আঘাত পেয়েছি মজুমদারের ঈর্ষার জ্বালা দেখে। প্রার্থনা করি, তাঁর যেন চৈতন্য হয়। তিনি উত্তম ও মহান্ ব্যক্তি, সারা জীবন অপরের মঙ্গল করতে চেয়েছেন। অবশ্য এর দ্বারা আমার গুরুদেবের একটি কথাই আবার প্রমাণিত হল—‘কাজলের ঘরে থাকলে তুমি যত সেয়ানাই হও না কেন, গায়ে ছিটেফোঁটা কালি লাগবেই।’ সাধু পবিত্র হবার যত চেষ্টাই কেউ করুক না কেন, মানুষ যতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছে তার স্বভাব কিছু পরিমাণে নিম্নগামী হবেই।
ভগবানের দিকে যাবার পথ সাংসারিক পথের ঠিক বিপরীত। ঈশ্বর ও ধনৈশ্বর্য একই সঙ্গে কেউ কখনও পেয়েছে?
আমি কোনদিন ‘মিশনরী’ ছিলাম না, কোনদিন হবও না—আমার স্বস্থান হিমালয়ে। পূর্ণ বিবেকের সঙ্গে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে অন্ততঃ এই কথা আজ আমি বলতে পারি, ‘হে প্রভু, আমার ভ্রাতৃগণের ভয়ঙ্কর যাতনা আমি দেখেছি, যন্ত্রণামুক্তির পথ আমি খুঁজেছি এবং পেয়েছি—প্রতিকারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, প্রভু।’
তাঁর আশীর্বাদ অনন্তকাল ধরে আপনাদের উপর বর্ষিত হোক।
আপনার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগোঃ
আমি আগামীকাল কিম্বা পরশু চিকাগো যাচ্ছি।
আপনাদের বি.
৯৩*
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২০ মে, ১৮৯৪
প্রিয় শরৎ,
আমি তোমার পত্র পাইলাম ও শশী আরোগ্যলাভ করিয়াছে জানিয়া সুখী হইলাম। আমি তোমাকে একটি আশ্চর্য ব্যাপার বলিতেছি, শুন। যখনই তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ হইয়া পড়িবে, তখন সে নিজে অথবা তোমাদের মধ্যে অপর কেহ তাহাকে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করিবে। ঐরূপে দেখিতে দেখিতে মনে মনে বলিবে ও দৃঢ়ভাবে কল্পনা করিবে যে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে। ইহাতে সে শীঘ্র আরোগ্যলাভ করিবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে না জানাইয়াও তুমি এরূপ করিতে পার। সহস্র মাইলের ব্যবধানেও এই কার্য চলিতে পারে। এইটি সর্বদা মনে রাখিয়া আর কখনও অসুস্থ হইও না।
* * *
সান্যাল তাহার কন্যাগণের বিবাহের জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া এত অস্থির হইয়াছে কেন, বুঝিতে পারি না। মোদ্দা কথা তো এই যে, সে নিজে যে সংসার হইতে পলায়নে ইচ্ছুক, তাহার কন্যাগণকে সেই পঙ্কিল সংসারে নিমগ্ন করিতে চাহে!!! এ বিষয়ে আমার একটি মাত্র সিদ্ধান্ত থাকিতে পারে—নিন্দা! বালক বালিকা—যাহারই হউক না কেন, আমি বিবাহের নাম পর্যন্ত ঘৃণা করি। তুমি কি বলিতে চাও, আমি একজনের বন্ধনের সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন আজ বিবাহ করে, আমি তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখিব না। এ বিষয়ে আমি স্থিরসংকল্প। এখন বিদায়—
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৯৪*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৪ মে, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
এই সঙ্গে আমি আপনাকে রাজপুতানার অন্যতম শাসক মহামান্য খেতড়ির মহারাজের পত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহৎ দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের প্রাক্তন মন্ত্রীর পত্রও পাঠালাম। ইনি আফিং কমিশনের একজন সদস্য এবং ‘ভারতের গ্লাডষ্টোন’ নামে খ্যাত। মনে হয় এগুলি পড়লে আপনার বিশ্বাস হবে যে—আমি প্রতারক নই।
একটা জিনিষ আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কখনই মিঃ মজুমদারের ‘নেতা’র৫১ মতাবলম্বী হইনি। যদি মজুমদার তেমন কথা বলে থাকেন, তিনি সত্য বলেননি।
চিঠিগুলো পাঠের পর আশা করি অনুগ্রহ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। পুস্তিকাটির কোন দরকার নেই, ওটার কোন মূল্য দিই না।
প্রিয় বন্ধু, আমি যে যথার্থই সন্ন্যাসী, এ বিষয়ে সর্বপ্রকারে আপনাকে আশ্বস্ত করতে আমি দায়বদ্ধ। কিন্তু সে কেবল ‘আপনাকেই’। বাকী নিকৃষ্ট লোকেরা কি বলে না বলে, আমি তার পরোয়া করি না।
‘কেউ তোমাকে বলবে সাধু, কেউ বলবে চণ্ডাল, কেউ বলবে উন্মাদ, কেউ বলবে দানব, কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের পথে চলে যাও’—এই কথা বলেছিলেন বার্ধক্যে সন্ন্যাসগ্রহণকারী রাজা ভর্তৃহরি—ভারতের একজন প্রাচীন সম্রাট্ ও মহান্ সন্ন্যাসী।
ঈশ্বরের চিরন্তন আশীর্বাদ আপনার উপর বর্ষিত হোক। আপনার সকল সন্তানের জন্য আমার ভালবাসা, এবং আপনার মহীয়সী পত্নীর উদ্দেশ্যে আমার শ্রদ্ধা।
আপনার সদাবান্ধব
বিবেকানন্দ
পুনশ্চঃ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সে কেবল সমাজসংস্কারের ব্যাপারে।—কে আমি সব সময় আন্তরিকতাহীন বলে মনে করেছি, এবং এখনও সে-মত পরিবর্তনের কোন কারণ ঘটেনি। ধর্মীয় ব্যাপারে অবশ্য আমার বন্ধু পণ্ডিতজীর সঙ্গেও আমার বিশেষ মতপার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল—আমার কাছে সন্ন্যাস সর্বোচ্চ আদর্শ, তাঁর কাছে পাপ। সুতরাং ব্রাহ্মসমাজীরা সন্ন্যাসী হওয়াকে পাপ বলে মনে তো করবেই!!