আমার বোধ হয়, ধর্মবিষয়ে পৃথক্ পৃথক্ জাতির প্রাধান্যলাভের চেষ্টা ভারতের সীমান্ত-প্রদেশেও ঘটিয়াছিল। এখানেও সম্ভবতঃ আর্যজাতির বিভিন্ন শাখা পরস্পরের পৃথক্ পৃথক্ দেবতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু বিধির বিধানে ভারতীয় ইতিহাস য়াহুদীদের ইতিহাসের মত হইল না। বিধাতা যেন অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ভারতকে পরধর্মে বিদ্বেষশূন্য ও ধর্মসাধনায় গরিষ্ঠ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। সেই কারণেই এখানে ঐ-সকল বিভিন্ন জাতি ও তাহাদের বিভিন্ন দেবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল স্থায়ী হইল না। সেই প্রাগৈতিহাসিক সুদূর অতীত যুগে—কিংবদন্তীও যে-যুগের ঘনান্ধকার ভেদ করিতে অসমর্থ, সেই অতি প্রাচীনকালে ভারতে একজন শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষের অভ্যুদয় হয়; জগতে এইরূপ মহাপুরুষের সংখ্যা অতি অল্প। এই মহাপুরুষ সেই প্রাচীনকালেই এই সত্য উপলব্ধি করিয়া প্রচার করেন, ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—পরম সত্যবস্তু এক, ঋষিগণ তাঁহাকে নানাভাবে বর্ণনা করেন। এইরূপ চিরস্মরণীয় বাণী আর কখনও উচ্চারিত হয় নাই, এইরূপ মহান্ সত্য আর কখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। আর এই সত্যই আমাদের হিন্দুর জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ডস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। শত শত শতাব্দী ধরিয়া এই তত্ত্ব—‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ ক্রমশঃ পরিস্ফুট হইয়া আমাদের সমগ্র জাতীয় জীবনকে ওতপ্রোতভাবে পরিব্যাপ্ত ও প্রভাবিত করিয়াছে, আমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়াছে, আমাদের জীবনের সহিত যেন সর্বাংশে একীভূত হইয়া গিয়াছে। আমরা ঐ মহত্তম সত্যটিকে সর্বতোভাবে ভালবাসি, তাই আমাদের দেশ—পরধর্মে দ্বেষরাহিত্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ মহিমময় ভূমি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এইখানে—কেবল এইখানেই লোকে তাহাদের ধর্মে ঘোরতর বিদ্বেষসম্পন্ন অপর ধর্মাবলম্বীর জন্যও মন্দির-গির্জাদি নির্মাণ করিয়া দেয়। পৃথিবীর লোককে আমাদের নিকট এই পরধর্মে সহিষ্ণুতা-রূপ মহতী শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে।
আমাদের দেশের বাহিরে এখনও কি ভয়ানক পরধর্ম-বিদ্বেষ রহিয়াছে, তাহা আপনারা কিছুই জানেন না। পরধর্ম-বিদ্বেষ অনেক স্থানে এরূপ প্রবল যে, অনেক সময় মনে হইয়াছে, আমাকে হয়তো বিদেশে হাড়-কখানা রাখিয়া যাইতে হইবে। ধর্মের জন্য একজনকে মারিয়া ফেলা এত তুচ্ছ কথা যে, আজ না হউক, কালই এই মহাদৃপ্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে এরূপ ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইতে পারে। পাশ্চাত্যদেশে কেহ প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহস করিলে তাহাকে সমাজচ্যুতি ও তাহার