এইরূপে আমাদিগকে এই উভয় বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করিতে হইবে; আমি আশা করি, আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেরই একদিকে যেমন উদার ভাব—হৃদয়ের প্রসারতা আসিবে, অপর দিকে তেমন দৃঢ় নিষ্ঠা ও বিশ্বাস থাকিবে; তাহা হইলে তোমরা আমার কথার মর্ম বুঝিবে—বুঝিবে আমার উদ্দেশ্য সকলকেই আপনার করিয়া লওয়া, কাহাকেও বর্জন করা নয়। আমি চাই গোঁড়ার নিষ্ঠাটুকু ও তাহার সহিত জড়বাদীর উদার ভাব। হৃদয় সমুদ্রবৎ গভীর অথচ আকাশবৎ প্রশস্ত হওয়া চাই। আমাদিগকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নতিশীল জাতির মত উন্নত হইতে হইবে, আবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবহমান কালের সঞ্চিত সংস্কারসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবান্ হইতে হইবে; আর হিন্দুই কেবল প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন প্রথাগুলিকে সম্মান করিতে জানে। সহজ কথা বলি—সর্ব ব্যাপারই আমাদিগকে মুখ্য ও গৌণ বিষয়ের বিভিন্নতা কোথায়, তাহা শিখিতে হইবে। মুখ্য তত্ত্বগুলি সর্বকালের জন্য, আর গৌণ বিষয়গুলি কোন বিশেষ সময়ের উপযোগী মাত্র। যদি যথাসময়ে সেইগুলির পরিবর্তে অন্য প্রথা প্রবর্তিত না হয়, তবে সেগুলির দ্বারা নিশ্চয় অনিষ্ট ঘটিয়া থাকে। আমার এ কথা বলিবার উদ্দেশ্য ইহা নয় যে, তোমাদিগকে প্রাচীন আচারপদ্ধতিসমূহের নিন্দা করিতে হইবে। কখনই নহে, অতিশয় কুৎসিত আচারগুলিরও নিন্দা করিও না। নিন্দা কিছুরই করিও না; এখন যে প্রথাগুলিকে সাক্ষাৎসম্বন্ধে অনিষ্টকর বলিয়া বোধ হইতেছে, সেইগুলিই অতীত কালে প্রত্যক্ষভাবে জীবনপ্রদ ছিল। এখন যদি সেইগুলি উঠাইয়া দিতে হয়, তবে উঠাইয়া দিবার সময়ও সেইগুলির নিন্দা করিও না; বরং ঐগুলির দ্বারা আমাদের জাতীয় জীবনরক্ষারূপ যে মহৎ কার্য সাধিত হইয়াছে, সেজন্য ঐগুলির প্রশংসা কর—ঐগুলির প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
আর আমাদিগকে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে, কোন সেনাপতি বা রাজা কোনকালে আমাদের সমাজের নেতা ছিলেন না, ঋষিগণই চিরকাল আমাদের সমাজের নেতা। ঋষি কাহারা? তিনিই ঋষি, যিনি ধর্মকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, যাঁহার নিকট ধর্ম কেবল পুঁথিগত বিদ্যা, বাগবিতণ্ডা বা তর্কযুক্তি নহে—সাক্ষাৎ উপলব্ধি অতীন্দ্রিয় সত্যের সাক্ষাৎকার। উপনিষদ্ বলিয়াছেন, এরূপ ব্যক্তি সাধারণ মানবতুল্য নহেন, তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা। তিনি ঋষিত্ব। আর এই ঋষিত্বলাভ কোন দেশ কাল জাতি বা সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে না। বাৎস্যায়ন ঋষি বলিয়াছেন—‘সত্যের সাক্ষাৎকার করিতে হইবে’; আর আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, তোমাকে আমাকে—আমাদের সকলকেই ঋষি হইতে হইবে, অগাধ আত্মবিশ্বাস-সম্পন্ন হইতে হইবে; আমরাই সমগ্র জগতে শক্তিসঞ্চার করিব। কারণ সব শক্তি আমাদের ভিতরে রহিয়াছে। আমাদিগকে ধর্ম প্রত্যক্ষ করিতে হইবে—উপলব্ধি করিতে হইবে; তবেই ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের সকল সন্দেহ দূরীভূত হইবে; তখনই ঋষিত্বের উজ্জ্বল জ্যোতিতে পূর্ণ হইয়া আমরা প্রত্যেকেই মহাপুরুষত্ব লাভ করিব। তখনই আমাদের মুখ হইতে যে বাণী নির্গত হইবে, তাহা অব্যর্থ অমোঘ ও শক্তিসম্পন্ন হইবে; তখনই আমাদের সম্মুখ হইতে যাহা কিছু মন্দ, তাহা আপনিই পলায়ন করিবে, আর কাহাকেও নিন্দা বা অভিসম্পাত করিতে হইবে না, অথবা কাহারও সহিত বিরোধ করিতে হইবে না। এখানে আজ যাঁহারা উপস্থিত আছেন, তাঁহাদের প্রত্যেককেই নিজের ও অপরের মুক্তির জন্য ঋষিত্ব লাভ করিতে শ্রীভগবান্ সাহায্য করুন।
