- বইয়ের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা – সপ্তম খণ্ড
- লেখকের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দ
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
০১. পত্রাবলী (পুনরাবৃত্তি) (১১৫-৩৭৪)
পত্রাবলী ১২৯
৫৪১,ডিয়ারর্বন এভিনিউ,চিকাগো*
নভেম্বর,১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী ,
আপনার পএ পাইয়া বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি । পরিহাস আমি ঠিকই বুঝিতে পারি , কিন্তু আমি ক্ষুদ্র শিশুটি নই যে উহাতেই নিরস্ত হইব ।…
সংগঠন – ও সংযোগশক্তিই পাশ্চাত্য জাতিগুলির সাফল্যের হেতু; আর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস , সহযোগিতা ও সহয়তা দ্বারাই ইহা সম্ভব হইয়া থাকে ।… জৈনধর্মাবলন্বী বীরচাঁদ গান্দীর কথাই ধরুন , তাঁহাকে আপনি বোম্বাইয়ে ষথেষ্ট জানিতেন । এই ভদ্রলোকটি এদেশের দুর্জয় শীতেও নিরামিষ ভিন্ন অন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না এবং নিজের দেশ ও ধর্মকে প্রাণপণ সমর্থন করেন । এদেশের জনসাধারণ তাঁহাকে বিশেষ পছন্দ করে, কিন্ত যাহারা তাঁহা কে এদেশে পাঠাইয়াছিল, তাহারা আজ কি করিতেছে ?- তাহারা বীরচাঁদ জাতিচ্যুত করিতে সচেষ্ট।
হিংসারুপ পাপ দাসজাতির মধ্যৈই স্বভাবতঃ উদ্ভুত হইয়া থাকে এবং উহাই তাহাদিগকে হীনতার প নিমজ্জিত করিয়া রাখে। এদেশে ‘-‘ রা বক্তৃতা করিয়া অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করিতেছিল এবং কিছু সাফল্য লাভ যে করে নাই এমন নহে কিন্তু তদপেক্ষা অধিকতর সাফল্য আমি লাভ করিআছিলাম ; আমি কোনপ্রকারে তাহাদের বিঘ্নস্বরুপ হই নাই। তবে কি কারণে আমার সাফল্য অধিক হইয়াছিল ? কারণ উহাই ভগবানের অভিপ্রায় ছিল ।
এদেশে কেহ যদি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে তবে সকলের তাহার সহায়তা করিতে প্রস্তুত । আর ভারতবর্ষে কাল যদি কোন একটি পএিকায় আপনি আমার প্রশংসা করিয়া এক ছাত্র লেখেন,তবে পরদিন দেশসুদ্ধ সকলে আমার বিপক্ষে দাঁড়াইবে । ইহার হেতু কি ? হেতু-দাসসুলভ মনোবৃত্তি । নিজেদের মধ্যে কেহ সাথারণ স্তর হইতে একটু মাথা উঁচু কলরিয়া দাঁড়াইবে,ইহা তাহাদের পক্ষে অসহ্য । এদেশের মুক্তিকামী,স্বাবলম্বী ও ভ্রাতৃভাবে উদ্বুদ্ধ জনগণের সহিত আমাদের দেশের অপদার্থ লোকগুলির কি আপনি তুলনা করিতে চান ? আমাদের সহিত যাহাদের নিকটতম সাদৃশ্য আছে তাহারা এদেশের সদ্যোদাসত্বমুক্ত নিগ্রোগণ ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে প্রায় দুই কোটি নিগ্রো আর মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি শ্বেত- আমেরিকান বাস করে ; অথচ এই শ্বেতকায় কয়েকজনই নিগ্রোদিগকে দাবাইয়া রাখিয়াছে ।
আইন অনুসারে সব ক্ষমতা থাকা সত্বেও এই দাসজাতির মুক্তির জন্য আমেরিকানরা ভাইয়ে ভাইয়ে এক নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিল । সেই একই দোষ- হিংসা এখানেও রহিয়াছে । একজন নিগ্রো আর একজন প্রশংসা কিংবা উন্নতি সহ্য করিতে পারে না ; অবিলম্বে তাহাকে নিষ্পেষিত করিবার জন্য আমেরিকানদিগের সহিত যোগ দেয় । ভারত বর্ষের বাহিরেনা আসিলে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা হওয়া সম্ভব নহে ।
যাহাদের প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে , তাহাদের পক্ষে জগংকে এইভাবে চলিত দেওয়া ঠিক বটে ; কিন্তু যাহারা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিষ্পেষিত নরনারীর বুকের রক্তদ্বারা অর্জিত অর্থে শিক্ষিত হইয়া এবং বিলাসিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকিয়াও উহাদের কথা একটিবার চিন্তা করিবার অবসর পায় না – তাহাদিগকে আমি ‘বিশ্বাসঘাতক ‘ বলিয়া অভিহিত করি ।
কোথায় ইতিহাসের কোন যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদিয় , পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগনণ দীন দুঃখীর জন্য চিন্তা করিয়াছে ? অথচ ইহাদের নিষ্পেষণ করাতেই তাহাদের ক্ষমতার প্রাণশক্তি ।
কিন্তু প্রভু মহান । শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, এ অন্যায়ের সমুচিত ফলও ফলিয়াছে । যাহারা দরিদ্রের রক্ত শোষণ করিয়াছে, উহাদের অর্জিত অর্থে নিজেরা শিক্ষা লাভ করিয়াছে , এমনকি , যাহাদের ক্ষমতা – প্রতিপত্তির সৌধ দরিদ্রের দুঃখদৈন্যের উপরই নির্মিত – কালচক্র আবর্তনে তাহাদেরই হাজার হাজার লোক দাসরুপে বিক্রিত হইয়াছে ; তাহাদের স্ত্রীকন্যার মর্যাদা নষ্ট হইয়াছে এবং বিষয়- সম্পত্তি সবই হইয়াছে । বিগত সহস্র বসর যাবৎ ইহাই চলিয়া আসিতেছে । আর ইহার পশ্চিতে কি কোন কারণ নাই বলিয়া আপনি মনে করেন ?
ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি কেন ? এ কথা বলা মুর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল ।….. বস্তুতঃ জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল । আর সেইজন্য বাংলাদেশে যেখানে জমিদারর বিশেষ সংখ্যাধিক্য সেখানে কৃষকসম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী ।
এই নির্যাতিত ও অধঃপতিত লক্ষ লক্ষ নরনারীর উন্নতির কথা কে চিন্তা করে ? কয়েক হাজার ডিগ্রিধারী ব্যক্তিদ্বারা একটি জাতি গঠিত হয় না, অথবা মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি ধনীও একটি জাতি নহে । আমাদের সুযোগ – সুবিধা খুব বেশী নাই এ কথা অবশ্য সত্য , কিন্তু যেটুকু আছে, তাহা এিশ কোটি নরনারীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষেও যথেষ্ট।
আমাদের দেশের শটকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত,অথচ কে তাহাদের বিষয় চিন্তা করে ? এইসকল বাবুর দল কিংবা তথাকথিত দেশহিতৈষীর দল কি ?
এইসকল সত্বেও আমি বলি যে, ভগবান অবশ্যই একজন আছেন এবং এ কথা পরিহাসের বিষয় নহে। তিনিই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন ; এবং যদিও আমি জানি যে ,দাসজাতি তাহার স্বভাবদোষে যথার্থ হিতকারীকেই দংশন করিয়া থাকে , তথাপি ইহাদের জন্য আমি প্রার্থনা করি এবং আমার সহিত আপনিও প্রার্থনা করুন। যাহা কিছু সং, যাহা কিছু মহৎ , তাহার প্রতি আপনি যথার্থ সহানুভুতিসম্পন্ন । আপনাকে জানিয়া অন্ততঃ এমন একজনকে জানিয়াছি বলিয়া আমি মনে করি, য়াঁহার মধ্যে সারবস্ত আছে , য়াঁহার প্রকৃতি উদার এবং যিনি অন্তরে বাহিরে অকপট । তাই আমার সহিত ‘তমসো মা জ্যোতির্গময় ‘- এই প্রার্থনায় যোগ দিতে আমি আপনাকে আহ্বান করি।
লোকে কি বলিল – সেদিকে আমি ভ্রুক্ষেপ করি না । আমার ভগবানকে, আমার ধর্মকে, আমার দেশকে -সর্বোপরি দরিদ্র ভিক্ষুককে আমি ভালবাসি । নিপীড়িত, অশিক্ষিত ও দীনহীনকে আমি ভালবাসি তাহাদের বেদনা অন্তরে অনুভব করি, কত তীব্রভাবে অনুভব করি, তাহা প্রভুই জানেন । তিনিই আমাকে পথ দেখাইবেন । মানুশের স্ততি-নিন্দায় আমি দৃকপাতও করি না, তাহাদের অধিকাংশকেই অঞ্জ কলরবকারি শিশুর মতো মনে করি। সহানুভুতি ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার ঠিক মর্মকথাটি ইহারা কখনও বুঝিতে পারে না। কিন্ত শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে আমার সে অন্তদৃষ্টি আছে।
মুষ্ঠিমেয় সহকর্মীদের লইয়া এখন আমি কাজ করিতে চেষ্টা করিতেছি, আর উহাদের প্রত্যেকে আমারই মতো দরিদ্র ভিক্ষুক। তাহাদিগকে আপনি দেখিয়াছেন । প্রভুর কাজ চিরদিনই দীন -দরিদ্রগণই সম্পন্ন করিয়াছে। আশীর্বাদ করিবেন যেন ইশ্বরের প্রতি, গুরুর প্রতি এবং নিজের প্রতি আমার বিশ্বাস অটুট থাকে।
প্রেম এবং সহানুভুতিই একমাত্র পন্থা। ভালবাসাই একমাত্র উপাসনা।
প্রভু আপনাদের নিরন্তর সহায়তা করুন। আমার আশীর্বাদাদি জানিবেন।