পৃথিবীতে দুই প্রকার বিভিন্ন ভিত্তির উপর সামাজিক জীবন প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা হইয়াছেঃ এক—ধর্মভিত্তির উপর; আর এক—সামাজিক প্রয়োজনের উপর। একটির ভিত্তি— আধ্যাত্মিকতা, অপরটির—জড়বাদ; একটির ভিত্তি—অতীন্দ্রিয়বাদ, অপরটির—প্রত্যক্ষবাদ। একটি এই ক্ষুদ্র জড়জগতের সীমার বাহিরে দৃষ্টিপাত করে এবং এমন কি, অপরটির সহিত কোন সংস্রব না রাখিয়া কেবল আধ্যাত্মিক ভাব লইয়াই জীবন যাপন করিতে সাহসী হয়; অপরটি নিজের চতুষ্পার্শ্বে যাহা দেখিতে পায়, তাহার উপর জীবনের ভিত্তি স্থাপন করিয়াই তৃপ্ত; সে আশা করে, ইহারই উপর সারা জীবন দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করিতে পারিবে।
আশ্চর্যের বিষয়, কখনও কখনও অধ্যাত্মবাদ প্রবল হয়, তারপরই আবার জড়বাদ প্রাধান্য লাভ করে, যেন তরঙ্গের গতিতে একটির পর আর একটি আসিয়া থাকে! এক দেশেই আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকারের তরঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায়। এক সময়ে জড়বাদ পূর্ণপ্রতাপে রাজত্ব করিতে থাকে—দেশ ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ হয়; যে-শিক্ষায় অধিক অন্নাগমের উপায় হয়, যাহাতে অধিক সুখলাভের উপায় হয়, তাহারই আদর হইতে থাকে। ক্রমে এই অবস্থা হইতে আবার অবনতি আরম্ভ হয়। সৈভাগ্যসম্পদ হইলেই মানবজাতির অন্তর্নিহিত ঈর্ষাদ্বেষও প্রবল আকার ধারণ করে—পরস্পর প্রতিযোগিতা ও ঘোর নিষ্ঠুরতাই যেন তখন যুগধর্ম হইয়া পড়ে। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’—এই প্রকার স্বার্থপরতাই তখন মূলমন্ত্র হইয়া পড়ে। এই অবস্থা কিছুদিন চলিবার পর মানুষ চিন্তা করিতে থাকে—জীবনের সমগ্র পরিকল্পনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত। ধর্ম সহায় না হইলে, জড়বাদের গভীর আবর্তে ক্রমশঃ মজ্জমান পৃথিবীর সাহায্যে ধর্ম অগ্রসর না হইলে, জড়বাদের গভীর আর্বতে ক্রমশঃ মজ্জমান পৃথিবীর সাহায্যে ধর্ম অগ্রসর না হইলে ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। তখন মানুষ নূতন আশায় সঞ্জীবিত হইয়া নব অনুরাগে নূতনভাবে নূতন গৃহ প্রস্তুত করিবার জন্য নূতন ভিত্তির পত্তন করে। তখন ধর্মের আর এক বন্যা আসে। কালে আবার উহারও অবনতি হয়।
প্রকৃতির অব্যর্থ নিয়মে ধর্মের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এমন একদল লোকের অভ্যুদয় হয়, যাহার পার্থিব ব্যাপারে বিশেষ ক্ষমতার একচেটিয়া দাবী করে। ইহার অব্যবহিত ফল—পুনরায় জড়বাদের দিকে প্রতিক্রিয়া। জড়বাদের দিকে গতি একবার আরম্ভ হইলে শত শত বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার একচেটিয়া দাবী আরম্ভ হয়। ক্রমশঃ এমন সময় আসে, যখন সমগ্র জাতির শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষমতাগুলি নয়, সর্বপ্রকার লৌকিক ক্ষমতা ও অধিকারগুলি অল্পসংখ্যক কয়েকটি ব্যক্তির করায়ত্ত হয়। এই অল্পসংখ্যক লোক সর্বসাধারণের ঘাড়ে চড়িয়া তাহাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। তখন সমাজকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হয়। এই সময় জড়বাদ দ্বারাও বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে।
