আজকাল লোকে ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ (Survival of the fittest)-রূপ নূতন মতবাদ লইয়া অনেক কথা বলিয়া থাকে। তাহারা মনে করে—যাহার গায়ের জোর যত বেশী, সেই তত অধিক দিন জীবিত থাকিবে। যদি তাহাই সত্য হইত, তবে প্রাচীনকালের যে-সকল জাতি কেবল অন্যান্য জাতির সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহে কাটাইয়াছে, তাহারাই মহাগৌরবের সহিত আজও জীবিত থাকিত এবং এই দুর্বল হিন্দুজাতি, যাহারা কখনও অপর একটি জাতিকে জয় করে নাই, তাহারা এতদিনে বিনষ্ট হইয়া যাইত। জনৈকা ইংরেজ মহিলা আমাকে এক সময় বলেন, হিন্দুরা কি করিয়াছে? তাহারা কোন একটা জাতিকেও জয় করিতে পারে নাই! পরন্তু এই জাতি এখনও ত্রিশকোটি প্রাণী লইয়া সদর্পে জীবিত রহিয়াছে! আর ইহা সত্য নহে যে, উহার সমুদয় শক্তি নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে; ইহাও সত্য নহে যে, এই জাতির শরীর পুষ্টির অভাবে ক্ষয় পাইতেছে। এই জাতির এখনও যথেষ্ট জীবনীশক্তি রহিয়াছে। যখনই উপযুক্ত সময় আসে, যখনই প্রয়োজন হয়, তখনই এই জীবনীশক্তি মহাবন্যার মত পৃথিবীকে প্লাবিত করে।
আমরা যেন অতি প্রাচীনকাল হইতে সমগ্র পৃথিবীকে এক মহাসমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান করিয়াছি। পাশ্চাত্যদেশে সকলে চেষ্টা করিতেছে—কিরূপে তাহারা জগতের সর্বাপেক্ষা অধিক দ্রব্যসামগ্রীর অধিকারী হইবে; আমরা কিন্তু এখানে আর এক সমস্যার মীমাংসায় নিযুক্ত—কত অল্প জিনিষ লইয়া জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায়। উভয় জাতির মধ্যে এই সংঘর্ষ ও প্রভেদ এখনও কয়েক শতাব্দী ধরিয়া চলিবে। কিন্তু ইতিহাসে যদি কিছুমাত্র সত্য থাকে, যদি বর্তমান লক্ষণসমূহ দেখিয়া ভবিষ্যৎ অনুমান করা বিন্দুমাত্র সম্ভব হয়, তবে বলা যায়, যাহারা স্বল্পের মধ্যে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে ও কঠোর আত্মসংযম অভ্যাস করিতে চেষ্টা করে, তাহারাই পরিণামে জয়ী হইবে; আর যাহারা ভোগসুখ ও বিলাসের দিকেই ধাবমান, তাহারা আপাততঃ যতই তেজস্বী ও বীর্যবান বলিয়া প্রতীয়মান হউক না কেন, পরিণামে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইবে।
মনুষ্যজীবনে, এমন কি জাতীয় জীবনেও সময়ে সময়ে সংসারের উপর বিতৃষ্ণা অত্যন্ত প্রবল হয়। বোধ হয় সমগ্র পাশ্চাত্যদেশে এইরূপ একটা সংসার-বিরক্তির ভাব আসিয়াছে। পাশ্চাত্যদেশের বড় বড় মনীষিগণ ইতোমধ্যেই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ঐশ্বর্য-সম্পদের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা—সবই বৃথা। সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষিত নরনারীই তাঁহাদের বাণিজ্য-প্রধান সভ্যতার এই প্রতিযোগিতায়, এই সংঘর্ষে, এই পাশব ভাবে অতিশয় বিরক্ত হইয়া পড়িয়াছেন; তাঁহারা আশা করিতেছেন—এই অবস্থা পরিবর্তিত হইবে এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত অবস্থা আসিতেছে। এক শ্রেণীর লোক আছেন, যাঁহাদের এখনও দৃঢ় ধারণা—রাজনীতিক ও সামাজিক পরিবর্তনই ইওরোপের সমুদয় অশুভ-প্রতিকারের একমাত্র উপায়। কিন্তু ঐ দেশে বড় বড় মনীষীদের মধ্যে অন্য এক আদর্শ বিকাশ লাভ করিতেছে; তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন, রাজনীতিক বা সামাজিক পরিবর্তন যতই হউক না কেন, মনুষ্যজীবনের দুঃখ-কষ্ট কিছুতেই দূর হইবে না। কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতিবিধান করিতে পারিলেই সর্বপ্রকার দুঃখকষ্ট ঘুচিবে। যতই শক্তিপ্রয়োগ শাসনপ্রণালীর পরিবর্তন ও আইনের কড়াকড়ি কর না কেন, তাহাতে কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তিত হয় না। