অতএব হে বন্ধুগণ, ইহাই আমাদের জাতীয় উন্নতির পথ—আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষগণের নিকট হইতে আমরা যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছি, প্রাণপণে তাহা ধরিয়া থাকাই আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। তোমরা কি এমন দেশের কথা শুনিয়াছ, যে দেশের বড় বড় রাজারা নিজদিগকে প্রাচীন রাজগণের অথবা পুরাতন-দুর্গনিবাসী, পথিকদের সর্বস্বলুণ্ঠনকারী দস্যুব্যারনগণের বংশধর বলিয়া পরিচয় দিবার পরিবর্তে অরণ্যবাসী অর্ধনগ্ন মুনিঋষির বংশধর বলিয়া পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করেন?তোমরা কি এমন দেশের কথা শুনিয়াছ? যদি না শুনিয়া থাক, শোন—আমাদের মাতৃভূমিই সেই দেশ। অন্যান্য দেশে বড় বড় ধর্মাচার্যগণও নিজেদের কোন প্রাচীন রাজার বংশধর বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন, আর এখানে বড় বড় রাজারা নিজেদের কোন প্রাচীন ঋষির বংশধর বলিয়া প্রমাণ করিতে সচেষ্ট। এই কারণেই আমি বলিতেছি, তোমরা ধর্মে বিশ্বাস কর বা নাই কর, যদি জাতীয় জীবনকে অব্যাহত রাখিতে চাও, তবে তোমাদিগকে এই ধর্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হইবে। এক হস্তে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে ধরিয়া অপর হস্ত প্রসারিত করিয়া অন্যান্য জাতির নিকট যাহা শিখিবার, তাহা শিখিয়া লও; কিন্তু মনে রাখিও যে, সেইগুলিকে হিন্দুজীবনের সেই মূল আদর্শের অনুগত রাখিতে হইবে, তবেই ভবিষ্যৎ ভারত অপূর্বমহিমামণ্ডিত হইয়া আবির্ভূত হইবে। আমার দৃঢ় ধারণা—শীঘ্রই সে শুভদিন আসিতেছে; আমার বিশ্বাস—ভারত শীঘ্রই অভূতপূর্ব শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হইবে। প্রাচীন ঋষিগণ অপেক্ষা মহত্তর ঋষিগণের অভ্যুদয় হইবে, আর তোমাদের পূর্বপুরুষগণ তাঁহাদের বংশধরদের এই অপূর্ব অভ্যুদয়ে শুধু যে সন্তুষ্ট হইবেন তাহা নহে, আমি বলিতেছি—নিশ্চয় তাঁহারা পরলোকে নিজ নিজ স্থান হইতে তাঁহাদের বংশধরগণের এরূপ মহিমা, এরূপ মহত্ত্ব দেখিয়া নিজদিগকে অত্যন্ত গৌরবান্বিত মনে করিবেন।
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, আমাদের সকলকেই এখন কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে, এখন ঘুমাইবার সময় নয়। আমাদের কার্যকলাপের উপরই ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করিতেছে। ঐ দেখ, ভারতমাতা ধীরে ধীরে নয়ন উন্মীলন করিতেছেন। তিনি কিছুকাল নিদ্রিত ছিলেন মাত্র। উঠ, তাঁহাকে জাগাও—আর নূতন জাগরণে নূতন প্রাণে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গৌরবমণ্ডিতা করিয়া ভক্তিভাবে তাঁহাকে তাঁহার শাশ্বত সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কর।
