স্বভাবতই এইবার আমাদের ঈশ্বরতত্ত্ব-আলোচনার সময় আসিয়াছে। কিন্তু তৎপূর্বেই ‘আত্মা’ সম্বন্ধে একটি কথা বলিতে চাই। যাঁহারা ইংরেজী ভাষা চর্চা করেন, তাঁহারা অনেক সময় Soul ও Mind—এই দুইটি শব্দে বড় গোলযোগে পড়িয়া যান। সংস্কৃত ‘আত্মা’ ও ইংরেজী’ ‘Soul’ শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্নার্থবাচক। আমরা যাহাকে ‘মন’ বলি, পাশ্চাত্যেরা তাহাকে ‘Soul’ বলেন। পাশ্চাত্য দেশে আত্মা সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান কোন দিন ছিল না। প্রায় বিশ বৎসর হইল সংস্কৃত দর্শনশাস্ত্রের সাহায্যে ঐ জ্ঞান পাশ্চাত্য দেশে আসিয়াছে। আমাদের এই স্থূল শরীরের পশ্চাতে মন; মন কিন্তু আত্মা নহে; উহা সূক্ষ্ম শরীর—সূক্ষ্ম তন্মাত্রয় নির্মিত। উহাই জন্মজন্মান্তরে বিভিন্ন শরীর আশ্রয় করে, উহার পশ্চাতে মানুষের আত্মা রহিয়াছে। এই ‘আত্মা’ শব্দ Soul বা Mind শব্দের দ্বারা অনূদিত হইতে পারে না—সুতরাং আমাদিগকে সংস্কৃত ‘আত্মা’ অথবা আধুনিক পাশ্চাত্য দার্শনিকগণের মতানুযায়ী ‘Self’ শব্দ ব্যবহার করিতে হইবে। যে শব্দই আমরা ব্যবহার করি না কেন, আত্মা যে মন ও স্থূল-শরীর—উভয় হইতেই পৃথক্, এই ধারণাটি মনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে রাখিতে হইবে। আর এই আত্মাই মন বা সূক্ষ্ম-শরীরকে সঙ্গে লইয়া এক দেহ হইতে দেহান্তরে গমন করে; কালে যখন সর্বজ্ঞত্ব ও পূর্ণত্ব লাভ করে, তখন উহার আর জন্মমৃত্যু হয় না—তখন উহা মুক্ত হইয়া যায়; ইচ্ছা করিলে জীবাত্মা এই মন বা সূক্ষ্ম-শরীরকে রাখিতেও পারে, অথবা উহাকে পরিত্যাগ করিয়া অনন্তকালের জন্য স্বাধীন ও মুক্ত হইয়া যাইতে পারে। মুক্তিই আত্মার লক্ষ্য। ইহাই আমাদের ধর্মের বিশেষত্ব।
আমাদের ধর্মেও স্বর্গ-নরক আছে, কিন্তু উহারা চিরস্থায়ী নহে। স্বর্গ-নরকের স্বরূপ বিচার করিলে সহজেই প্রতীত হয় যে, উহারা চিরস্থায়ী হইতে পারে না। যদি স্বর্গ বলিয়া কিছু থাকে, তবে তাহা এই মর্ত্যলোকেরই পুনরাবৃত্তিমাত্র হইবে—না হয় একটু বেশী সুখ, একটু না হয় বেশী ভোগ। তাহাতে বরং আরও মন্দই হইবে। এইপ্রকার স্বর্গ অনেক। যাহারা ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত ইহলোকে কোন সৎকর্ম করে, তাহারা মৃত্যুর পর এইরূপ কোন স্বর্গে ইন্দ্রাদি দেবতা হইয়া জন্মগ্রহণ করে। এই দেবত্ব বিশেষ বিশেষ পদমাত্র। এই দেবতারাও এক সময়ে মানুষ ছিলেন; সৎকর্মবশে ইহাদের দেবত্বপ্রাপ্তি হইয়াছে। ইন্দ্র-বরুণাদি কোন দেব-বিশেষের নাম নহে। সহস্র সহস্র ইন্দ্র হইবেন। রাজা নহুষ মৃত্যুর পর ইন্দ্রত্ব লাভ করিয়াছিলেন। ইন্দ্রত্ব পদমাত্র। কোন ব্যক্তি সৎকর্মের ফলে উন্নত হইয়া ইন্দ্রত্ব লাভ করিলেন, কিছুদিন সেই পদে