- বইয়ের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা – চতুর্থ খণ্ড
- লেখকের নামঃ স্বামী বিবেকানন্দ
- বিভাগসমূহঃ রচনাবলী
০১. ভক্তিযোগ
০১. ভক্তির লক্ষণ
অকপটভবে ঈশ্বরানুসন্ধানই ভক্তিযোগ; প্রীতি ইহার আদি, মধ্য ও অন্ত। মুহূর্তস্থায়ী ভগবৎ-প্রেমোন্মত্ততা হইতেও শাশ্বতী মুক্তি আসিয়া থাকে। নারদ তদীয় ‘ভক্তিসূত্র’-এ বলিয়াছেন, ‘ভগবানে পরম প্রেমই ভক্তি।’ ‘ইহা লাভ করিলে জীব সর্বভূতে প্রেমবান্ ও ঘৃণাশূন্য হয় এবং অনন্তকালের জন্য তৃপ্তি লাভ করে।’ ‘এই প্রেমের দ্বারা কোন কাম্য বস্তু লাভ হইতে পারে না, কারণ বিষয়বাসনা থাকিতে এই প্রেমের উদয়ই হয় না।’ ‘কর্ম, জ্ঞান এবং যোগ হইতেও ভক্তি অধিকতরা, কারণ সাধ্যবিশেষই উহাদের লক্ষ্য, কিন্তু ভক্তি স্বয়ংই সাধ্য ও সাধনস্বরূপা।’১
আমাদের দেশের সকল মহাপুরুষই ভক্তিতত্ত্বের আলোচনা করিয়াছেন। শাণ্ডিল্য, নারদাদি ভক্তিতত্ত্বের বিশেষ ব্যাখ্যাতাগণকে ছাড়িয়া দিলেও স্পষ্টতঃ জ্ঞানমার্গ-সমর্থনকারী ব্যাসসূত্রের মহান্ ভাষ্যকারও ভক্তিসম্বন্ধে অনেক ইঙ্গিত করিয়াছেন। সমুদয় না হউক, অধিকাংশ সূত্রই শুষ্কজ্ঞানসূচক অর্থে ব্যাখ্যা করিবার আগ্রহ ভাষ্যকারের থাকিলেও সূত্রগুলির—বিশেষতঃ উপাসনা-বিষয়ক সূত্রগুলির অর্থ নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান করিলে সহজে তাহাদের ঐরূপ ব্যাখ্যা চলিতে পারে না।
সাধারণতঃ লোকে জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে যতটা পার্থক্য আছে মনে করে, বাস্তবিক তাহা নাই। ক্রমশঃ বুঝিব, জ্ঞান ও ভক্তি শেষে একই লক্ষ্যে মিলিত হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ জুয়াচোর ও গুপ্তবিদ্যার নামে ছলনাকারীদের হাতে পড়িয়া রাজযোগ প্রায়ই অসাবধান ব্যক্তিদের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এরূপ না হইয়া মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হইলে রাজযোগও সেই একই লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দেয়।
ভক্তিযোগে এক বিশেষ সুবিধা—উহা আমাদের চরম লক্ষ্য ঈশ্বরে পৌঁছিবার সর্বাপেক্ষা সহজ ও স্বাভাবিক পন্থা। কিন্তু উহাতে বিশেষ বিপদাশঙ্কা এই যে, নিম্নস্তরের ভক্তি অনেক সময়ে ভয়ানক গোঁড়ামির আকার ধারণ করে। হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীষ্ট-ধর্মান্তর্গত গোঁড়ার দল—এই নিম্নস্তরের ভক্তিসাধকগণের মধ্যেই সর্বদা বিশেষ ভাবে দেখিতে পাওয়া যায়। যে ইষ্টনিষ্ঠা ব্যতীত প্রকৃত প্রেম জন্মে না, সেই ইষ্টনিষ্ঠাই আবার অনেক সময় অন্য সকল মতের উপর তীব্র আক্রমণ ও দোষারোপের কারণ। সকল ধর্মের ও সকল দেশের দুর্বল অপরিণতমস্তিষ্ক ব্যক্তিগণ একটিমাত্র উপায়েই তাহাদের নিজ আদর্শ ভালবাসিতে পারে। সেই উপায়টি—অপর সমুদয় আদর্শকে ঘৃণা করা। নিজ ঈশ্বরাদর্শে, নিজ ধর্মাদর্শে একান্ত অনুরক্ত ব্যক্তিগণ অন্য কোন আদর্শের বিষয় শুনিলে বা দেখিলে কেন গোঁড়ার