০৯. কুম্ভকোণম্ বক্তৃতা
[মাদুরা হইতে ত্রিচিনপল্লী ও তাঞ্জোর হইয়া স্বামীজী কুম্ভকোণম্ আসেন। সেখানে অভিনন্দনের উত্তরে বেদান্ত সম্বন্ধে তিনি এক সুদীর্ঘ হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করেন। নিম্নে তাহার বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হইল।]
গীতাকার বলিয়াছেনঃ ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’—অল্পমাত্রও এই ধর্ম পালন করিলে অতি মহৎ ফল লাভ হয়। যদি এই বাক্য সমর্থনের জন্য কোন উদাহরণের আবশ্যক হয়, তবে আমি বলিতে পারি, আমার ক্ষুদ্র জীবনে প্রতিপদে এই মহাবাক্যের সত্যতা উপলব্ধি করিতেছি।
হে কুম্ভকোণম্ নিবাসী ভদ্রমহোদয়গণ, আমি অতি সামান্য কাজ করিয়াছি; কিন্তু কলম্বোয় নামিয়া অবধি এ পর্যন্ত যেখানেই গিয়াছি, সেখানেই যেরূপ আন্তরিক অভ্যর্থনা লাভ করিয়াছি, তাহা আমার স্বপ্নের অতীত। সেই সঙ্গে এ কথাও বলি যে, ইহা হিন্দুজাতির পূর্বাপর সংস্কার ও ভাবের উপযুক্তই হইয়াছে। কারণ ধর্মই হিন্দুজাতির প্রকৃত জীবনীশক্তি, ধর্মই তাহার মূলমন্ত্র।
আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যদেশে অনেক ঘুরিয়াছি, জগতের সম্বন্ধে আমার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। দেখিলাম—সকল জাতিরই এক-একটি প্রধান আদর্শ আছে, তাহাই সেই জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ। রাজনীতিই কোন কোন জাতির জীবনের মূলভিত্তি; কাহারও-বা সামাজিক উন্নতি, কাহারও-বা মানসিক উন্নতিবিধান, কাহারও-বা অন্য কিছু। কিন্তু আমাদের মাতৃভূমির জাতীয় জীবনের মূলভিত্তি ধর্ম—শুধু ধর্মই। উহাই আমাদের জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড, উহারই উপর আমাদের জীবনরূপ প্রাসাদের মূলভিত্তি স্থাপিত।
তোমাদের মধ্যে অনেকের স্মরণ থাকিতে পারে, মান্দ্রাজবাসীরা অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আমেরিকায় যে অভিনন্দন পাঠাইয়াছিলেন, তাহার উত্তরে আমি একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পাশ্চাত্যদেশের অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি অপেক্ষা ভারতের কৃষকগণ ধর্মবিষয়ে বেশী শিক্ষিত। আজ আমি সেই বিষয়ের বিশেষ প্রমাণ পাইতেছি, ঐ বিষয়ে এখন আমার আর কোন সন্দেহ নাই। এমন সময় ছিল, যখন ভারতের সাধারণ লোকের মধ্যে পৃথিবীর সংবাদ জানিবার এবং ঐ সংবাদ সংগ্রহ করিবার আগ্রহের অভাব দেখিয়া আমার দুঃখ হইত। এখন আমি উহার রহস্য বুঝিয়াছি। আমাদের দেশের লোকও সংবাদ- সংগ্রহে খুব উৎসুক, তবে অবশ্য যে-বিষয়ে তাহার বিশেষ অনুরাগ, সেই বিষয়ের সংবাদেই তাহার আগ্রহ; এ বিষয়ে বরং অন্যান্য যে-সকল দেশ আমি দেখিয়াছি বা পর্যটন করিয়াছি, সেখানকার সাধারণ লোক অপেক্ষা তাহাদের আগ্রহ আরও বেশী। আমাদের কৃষকগণকে ইওরোপের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক পরিবর্তনগুলির সংবাদ জিজ্ঞাসা কর, ইওরোপীয় সমাজে যে-সব গুরুতর পরিবর্তন হইতেছে, সেগুলির বিষয় জিজ্ঞাসা কর—তাহারা সে-সব কিছুই জানে না, জানিতেও চাহেও না। কিন্তু সিংহলেও—যে সিংহল ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন, ভারতের স্বার্থের সহিত যাহার বিশেষ সংস্রব নাই—দেখিলাম—সেখানকার কৃষকেরাও জানিয়াছে, আমেরিকায় ধর্মমহাসভা বসিয়াছিল, আর তাহাদেরই একজন সেখানে গিয়াছিল, এবং কিছুটা পরিমাণে কৃতকার্যও হইয়াছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে—যে-বিষয়ে তাহাদের মনের আগ্রহ, সেই বিষয়ে তাহারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগুলির মতই সংবাদ-সংগ্রহে উৎসুক। আর ধর্মই ভারতবাসীর একমাত্র প্রাণের বস্তু—আগ্রহের বস্তু।