প্রতিষ্ঠিত রহিলেন, আবার সেই দেবদেহ ত্যাগ করিয়া পুনরায় মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করিলেন। মনুষ্যজন্মই শ্রেষ্ঠ জন্ম। কোন কোন দেবতা স্বর্গসুখের বাসনা ত্যাগ করিয়া মুক্তিলাভের চেষ্টা করিতে পারেন; কিন্তু যেমন এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ধন মান ঐশ্বর্য লাভ করিলে উচ্চতত্ত্ব ভুলিয়া যায়, সেইরূপ অধিকাংশ দেবতাই ঐশ্বর্যমদে মত্ত হইয়া মুক্তির চেষ্টা করেন না; তাঁহাদের শুভ কর্মের ফলভোগ শেষ হইয়া গেলে তাঁহারা পুনরায় এই পৃথিবীতে আসিয়া মনুষ্যদেহ ধারণ করেন। অতএব এই পৃথিবীই কর্মভূমি; এই পৃথিবী হইতেই আমরা মুক্তি লাভ করিতে পারি। সুতরাং এই-সকল স্বর্গেও আমাদের বিশেষ প্রয়োজন নাই। তবে কোন্ বস্তু লাভ করিবার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত?—মুক্তি। আমাদের শাস্ত্র বলেনঃ ‘শ্রেষ্ঠ স্বর্গেও তুমি প্রকৃতির দাসমাত্র। বিশ হাজার বৎসর তুমি রাজত্ব ভোগ করিলে—তাহাতে কি হইল? যতদিন তোমার শরীর থাকে, ততদিন তুমি সুখের দাসমাত্র। যতদিন দেশ-কাল তোমার উপর কার্য করিতেছে, ততদিন তুমি ক্রীতদাসমাত্র।’ এই কারণেই আমাদিগকে বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতি—উভয়কে জয় করিতে হইবে। প্রকৃতি যেন তোমার পদতলে থাকে—প্রকৃতিকে পদদলিত করিয়া, তাহাকে অতিক্রম করিয়া স্বাধীন মুক্তভাবে তোমাকে নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে। তখন তুমি জন্মের অতীত হইলে, সুতরাং মৃত্যুরও পারে উপনীত হইলে। তখন তোমার সুখ চলিয়া গেল, সুতরাং তুমি দুঃখেরও অতীত হইলে। তখনই তুমি সর্বাতীত অব্যক্ত অবিনাশী আনন্দের অধিকারী হইলে। আমরা যাহাকে এখানে সুখ ও কল্যাণ বলি, তাহা সেই অনন্ত আনন্দের এক কণামাত্র। ঐ অনন্ত আনন্দই আমাদের লক্ষ্য।
আত্মা অনন্ত আনন্দস্বরূপ, উহা লিঙ্গবর্জিত। আত্মাতে নরনারী ভেদ নাই। দেহ সম্বন্ধেই নরনারী ভেদ। অতএব আত্মাতে স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আরোপ করা ভ্রমমাত্র—শরীর সম্বন্ধেই উহা সত্য। আত্মার সম্বন্ধে কোনরূপ বয়সও নির্দিষ্ট হইতে পারে না, সেই প্রাচীন পুরুষ সর্বদাই একরূপ।
এই আত্মা কিরূপে সংসারে বদ্ধ হইলেন? একমাত্র আমাদের শাস্ত্রই ঐ প্রশ্নের উত্তর দিয়া থাকেন। অজ্ঞানই বন্ধনের কারণ। আমরা অজ্ঞানেই বদ্ধ হইয়াছি—জ্ঞানোদয়েই অজ্ঞানের নাশ হইবে, জ্ঞানই আমাদিগকে এই অজ্ঞানের পারে লইয়া যাইবে। এই জ্ঞানলাভের উপায় কি? ভক্তিপূর্বক ঈশ্বরের উপাসনা এবং ভগবানের মন্দিরজ্ঞানে সর্বভূতে প্রেম দ্বারা সেই জ্ঞানলাভ হয়। ঈশ্বরে পরানুরক্তিবলে জ্ঞানের উদয় হইবে, অজ্ঞান দূরীভূত হইবে, সকল বন্ধন টুটিয়া যাইবে এবং আত্মা মুক্তিলাভ করিবেন।