জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি ধর্ম হওয়া উচিত, না রাজনীতি—এ বিষয়ে এখন আমি বিচার করিতে চাই না; তবে ইহা স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, ভালই হউক, আর মন্দই হউক, ধর্মেই আমাদের জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি স্থাপিত। তুমি কখনও ইহা পরিবর্তন করিতে পার না, একটা জিনিষ নষ্ট করিয়া তাহার বদলে অপর জিনিষ বসাইতে পার না। একটি বৃহৎ বৃক্ষকে এক স্থান হইতে উপড়াইয়া অন্য স্থানে পুঁতিয়া দিলে উহা যে সেখানে জীবিত থাকিবে, তাহা কখনই আশা করিতে পার না। ভালই হউক আর মন্দই হউক—সহস্র সহস্র বৎসর যাবৎ ভারতে ধর্মই জীবনের চরম আদর্শরূপে পরিগণিত হইতেছে; ভালই হউক আর মন্দই হউক—শত শত শতাব্দী ধরিয়া ভারতের পরিবেশ ধর্মের মহান্ আদর্শে পূর্ণ রহিয়াছে; ভালই হউক আর মন্দই হউক—ধর্মের এই-সকল আদর্শের মধ্যেই আমরা পরিবর্ধিত হইয়াছি; এখন ঐ ধর্মভাব আমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া গিয়াছে—আমাদের শিরায় শিরায় প্রতি রক্তবিন্দুর সহিত প্রবাহিত হইতেছে, আমাদের প্রকৃতিগত হইয়া গিয়াছে, আমাদের জীবনীশক্তি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সহস্র বৎসর যাবৎ যে-মহানদী নিজের খাত রচনা করিয়াছে, তাহাকে না বুজাইয়া, মহাশক্তি প্রয়োগ না করিয়া তোমরা কি সেই ধর্ম পরিত্যাগ করিতে পার? তোমরা কি গঙ্গাকে তাহার উৎপত্তিস্থান হিমালয়ে ঠেলিয়া লইয়া গিয়া আবার নূতন খাতে প্রবাহিত করিতে ইচ্ছা কর? ইহাও যদি সম্ভব হয়, তথাপি এই দেশের পক্ষে তাহার জাতিগত বৈশিষ্ট্য—ধর্মজীবন পরিত্যাগ করিয়া রাজনীতি বা অপর কিছুকে জাতীয় জীবনের মূলভিত্তিরূপে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। স্বল্পতম বাধার পথেই তোমরা কাজ করিতে পার; ধর্মই ভারতের পক্ষে সেই স্বল্পতম বাধার পথ। এই ধর্মপথ অনুসরণ করাই ভারতীয় জীবনধারা, ভারতের উন্নতি ও কল্যাণের একমাত্র উপায়।
অন্যান্য দেশে পাঁচ রকম প্রয়োজনীয় জিনিষের মধ্যে ধর্ম একটি। একটি উদাহরণ দিই। আমি সচরাচর এই দৃষ্টান্তটি দিয়া থাকি—অমুক সম্ভ্রান্ত মহিলার ঘরে নানা জিনিষ আছে; এখানকার ফ্যাশন—একটি জাপানী পাত্র (Vase) ঘরে রাখা, না রাখিলে ভাল দেখায় না, সুতরাং তাঁহাকে একটা জাপানী পাত্র রাখিতেই হইবে। এইরূপ আমাদের কর্তার বা গিন্নীর অনেক কাজ, তার মধ্যে একটু ধর্মও চাই—তবেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হইল। এই কারণেই তাঁহাদের একটু-আধটু ‘ধর্ম’ করা চাই। জগতের অধিকাংশ লোকের জীবনের উদ্দেশ্য—রাজনীতিক বা সামাজিক উন্নতির চেষ্টা, এক কথায় সংসার। তাহাদের নিকট ঈশ্বর ও ধর্মের প্রয়োজন সংসারেরই একটু সুখবিধানের জন্য—তাহাদের নিকট ঈশ্বরের প্রয়োজন শুধু এইটুকু। তোমরা কি শোন নাই, গত দুই শত বৎসর যাবৎ কতকগুলি অজ্ঞ অথচ পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তির মুখে ভারতীয় ধর্মের বিরুদ্ধে একমাত্র এই অভিযোগ শোনা যাইতেছে যে, এই ধর্ম দ্বারা সাংসারিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য-লাভের সুবিধা হয় না, ‘কাঞ্চন’ লাভ হয় না, উহা সমগ্র জাতিকে দস্যুতে পরিণত করে না, বলবান্কে গরীবের ঘাড়ে পড়িয়া তাহার রক্তপান করিতে সাহায্য করে না! সত্যই, আমাদের ধর্ম এরূপ করে না। ইহাতে অন্যান্য জাতির সর্বস্ব লুণ্ঠন ও সর্বনাশ করিবার জন্য পদভরে ভূকম্পকারী সৈন্যপ্রেরণের ব্যবস্থা নাই। অতএব তাঁহারা বলেন—এ ধর্মে আছে কি? উহা চলতি কলে শস্য যোগাইয়া কাজ আদায় করিতে জানে না, অথবা উহা দ্বারা পেশীর শক্তি বর্ধিত হয় না। তবে এ ধর্মে আছে কি? তাহারা স্বপ্নেও ভাবে না যে, ঐ যুক্তির দ্বারাই আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আমাদের ধর্মে সাংসারিক সুখ হয় না, সুতরাং আমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, কারণ আমাদের ধর্ম এই দু-তিন দিনের ক্ষুদ্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে না। এই স্বল্প- বিস্তৃত ক্ষুদ্র পৃথিবীতেই আমাদের ধর্মের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নহে। আমাদের ধর্ম এই জগতের সীমার বাহিরে—দূরে, অতি দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে; সেই রাজ্য অতীন্দ্রিয়—সেখানে দেশ নাই, কাল নাই, সংসারের কোলাহল হইতে দূরে, অতি দূরে—সেখানে আর সংসারের সুখ-দুঃখ স্পর্শ করিতে পারে না, সমগ্র জগৎই সেই মহিমময় ভূমা আত্মা-রূপ মহাসমুদ্রে বিন্দুতুল্য হইয়া যায়। আমাদের ধর্মই সত্য ধর্ম, কারণ ইহা ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’—এই উপদেশ দিয়া থাকে; আমাদের ধর্ম বলে—‘কাঞ্চন লোষ্ট্র বা ধূলির তুল্য’; তোমরা যতই ক্ষমতা লাভ কর না কেন, সবই ক্ষণিক, এমন কি, জীবনধারণই অনেক সময় বিড়ম্বনামাত্র; এই জন্যই আমাদের ধর্ম সত্য। আমাদের ধর্মই সত্য ধর্ম—কারণ সর্বোপরি ইহা ত্যাগ শিক্ষা দেয়। শত শত যুগের সঞ্চিত জ্ঞানবলে দণ্ডায়মান হইয়া এই সত্যধর্ম আমাদের মহাজ্ঞানী প্রাচীন পূর্বপুরুষগণের তুলনায় যাহারা সেদিনের শিশুমাত্র, সেই-সকল জাতির নিকট সুদৃঢ় অথচ ষ্পষ্ট ভাষায় বলিতে থাকেঃ বালক! তুমি ইন্দ্রিয়ের দাস; কিন্তু ইন্দ্রিয়ের ভোগ অস্থায়ী—বিনাশই উহার পরিণাম। এই তিনদিনের ক্ষণস্থায়ী বিলাসের ফল—সর্বনাশ। অতএব ইন্দ্রিয়সুখের বাসনা ত্যাগ কর—ইহাই ধর্মলাভের উপায়। ত্যাগই আমাদের চরম লক্ষ্য, মুক্তির সোপান—ভোগ আমাদের লক্ষ্য নহে। এই জন্য আমাদের ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম। বিস্ময়ের বিষয়, এক জাতির পর আর এক জাতি সংসার-রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হইয়া কয়েক মুহূর্ত পরাক্রমের সহিত নিজ নিজ অংশ অভিনয় করিয়াছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই তাহাদের মৃত্যু ঘটিয়াছে! কালসমুদ্রে তাহারা একটি ক্ষুদ্র তরঙ্গও সৃষ্টি করিতে পারে নাই—নিজেদের কিছু চিহ্ন পর্যন্ত রাখিয়া যাইতে পারে নাই। আমরা কিন্তু অনন্তকাল কাক-ভূশণ্ডীর মত বাঁচিয়া আছি—আমাদের যে কখন মৃত্যু হইবে, তাহার লক্ষণও দেখা যাইতেছে না।