মত চীৎকার করিতে থাকে, তাহার কারণ ইহা হইতেই বুঝা যায়। এরূপ ভালবাসা যেন প্রভুর সম্পত্তিতে অপরের হস্তক্ষেপ-নিবারণের জন্য কুকুর-সুলভ সহজ প্রবৃত্তির মত। তবে প্রভেদ এই—কুকুরের এই সহজ প্রবৃত্তি মানবযুক্তি অপেক্ষা উচ্চতর; প্রভু যে বেশ ধরিয়াই আসুন না কেন, কুকুর তাঁহাকে কখনও শত্রু বলিয়া ভুল করে না। গোঁড়া কিন্তু সমুদয় বিচার শক্তি হারাইয়া ফেলে। ব্যক্তিগত বিষয়ে তাহার দৃষ্টি এত অধিক যে, কোন ব্যক্তি কি বলিতেছে, তাহা সত্য কি মিথ্যা, তাহা শুনিবার বা বুঝিবার কোন প্রয়োজন সে বোধ করে না: কিন্তু কে উহা বলিতেছে, সেই বিষয়েই তাহার বিশেষ দৃষ্টি। যে-লোক স্বমতাবলম্বী ব্যক্তিগণের উপর দয়াশীল, ন্যায়পরায়ণ ও প্রেমযুক্ত, সে-ই নিজ সম্প্রদায়ের বহির্ভূত ব্যক্তিদের অনিষ্ট করিতে ইতস্ততঃ করে না।
তবে এ আশঙ্কা কেবল ভক্তির নিম্নস্তরেই আছে—এই অবস্থার নাম ‘গৌণী’। উহা পরিপক্ব হইয়া পরাভক্তিতে পরিণত হইলে আর এরূপ ভয়ানক গোঁড়ামি আসিবার আশঙ্কা থাকে না। এই পরাভক্তির প্রভাবে সাধক প্রেমস্বরূপ ভগবানের এত নিকটতা লাভ করেন যে, তিনি আর অপরের প্রতি ঘৃণার ভাব বিস্তার করিবার যন্ত্রস্বরূপ হইতে পারেন না।
এই জীবনেই যে আমরা সকলে সামঞ্জস্যের সহিত চরিত্র গড়িয়া তুলিতে পারিব, তাহা সম্ভব নয়; তবে আমরা জানি—যে-চরিত্রে জ্ঞান ভক্তি ও যোগ সমন্বিত হইয়াছে, সেই চরিত্রই সর্বাপেক্ষা মহৎ। উড়িবার জন্য পাখির তিনটি জিনিষের আবশ্যক—দুইটি পক্ষ ও চালাইবার হালস্বরূপ একটি পুচ্ছ। জ্ঞান ও ভক্তি দুইটি পক্ষ, সামঞ্জস্য রাখিবার জন্য যোগ উহার পুচ্ছ। যাঁহারা এই তিনপ্রকার সাধন-প্রণালী একসঙ্গে সামঞ্জস্যের সহিত অনুষ্ঠান করিতে না পারিয়া ভক্তিকেই একমাত্র পথ বলিয়া গ্রহণ করেন, তাঁহাদের পক্ষে এটি সর্বদা স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, বাহ্য অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপ প্রথম অবস্থায় সাধকের পক্ষে অত্যাবশ্যক হইলেও ভগবানের প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের অবস্থায় আগাইয়া দেওয়া ব্যতীত এগুলির আর কোন উপযোগিতা নাই।
জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গের আচার্যগণের মধ্যে সামান্য একটু মতভেদ আছে, যদিও উভয়েই ভক্তির প্রভাবে বিশ্বাসী। জ্ঞানীরা ভক্তিকে মুক্তির উপায়মাত্র বলিয়া বিশ্বাস করেন, কিন্তু ভক্তেরা উহাকে উপায় ও উদ্দেশ্য—একাধারে দুই-ই মনে করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, এ প্রভেদ নামমাত্র। প্রকৃতপক্ষে ভক্তিকে সাধন-স্বরূপ ধরিলে নিম্নস্তরের উপাসনামাত্র বুঝায়, আর একটু অগ্রসর হইলে এই নিম্নস্তরের উপাসনাই উচ্চস্তরের ভক্তির সহিত অভিন্নভাব ধারণ করে। প্রত্যকেই নিজ নিজ সাধন-প্রণালীর উপর ঝোঁক দিয়া থাকেন। তাঁহারা ভুলিয়া যান—প্রকৃত জ্ঞান অযাচিত হইলেও পূর্ণ ভক্তির সহিত আসিবেই আসিবে, আর পূর্ণ জ্ঞানের সহিত প্রকৃত ভক্তিও অভিন্ন।