আনুষঙ্গিক যত প্রকার গুরুতর নির্যাতন সবই সহ্য করিতে হয়। আপনারাও যদি আমার মত পাশ্চাত্যদেশে গিয়া কিছুদিন বাস করেন, তবে জানিতে পারিবেন যে, এখানে পাশ্চাত্যের লোকেরা খুব সহজে স্বচ্ছন্দে আমাদের জাতিভেদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলিয়া থাকে, কিন্তু সেখানকার বড় বড় অধ্যাপকেরা পর্যন্ত—যাঁহাদের কথা আপনারা এখানে খুব শুনিতে পান, তাঁহারাও অত্যন্ত ভীরু; এবং ধর্মসম্বন্ধে তাঁহারা যাহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করেন, সাধারণের সমালোচনার ভয়ে তাহার শতাংশের একাংশও মুখ ফুটিয়া বলিতে সাহস করেন না।
এই কারণেই পৃথিবীকে এই পরধর্মসহিষ্ণুতারূপ মহান্ সত্য শিক্ষা করিতে হইবে। আধুনিক সভ্যতার ভিতরে এই ভাব প্রবেশ করিলে বিশেষ কল্যাণ হইবে। বাস্তবিকই এই ভাবে ভাবিত না হইলে কোন সভ্যতাই অধিক দিন স্থায়ী হইতে পারে না। গোঁড়ামি, রক্তপাত, পাশব অত্যাচার—যতদিন না এগুলি বন্ধ হয়, ততদিন সভ্যতার বিকাশই হইতে পারে না; যতদিন না আমরা পরস্পরের প্রতি মৈত্রীসম্পন্ন হই, ততদিন কোনরূপ সভ্যতাই মাথা তুলিতে পারে না; আর এই মৈত্রীভাব-বিকাশের প্রথম সোপান—পরস্পরের ধর্মবিশ্বাসের উপর সহানুভূতি প্রকাশ করা। শুধু তাহাই নহে, প্রকৃতপক্ষে এই ভাব হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে মুদ্রিত করিতে হইলে পরস্পরের প্রতি শুধু মৈত্রীভাবাপন্ন হইলেই চলিবে না—পরস্পরের ধর্মমত ও বিশ্বাস যতই পৃথক্ হউক না কেন, পরস্পরকে সকল বিষয়ে বিশেষভাবে সাহায্য করিতে হইবে। আমরা ভারতে ঠিক তাহাই করিয়া থাকি, এইমাত্র আপনাদিগকে আমি সে-কথা বলিয়াছি। এই ভারতেই কেবল হিন্দুরা খ্রীষ্টানদের জন্য চার্চ ও মুসলমানদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে। এইরূপই করিতে হইবে। তাহারা আমাদিগকে যতই ঘৃণা করুক, তাহারা যতই পাশব ভাব প্রকাশ করুক, তাহারা যতই নিষ্ঠুর হউক ও অত্যাচার করুক—তাহারা সচরাচর যেমন করিয়া থাকে, সেইরূপ আমাদের প্রতি যতই কুৎসিত ভাষার প্রয়োগ করুক, আমরা ঐ খ্রীষ্টানদের জন্য গির্জা ও মুসলমানদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করিতে বিরত হইব না, যতদিন পর্যন্ত না প্রেমবলে উহাদিগকে জয় করিতে পারি; যতদিন পর্যন্ত না আমরা জগতের সমক্ষে প্রমাণ করিতে পারি যে, ঘৃণা ও বিদ্বেষপরায়ণ জাতি কখনও দীর্ঘ জীবন লাভ করিতে পারে না—ভালবাসার বলেই জাতীয় জীবন স্থায়ী হইতে পারে, কেবল পশুত্ব ও শারীরিক শক্তি কখনও জয়লাভ করিতে পারে না, শান্ত স্বভাবই জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়, সফল হয়।
পৃথিবীকে, ইওরোপ ও সমগ্র জগতের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে আমাদের আর একটি মহৎ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে হইবে। সমগ্র জগতের আধ্যাত্মিক একত্বরূপ এই সনাতন মহৎ তত্ত্ব— সম্ভবতঃ উচ্চজাতি অপেক্ষা নিম্নজাতির, শিক্ষিত ব্যক্তিগণ অপেক্ষা অজ্ঞ জনসাধারণের, বলবান্ অপেক্ষা দুর্বলের পক্ষেই বেশী প্রয়োজনীয়।