যদি আপনারা আমাদের মাতৃভূমি ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, দেখিবেন—এখানে এখন সেইরূপ ঘটিতেছে। ইওরোপে আপনাদের জাতীয় উত্তরাধিকার ধর্ম প্রচার করিতে একজন গিয়াছিলেন; সেইজন্যই আজ আপনারা এখানে সমবেত হইয়াছেন। ইহা অসম্ভব হইত, যদি না ইওরোপীয় জড়বাদ ইহার পথ করিয়া দিত। সুতরাং এক হিসাবে জড়বাদ যথার্থই ভারতের কিছু কল্যাণ সাধন করিয়াছে, উহা সকলেরই উন্নতির দ্বার খুলিয়া দিয়াছে, উচ্চ বর্ণের একচেটিয়া অধিকার দূর করিয়া দিয়াছে; অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তির নিকট যে- অমূল্য রত্ন গুপ্তভাবে ছিল এবং যাহার ব্যবহার তাহারা নিজেরাও ভুলিয়া গিয়াছিল, জড়বাদ তাহা সর্বসাধারণের নিকট উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে। ঐ অমূল্য রত্নের অর্ধভাগ নষ্ট হইয়া গিয়াছে, অপরার্ধ এমন সব লোকের হাতে আছে, যাহারা গরুর জাবের পাত্রে শয়ান সেই কুকুরের মত—নিজেরাও খাইবে না, অপরকেও খাইতে দিবে না!
অপর দিকে আবার আমরা ভারতে যে-সকল রাজনীতিক অধিকার লাভের চেষ্টা করিতেছি, সেগুলি ইওরোপে যুগ যুগ ধরিয়া রহিয়াছে, শত শতাব্দী ধরিয়া ঐগুলি পরীক্ষিত হইয়াছে; আর সেগুলি যে সামাজিক প্রয়োজন-সাধনে অসমর্থ, তাহাও প্রতিপন্ন হইয়াছে। ইওরোপের রাজনীতিক প্রশাসনিক পদ্ধতিগুলি এক এক করিয়া অনুপযোগী বলিয়া নিন্দিত হইয়াছে, আর এখন ইওরোপ অশান্তি-সাগরে ভাসিতেছে—কি করিবে, কোথায় যাইবে, বুঝিতে পারিতেছে না। ঐহিক ব্যাপারে অত্যাচার প্রচণ্ড হইয়া দাঁড়াইয়াছে। দেশের সব ধন, সব ক্ষমতা অল্পসংখ্যক কয়েকটি লোকের হাতে; তাহারা নিজেরা কোন কাজ করে না, কিন্তু লক্ষ লক্ষ নরনারী দ্বারা কাজ করাইয়া লইবার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতাবলে তাহারা সমগ্র পৃথিবী রক্তস্রোতে প্লাবিত করিতে পারে। ধর্ম ও অন্যান্য যাহা কিছু, সবই তাহাদের পদতলে। তাহারাই সর্বেসর্বা শাসনকর্তা। পাশ্চাত্য জগৎ মুষ্টিমেয় ‘শাইলক’-এর শাসনে পরিচালিত হইতেছে। আপনারা যে প্রণালীবদ্ধ শাসন, স্বাধীনতা, পার্লামেণ্ট-মহাসভা প্রভৃতির কথা শোনেন—সেগুলি বাজে কথামাত্র। পাশ্চাত্য দেশ শাইলকগণের অত্যাচারে আর্তনাদ করিতেছে; প্রাচ্যদেশ আবার পুরোহিতদের অত্যাচারে কাতরভাবে ক্রন্দন করিতেছে। ধনী ও পুরোহিত পরস্পরকে শাসনে রাখিবে।
মনে করিবেন না, ইহাদের মধ্যে মাত্র একটি দ্বারা জগতের কল্যাণ হইবে। নিরপেক্ষ ঈশ্বর তাঁহার সৃষ্টিতে সকলকেই সমান করিয়াছেন। অতি অধম অসুরপ্রকৃতি মানুষেরও এমন কিছু গুণ আছে, যাহা একজন বড় সাধুর নাই। নগণ্য কীটেরও এমন কিছু গুণ থাকিতে পারে, যাহা হয়তো মহাপুরুষের নাই।