কে এই সৃষ্টি করিতেছেন?—ঈশ্বর। ইংরেজীতে সাধারণতঃ God শব্দে যাহা বুঝায় আমার অভিপ্রায় তাহা নহে। সংস্কৃত ‘ব্রহ্ম’ শব্দ ব্যবহার করাই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত। তিনিই এই জগৎপ্রপঞ্চের সাধারণ কারণস্বরূপ। ব্রহ্মের স্বরূপ কি? ব্রহ্ম নিত্য—নিত্যশুদ্ধ নিত্যজাগ্রত সর্বশক্তিমান্ সর্বজ্ঞ দয়াময় সর্বব্যাপী নিরাকার অখণ্ড। তিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেন। এখন প্রশ্ন এই, যদি এই ব্রহ্ম জগতের নিত্য স্রষ্টা ও বিধাতা হন, তাহা হইলে দুইটি আপত্তি উপস্থিত হয়। জগতে তো যথেষ্ট বৈষম্য রহিয়াছে—এখানে কেহ সুখী, কেহ দুঃখী; কেহ ধনী, কেহ দরিদ্র; এইরূপ বৈষম্য কেন? আবার এখানে নিষ্ঠুরতাও বিদ্যমান। কারণ এখানে একের জীবন অন্যের মৃত্যুর উপর নির্ভর করিতেছে। এক প্রাণী আর এক প্রাণীকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেছে, প্রত্যেক মানবই নিজ ভ্রাতার গলা টিপিবার চেষ্টা করিতেছে। এই প্রতিযোগিতা, এই নিষ্ঠুরতা, এই উৎপাত, এই দিবা-রাত্রি গগনবিদারী দীর্ঘনিঃশ্বাস—ইহাই আমাদের এই জগতের অবস্থা! ইহাই যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়, তবে সেই ঈশ্বর ঘোরতর নিষ্ঠুর! মানুষের কল্পিত নিষ্ঠুরতম দানব অপেক্ষা এই ঈশ্বর আরও নিষ্ঠুর। বেদান্ত বলেন, ঈশ্বর এই বৈষম্য ও প্রতিযোগিতার কারণ নহেন। তবে কে ইহা করিল?—আমরা নিজেরাই করিয়াছি। মেঘ সকল ক্ষেত্রের উপর সমভাবেই বর্ষণ করে। কিন্তু যে-ক্ষেত্র উত্তমরূপে কর্ষিত, তাহাই শস্যশালী হয়; যে-ভূমি ভালভাবে কর্ষিত নয়, তাহা ঐ বৃষ্টির ফল লাভ করিতে পারে না। ইহা মেঘের অপরাধ নহে। তাঁহার দয়া অনন্ত অপরিবর্তনীয়—আমরাই কেবল এই বৈষম্য সৃষ্টি করিতেছি। কিরূপে আমরা এই বৈষম্য সৃষ্টি করিলাম? কেহ জগতে সুখী হইয়া জন্মাইল, কেহ বা অসুখী—তাহারা তো এই বৈষম্য সৃষ্টি করে নাই? করিয়াছে বৈ কি! পূর্বজন্মকৃত কর্মের দ্বারা এই ভেদ—এই বৈষম্য সৃষ্ট হইয়াছে।
এখন আমরা সেই দ্বিতীয় তত্ত্বের আলোচনায় আসিলাম—যাহাতে শুধু আমরা হিন্দুরা নই, বৌদ্ধ এবং জৈনগণও একমত। আমরা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকি, সৃষ্টির মত জীবনও অনন্ত। শূন্য হইতে যে জীবনের উৎপত্তি হইয়াছে, তাহা নহে—তাহা হইতেই পারে না; এইরূপ জীবনের কোন প্রয়োজন নাই। কালে যাহার আরম্ভ, কালেই তাহার অন্ত হইবে। গতকল্য যদি জীবনের আরম্ভ হইয়া থাকে, তবে আগামী কল্য উহার শেষ হইবে—পরে উহার সম্পূর্ণ ধ্বংস হইবে। জীবন অবশ্য পূর্বেও বর্তমান ছিল। আজকাল ইহা বেশী বুঝাই- বার আবশ্যক নাই; কারণ আধুনিক বিজ্ঞান এই বিষয়ে আমাদিগকে সাহায্য করিতেছে— জড়-জগতের আবিষ্কারগুলির সাহায্যে আমাদের শাস্ত্রনিহিত তত্ত্বগুলি বুঝাইয়া দিতেছে। তোমরা সকলে পূর্ব হইতেই অবগত আছ যে, আমাদের প্রত্যেকেই অনন্ত অতীতের কর্মসমষ্টির ফলস্বরূপ। কবিগণের বর্ণনানুযায়ী কোন শিশুকেই প্রকৃতি স্বহস্তে জগৎ-রঙ্গমঞ্চে লইয়া আসেন না, তাহার স্কন্ধে অনন্ত অতীতের কর্মসমষ্টি রহিয়াছে। ভালই হউক আর মন্দই হউক, সে নিজ অতীত কর্মের ফল ভোগ করিতে আসে। ইহা হইতেই বৈষম্যের উৎপত্তি। ইহাই কর্মবিধান; আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অদৃষ্টের নিয়ামক। এই মতবাদের দ্বারা অদৃষ্টবাদ খণ্ডিত হয় এবং ইহা-দ্বারাই ‘ঈশ্বরের বৈষম্য-নৈর্ঘৃণ্য-দোষ’ নিরাকৃত হয়। আমরা যাহা কিছু ভোগ করি, তাহার জন্য আমরাই দায়ী, অপর কেহ নহে। আমরাই কার্য, আমরাই কারণস্বরূপ; সুতরাং আমরা স্বাধীন। যদি আমরা অসুখী হই, তবে বুঝিতে হইবে—আমিই আমাকে অসুখী করিয়াছি। আর ইহাও প্রতীয়মান হইবে যে, আমি যদি ইচ্ছা করি, তবে সুখীও হইতে পারি। যদি আমি অপবিত্র হই, তবে তাহাও আমার নিজকৃত; আর বুঝিতে হইবে যে, আমি ইচ্ছা করিলে আবার পবিত্র হইতে পারি। সকল বিষয়ে এইরূপ বুঝিতে হইবে। মানুষের ইচ্ছা কোন ঘটনার অধীন নহে। মানুষের অনন্ত ইচ্ছাশক্তি ও মুক্ত স্বভাবের সম্মুখে সকল শক্তি, এমন কি, প্রাকৃতিক শক্তিগুলি পর্যন্ত মাথা নত করিবে—দাস হইয়া থাকিবে।
এইবার স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে—আত্মা কি? আত্মাকে না জানিলে আমাদের শাস্ত্রোক্ত ঈশ্বরকেও জানিতে পারি না। ভারতে ও অন্যান্য দেশে বহিঃপ্রকৃতির আলোচনা-দ্বারা সেই সর্বাতীত সত্তার আভাস পাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমরা জানি, ইহার ফলও অতি শোচনীয় হইয়াছে। সেই সত্তার আভাস পাওয়া দূরে থাক্, আমরা যতই জড়-জগতের আলোচনা করি, ততই অধিকতর জড়বাদী হইতে থাকি। যদি বা একটু-অধটু ধর্মভাব পূর্বে থাকে, জড়-জগতের আলোচনা করিতে করিতে তাহাও দূর হইয়া যায়। অতএব আধ্যাত্মিকতা ও সেই পরমপুরুষের জ্ঞান বাহ্যজগৎ হইতে পাওয়া যায় না। অন্তরমধ্যে—আত্মার মধ্যে ঐ তত্ত্ব অন্বেষণ করিতে হইবে। বাহ্যজগৎ আমাদিগকে সেই অনন্তের কোন সংবাদ দিতে পারে না, অন্তর্জগতে অন্বেষণ করিলেই উহার সংবাদ পাওয়া যায়। অতএব কেবল আত্মতত্ত্বের অন্বেষণেই, আত্মতত্ত্বের বিশ্লেষণেই ঈশ্বরকে জানিতে পারি। জীবাত্মার স্বরূপ-সম্বন্ধে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মতভেদ আছে বটে, কিন্তু কোন কোন বিষয়ে সকলে একমত। যথা—সকল জীবাত্মা অনাদি অনন্ত, স্বরূপতঃ অবিনাশী। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেক আত্মায় সর্ববিধ শক্তি আনন্দ পবিত্রতা সর্বব্যাপিতা ও সর্বজ্ঞত্ব অন্তর্নিহিত রহিয়াছে। এই গুরুতর তত্ত্বটি সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে। প্রত্যেক মানবে, প্রত্যেক প্রাণীতে—সে যতই দুর্বল বা মন্দ হউক, সে বড় বা ছোট হউক—সেই সর্বব্যাপী সর্বজ্ঞ আত্মা রহিয়াছেন। আত্মা হিসাবে কোন প্রভেদ নাই—প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে। ঐ ক্ষুদ্রতম প্রাণী ও আমার মধ্যে প্রভেদ কেবল প্রকাশের তারতম্যে—স্বরূপতঃ তাহার সহিত আমার কোন ভেদ নাই; সে আমার ভ্রাতা; তাহারও যে আত্মা, আমারও সেই আত্মা। ভারত এই মহত্তম তত্ত্ব জগতে প্রচার করিয়াছে। অন্যত্র ‘সমগ্র মানবজাতির ভ্রাতৃভাব’ প্রচারিত হইয়া থাকে, ভারতে উহা ‘সর্বপ্রাণীর ভ্রাতৃভাব’—এই আকার ধারণ করিয়াছে। অতি ক্ষুদ্রতম প্রাণী, এমন কি ক্ষুদ্র পিপীলিকা পর্যন্ত আমার ভাই—তাহারাও আমার দেহস্বরূপ। ‘এবং তু পণ্ডিতৈর্জ্ঞাত্বা সর্বভূতময়ং হরিম্’ ইত্যাদি—এইরূপে পণ্ডিতগণ সেই প্রভুকে সর্বভূতময় জানিয়া সকল প্রাণীকে ঈশ্বরজ্ঞানে উপাসনা করিবেন। সেই কারণেই ভারতে ইতরপ্রাণী ও দরিদ্রগণের প্রতি এত দয়ার ভাব বর্তমান; সকল বস্তু সম্বন্ধেই—সকল বিষয়েই ঐ দয়ার ভাব। আত্মাতে সমুদয় শক্তি বর্তমান—এই মত ভারতের সকল সম্প্রদায়ের মিলনভূমি।