হে মান্দ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ, আপনাদিগের নিকট আর বিস্তারিতভাবে বুঝাইবার প্রয়োজন নাই যে, ইওরোপের আধুনিক গবেষণা জড়বিজ্ঞানের প্রণালীতে কিরূপে সমগ্র জগতের একত্ব প্রমাণ করিয়াছে—পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তুমি আমি সূর্য চন্দ্র তারা প্রভৃতি সবই অনন্ত জড়সমুদ্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গস্বরূপ। আবার শত শত শতাব্দী পূর্বে ভারতীয় মনোবিজ্ঞানও জড়বিজ্ঞানের ন্যায় প্রমাণ করিয়াছে যে, শরীর ও মন উভয়ই জড়সমুদ্রে বা সমষ্টির মধ্যে কতকগুলি পৃথক্ পৃথক্ সংজ্ঞা অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গমাত্র। আবার আর এক পদ অগ্রসর হইয়া বেদান্তে দেখানো হইয়াছে—এই আপাত-প্রতীয়মান জগৎপ্রপঞ্চের একত্বভাবেরও পশ্চাতে যে যথার্থ আত্মা রহিয়াছেন, তিনিও ‘এক’। জগদ-ব্রহ্মাণ্ড জুড়িয়া একমাত্র আত্মাই রহিয়াছেন—সবই সেই এক সত্তামাত্র। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মূলে বাস্তবিক যে এই একত্ব রহিয়াছে—এই মহান্ তত্ত্ব শ্রবণ করিয়া অনেকে ভয় পাইয়া থাকেন! অন্যান্য দেশের কথা দূরে থাকুক, এদেশেও অনেকে এই অদ্বৈতবাদকে ভয় করিয়া থাকেন!এখনও এই মতের অনুগামী অপেক্ষা বিরোধীর সংখ্যাই অধিক! তথাপি আমি বলিতেছি, যদি জগৎকে আমাদের জীবনপ্রদ একটি মহৎ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে হয়, তবে তাহা এই অদ্বৈতবাদ। ভারতের মূক জনসাধারণের উন্নতিবিধানের জন্য এই অদ্বৈতবাদের প্রচার আবশ্যক। এই অদ্বৈতবাদ কার্যে পরিণত না হইলে আমাদের এই মাতৃভূমির পুনরুজ্জীবনের আর উপায় নাই।
যুক্তিবাদী পাশ্চাত্যজাতি নিজেদের সমুদয় দর্শন ও নীতিবিজ্ঞানের মূলভিত্তি অনুসন্ধান করিতেছে। কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষ, তিনিই যতই বড় বা ঈশ্বরতুল্য ব্যক্তি হউন না কেন, যখন কাল জন্মগ্রহণ করিয়া আজই মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছেন, তখন তাঁহার অনুমোদিত বলিয়াই কোন দর্শন বা নীতিবিজ্ঞান প্রামাণিক হইতে পারে না। দর্শন বা নীতির প্রমাণের শুধু এই কারণ নির্দেশ করিলে তাহা কখনও উচ্চশ্রেণীর চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না; কোন মানুষের অনুমোদিত বলিয়া উহার প্রামাণ্য না মানিয়া তাঁহারা দেখিতে চাহেন, চিরন্তন তত্ত্বসমূহের উপরই উহার ভিত্তি স্থাপিত রহিয়াছে। একমাত্র অনন্ত সত্য তোমাতে, আমাতে—আমাদের সকলের আত্মায় বর্তমান রহিয়াছেন; অনাদী অনন্ত আত্মতত্ত্ব ব্যতীত নীতিবিজ্ঞানের সনাতন ভিত্তি আর কি হইতে পারে? আত্মার অনন্ত একত্বই সর্বপ্রকার নীতির মূলভিত্তি; তোমাতে আমাতে শুধু ‘ভাই ভাই’ সম্বন্ধ নহে,—মানবের দাসত্বশৃঙ্খল মোচন-চেষ্টার বর্ণনাপূর্ণ সকল গ্রন্থেই এই ‘ভাই ভাই’ ভাবের কথা আছে এবং শিশুতুল্য ব্যক্তিরাই তোমাদের নিকট উহার প্রচার করিয়াছে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তুমি আমি এক—ভারতীয় দর্শনের ইহাই সিদ্ধান্ত। সর্বপ্রকার নীতি ও ধর্মবিজ্ঞানের মূলভিত্তি এই একত্ব।