যিনি শৈবদের শিব, বৈষ্ণবদের বিষ্ণু, কর্মীদের কর্ম, বৌদ্ধদের বুদ্ধ, জৈনদের জিন, ঈশাহী ও য়াহুদীদের য়াভে, মুসলমানদের আল্লা, বৈদান্তিকদের ব্রহ্ম—যিনি সকল ধর্মের সকল সম্প্রদায়ের প্রভু, সেই সর্বব্যাপী পুরুষের সম্পূর্ণ মহিমা কেবল ভারতই জানিয়াছিল, প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব কেবল ভারতই লাভ করিয়াছিল, আর কোন জাতিই প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব লাভ করিতে পারে নাই। তোমরা হয়তো আমার এই কথায় আশ্চর্য হইতেছ, কিন্তু অন্য কোন ধর্মের শাস্ত্র হইতে প্রকৃত ঈশ্বরতত্ত্ব বাহির কর দেখি। অন্যান্য জাতির এক-একজন জাতীয় ঈশ্বর বা জাতীয় দেবতা—য়াহুদীর ঈশ্বর, আরবের ঈশ্বর ইত্যাদি; আর সেই ঈশ্বর আবার অন্যান্য জাতির ঈশ্বরের সহিত যুদ্ধবিগ্রহে নিযুক্ত। কিন্তু ঈশ্বরের করুণা, তিনি যে পরম দয়াময়, তিনি যে আমাদের পিতা মাতা সখা, প্রাণের প্রাণ, আত্মার অন্তরাত্মা—এই তত্ত্ব কেবল ভারতই জানিত। সেই দয়াময় প্রভু আমাদিগকে আশীর্বাদ করুন, আমাদিগকে সাহায্য করুন, আমাদিগকে শক্তি দিন, যাহাতে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত করিতে পারি।
ওঁ সহ নাববতু। সহ নৌ ভুনক্তু। সহ বীর্যং করবাবহৈ ||
তেজস্বি নাবধীতমস্তু মা বিদ্বিষাবহৈ || ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ|| হরি ওঁ||
আমরা যাহা শ্রবণ করিলাম, তাহা যেন অন্নের মত আমাদের পুষ্টিবিধান করে, উহা আমাদের বলস্বরূপ হউক, উহা দ্বারা আমাদের এমন শক্তি উৎপন্ন হউক যে, আমরা যেন পরস্পরকে সাহায্য করিতে পারি। আমরা—আচার্য ও শিষ্য যেন কখনও পরস্পরকে বিদ্বেষ না করি। ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। হরি ওঁ॥
০৬. পরমকুডি অভিনন্দনের উত্তর
আপনারা আমাকে যেরূপ যত্নসহকারে আন্তরিক অভ্যর্থনা করিয়াছেন, সেজন্য আপনাদিগকে ধন্যবাদ দিবার ভাষা আমি খুঁজিয়া পাইতেছি না। তবে যদি আমাকে অনুমতি করেন তো বলিতে চাই—লোকে আমাকে পরম যত্নের সহিত অভ্যর্থনাই করুক বা অবজ্ঞা করিয়া এখান হইতে তাড়াইয়া দিক, তাহাতে স্বদেশের প্রতি, বিশেষতঃ আমার স্বদেশবাসীর প্রতি ভালবাসার কিছু তারতম্য হইবে না; কারণ আমরা গীতায় পাঠ করিয়াছি যে, কর্ম নিষ্কাম- ভাবে করা উচিত; আমাদের ভালবাসাও নিষ্কাম হওয়া উচিত। পাশ্চাত্যদেশে যে কাজ করিয়াছি, তাহা অতি সামান্যই; এখানে এমন কোন ব্যক্তিই উপস্থিত নাই, যিনি আমা অপেক্ষা শতগুণ অধিক কাজ করিতে না পারিতেন। আমি আগ্রহের সহিত সেই দিনের প্রতীক্ষা করিতেছি, যে-দিন মহামনীষী ধর্মবীরগণ আবির্ভূত হইয়া ভারতের অরণ্যরাজি হইতে সমুত্থিত ও ভারত-ভূমির নিজস্ব সেই আধ্যাত্মিকতা ও ত্যাগের বাণী ভারতের বাহিরে জগতের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত প্রচার করিবেন।
মানবজাতির ইতিহাস অধ্যয়ন করিলে দেখা যায়, সময়ে সময়ে সব জাতির মধ্যেই যেন একটা সংসার-বিরক্তির ভাব আসিয়া থাকে। তাহারা দেখে, তাহারা যে-কোন পরিকল্পনা করিতেছে, তাহাই যেন হাত ফসকাইয়া যাইতেছে—প্রাচীন আচার-প্রথাগুলি সব যেন ধূলিসাৎ হইয়া যাইতেছে, সব আশা-ভরসা নষ্ট হইয়া যাইতেছে, সবই যেন শিথিল হইয়া যাইতেছে!