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষাই অসৎ প্রবৃত্তি পরিবর্তিত করিয়া জাতিকে সৎপথে চালিত করিতে পারে। এই কারণেই পাশ্চাত্য জাতিগুলি কিছু নূতন ভাব—কোন নূতন দর্শনের জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িয়াছে। তাঁহারা যে-ধর্ম মানেন, সেই খ্রীষ্টধর্ম অনেক বিষয়ে মহৎ ও সুন্দর হইলেও উহার মর্ম তাঁহারা ভাল করিয়া বোঝেন নাই। আর এতদিন তাঁহারা খ্রীষ্টধর্মকে যেভাবে বুঝিয়া আসিতেছিলেন, তাহা আর তাঁহাদের নিকট পর্যাপ্ত বোধ হইতেছে না। পাশ্চাত্যদেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আমাদের প্রাচীন দর্শনসমূহে, বিশেষতঃ বেদান্তেই—এতদিন তাঁহারা যাহা খুঁজিতেছেন—সেই চিন্তাপ্রবাহ, সেই আধ্যাত্মিক খাদ্যপানীয়ের সন্ধান পাইতেছেন। আর ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই।
জগতের যতপ্রকার ধর্ম আছে, সেগুলির প্রত্যেকটির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের জন্য সেই সেই ধর্মাবলম্বিগণ নানাবিধ অপূর্ব যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া থাকেন। সে-সব শুনিয়া শুনিয়া অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। অতি অল্প দিনের কথা, আমার বিশেস বন্ধু ব্যারোজ সাহেব—‘খ্রীষ্টধর্মই যে একমাত্র সার্বভৌম ধর্ম’ ইহা প্রমাণ করিতে বিশেষ চেষ্টা করেন, আপনারা তাহা নিশ্চয়ই শুনিয়াছেন। এখন বাস্তবিক সার্বভৌম ধর্ম কোন্টি হইতে পারে, তাহা বিচার করিয়া দেখা যাক।
আমার ধারণা, বেদান্ত—কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হইতে পারে, আর কোন ধর্মই নয়। আমি আপনাদের নিকট আমার এই বিশ্বাসের যুক্তিপরম্পরা উপস্থাপিত করিব। আমাদের ধর্ম ব্যতীত পৃথিবীর প্রধান প্রধান প্রায় সকল ধর্মই তাহাদের নিজ নিজ প্রবর্তক মহাপুরুষের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেই-সকল ধর্মের মত, শিক্ষা, নীতিতত্ত্ব প্রভৃতি সেই সেই মহাপুরুষের জীবনের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই সেই মতাদির প্রামাণ্য, তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই সেইগুলি সত্য, তাঁহাদের বাক্য বলিয়াই ঐ উপদেশগুলি লোকের মনে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। আর আশ্চর্যের বিষয়, ধর্মপ্রবর্তকদের ঐতিহাসিকতার উপরই যেন সেই-সকল ধর্মের সব-কিছুর ভিত্তি স্থাপিত। যদি তাঁহাদের জীবনের ঐতিহাসিকতায় কিছুমাত্র আঘাত করা যায়, যদি তাঁহাদের তথাকথিত ঐতিহাসিকতার ভিত্তি একবার ভাঙিয়া দেওয়া যায়, তবে সমুদয় ধর্ম-প্রাসাদটিই একেবারে বিধ্বস্ত হইয়া পড়িবে—পুনরুদ্ধারের আর কোন সম্ভাবনা থাকিবে না। বাস্তবিক বর্তমানকালে তথাকথিত প্রায় সকল ধর্মপ্রবর্তকের জীবন সম্বন্ধে তাহাই ঘটিতেছে। আমরা জানি, তাঁহাদের জীবনের অর্ধেক ঘটনা লোকে ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে না, আর বাকী অর্ধেকও সন্দেহ করে। আমাদের ধর্ম ব্যতীত জগতের অন্যান্য সকল বড় বড় ধর্মই এইরূপ ঐতিহাসিক জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত; আমাদের ধর্ম কিন্তু কতকগুলি তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। কোন পুরুষ বা নারী নিজেকে বেদের প্রণেতা বলিয়া দাবী করিতে পারেন না। বেদে সনাতন তত্ত্বসমূহ লিপিবদ্ধ হইয়াছে—ঋষিগণ উহার আবিষ্কর্তা মাত্র। স্থানে স্থানে এই ঋষিগণের নামের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু সেগুলি নামমাত্র। তাঁহারা কে ছিলেন, কি করিতেন, তাহাও আমরা জানি না। অনেক স্থলে তাঁহাদের পিতা কে ছিলেন, তাহাও জানা যায় না; আর প্রায় সকলেরই জন্মস্থান ও জন্মকাল আমাদের অজ্ঞাত। বাস্তবিক এই ঋষিগণ নামের আকাঙ্ক্ষা করিতেন না; তাঁহারা সনাতন তত্ত্বসমূহের প্রচারক ছিলেন এবং নিজেরা জীবনে সেই-সকল তত্ত্ব উপলব্ধি করিয়া আদর্শ জীবন যাপন করিবার চেষ্টা করিতেন।