আমাদের দেশের সামাজিক অত্যাচারে পদদলিত সাধারণ লোকেরা যেমন এই মতের দ্বারা উপকৃত হইতে পারে, ইওরোপের পক্ষেও তেমনি ইহার প্রয়োজন। বাস্তবিকপক্ষে ইংলণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকায় আজকাল যেভাবে রাজনীতিক ও সামাজিক উন্নতিবিধানের চেষ্টা হইতেছে, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হয়, অজ্ঞাতসারে এখনই তাহারা এই মহান্ তত্ত্বকে সকল উন্নতির মূলভিত্তিরূপে গ্রহণ করিতেছে। আর হে বন্ধুগণ, আপনারা ইহাও লক্ষ্য করিবেন যে, সাহিত্যের মধ্যে যেখানে মানুষের স্বাধীনতা—অনন্ত স্বাধীনতার চেষ্টা অভিব্যক্ত, সেইখানেই ভারতীয় বৈদান্তিক আদর্শসমূহ পরিস্ফুট। কোন কোন ক্ষেত্রে লেখকগণ তাঁহাদের প্রচারিত ভাবসমূহের মূল উৎস সম্বন্ধে অজ্ঞ, কোন কোন স্থলে তাঁহারা নিজদিগকে মৌলিক গবেষণাশীল বলিয়া প্রমাণ করিতে সচেষ্ট। কিন্তু কেহ কেহ আবার নির্ভয়ে কৃতজ্ঞহৃদয়ে কোথা হইতে তাঁহারা ঐ-সকল তত্ত্ব পাইয়াছেন, তাহা উল্লেখ করিয়া বেদান্তের নিকট ঋণ স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।
বন্ধুগণ, আমেরিকায় আমি অদ্বৈতবাদই অধিক প্রচার করিতেছি, দ্বৈতবাদ প্রচার করিতেছি না—একবার এইরূপ অভিযোগ শুনিয়াছিলাম। দ্বৈতবাদের প্রেম ভক্তি ও উপাসনায় যে কি অসীম আনন্দ লাভ হয়, তাহা আমি জানি; উহার অপূর্ব মহিমা আমি সম্পূর্ণ অবগত। কিন্তু বন্ধুগণ, এখন আমাদের আনন্দে ক্রন্দন করিবারও সময় নাই। আমরা যথেষ্ট কাঁদিয়াছি। এখন আর আমাদের কোমলভাব অবলম্বন করিবার সময় নাই। এইরূপে কোমলতার সাধন করিতে করিতে আমরা এখন জীবন্মৃত হইয়া পড়িয়াছি—আমরা রাশীকৃত তুলার মত কোমল হইয়া পড়িয়াছি। আমাদের দেশের পক্ষে এখন প্রয়োজন—লৌহবৎ দৃঢ় মাংসপেশী ও ইস্পাতের মত স্নায়ু; এমন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি চাই, কেহই যেন উহাকে প্রতিরোধ করিতে সমর্থ না হয়, উহা যেন ব্রহ্মাণ্ডের সমুদয় রহস্যভেদে সমর্থ হয়—যদি-বা এই কার্যসাধনে সমুদ্রের অতল তলে যাইতে হয়, যদি-বা সর্বদা সর্বপ্রকার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হয়! ইহাই এখন আমাদের আবশ্যক; আর অদ্বৈতবাদের মহান্ আদর্শ ধারণা করিয়া উপলব্ধি করিতে পারিলেই ঐ ভাবের আবির্ভাব, প্রতিষ্ঠা ও দৃঢ়তাসাধন হইতে পারে।
বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস—নিজের উপর বিশ্বাস—ঈশ্বরে বিশ্বাস—ইহাই উন্নতিলাভের একমাত্র উপায়। তোমার যদি এদেশীয় পুরাণের তেত্রিশ কোটি দেবতার উপর এবং বৈদেশিকেরা মধ্যে মধ্যে যে-সকল দেবতার আমদানি করিয়াছে, তাহাদের সবগুলির উপরই বিশ্বাস থাকে, অথচ যদি তোমার আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে তোমার কখনই মুক্তি হইবে না। নিজের উপর বিশ্বাসসম্পন্ন হও—সেই বিশ্বাস-বলে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াও এবং বীর্যবান্ হও। ইহাই এখন আমাদের আবশ্যক। আমরা এই ত্রিশ কোটি লোক সহস্র বৎসর যাবৎ যে-কোন মুষ্টিমেয় বিদেশী আমাদের ভূলুণ্ঠিত দেহকে পদদলিত করিবার ইচ্ছা করিয়াছে, তাহাদেরই পদানত হইয়াছি, কেন? কারণ উহাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস ছিল—আমাদের ছিল না।