কিন্তু যদি এই অবসন্ন পতিত জাতির মস্তকে অনবরত—সময়ে অসময়ে ক্রমাগত গালি বর্ষণ করিয়া স্বজাতির নৈতিক শ্রেষ্ঠতা দেখান তোমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে আমি স্পষ্টই বলিতে পারি, যদি একটু ন্যায়পরতার সহিত এই তুলনা হয়, তবে হিন্দুগণ—নীতিপরায়ণ জাতি হিসাবে জগতের অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অনেক উচ্চ আসন পাইবে।
ভারতে ধর্মকে কখনই শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখা হয় নাই। কোন ব্যক্তিকেই তাহার ইষ্টদেবতা, সম্প্রদায় বা আচার্য মনোনয়নে কখনও বাধা দেওয়া হয় নাই; সুতরাং এখানে ধর্মের যেরূপ উন্নতি হইয়াছিল, অন্য কোথাও সেরূপ হয় নাই।
অপরদিকে আবার ধর্মের ভিতর এই নানাভাব বিকাশের জন্য একটি স্থিরবিন্দুর আবশ্যক হইল—সমাজ এই স্থিরবিন্দুরূপে গৃহীত হইল। ইহার ফলে সমাজ কঠোরশাসনে পূর্ণ ও একরূপ অচল হইয়া দাঁড়াইল। কারণ স্বাধীনতাই উন্নতির একমাত্র সহায়ক।
পাশ্চাত্য দেশে কিন্তু সমাজ ছিল বিভিন্ন ভাব বিকাশের ক্ষেত্র এবং স্থিরবিন্দু ছিল ধর্ম। প্রতিষ্ঠিত চার্চের সহিত একমত হওয়াই ইওরোপীয় ধর্মের মূলমন্ত্র ছিল, এমন কি এখনও আছে; আর যদি কোন সম্প্রদায় প্রচলিত মত হইতে কিছু স্বতন্ত্র হইতে যায়, তাহা হইলে তাহাকে অজস্র শোণিতপাতের মধ্য দিয়া অতি কষ্টে একটু সুবিধা লাভ করিতে হয়। ইহার ফল একটি মহৎ সমাজ-সংহতি, কিন্তু তাহাতে যে ধর্ম প্রচলিত, তাহা অতি স্থূল জড়বাদের উপর কখনও উঠে নাই।
আজ পাশ্চাত্য দেশ নিজের অভাব বুঝিতেছে। এখন পাশ্চাত্যে উন্নত ঈশ্বরতত্ত্বান্বেষিগণের মূলমন্ত্র হইয়াছে—‘মানুষের যথার্থ স্বরূপ ও আত্মা।’ সংস্কৃত-দর্শন-অধ্যয়নকারী মাত্রেই জানেন, এ হাওয়া কোথা হইতে বহিতেছে, কিন্তু যতক্ষণ না ইহা নব জীবন সঞ্চার করিতেছে, ততক্ষণ ইহাতে কিছুই আসিয়া যায় না।
ভারতে আবার নূতন নূতন অবস্থার সংঘর্ষে সমাজ-সংহতির নূতন সামঞ্জস্যবিধান বিশেষ আবশ্যক হইতেছে। গত শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ ধরিয়া ভারত সমাজসংস্কার-সভায় ও সমাজসংস্কারকে পূর্ণ হইয়াছে। কিন্তু হায়! ইহার মধ্যে সব কয়টিই বিফল হইয়াছে। ইঁহারা সমাজসংস্কারের রহস্য জানিতেন না; ইঁহারা প্রকৃত শিক্ষণীয় বিষয় শিখেন নাই। ব্যস্ততাবশতঃ তাঁহারা আমাদের সমাজের যত দোষ, সব ধর্মের ঘাড়ে চাপাইয়াছেন। বন্ধুর গায়ে মশা বসিয়াছে দেখিয়া সেই গল্পের মানুষটি যেমন দারুণ আঘাতে মশার সঙ্গে বন্ধুকেও মারিয়া ফেলে, সেইরূপ তাঁহারা সমাজের দোষ সংশোধন করিতে গিয়া সমাজকেই একেবারে ধ্বংস করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক্ষেত্রে তাঁহারা অটল অচল গাত্রে আঘাত করিয়াছিলেন, শেষে উহার প্রতিঘাতবলে নিজেরাই ধ্বংস হইয়াছেন। যে-সকল মহামনা নিঃস্বার্থ পুরুষ এইরূপ বিপথে চালিত চেষ্টায় অকৃতকার্য হইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ধন্য! আমাদের নিশ্চেষ্ট সমাজরূপ নিদ্রিত দৈত্যকে জাগরিত করিতে সংস্কারোন্মত্ততার এই বৈদু্যতিক আঘাতের বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছিল।
আসুন, আমরা ইঁহাদের শুভকামনা করিয়া ইঁহাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা লাভবান্ হই। তাঁহারা এটুকু শিক্ষা করে নাই, ভিতর হইতে বিকাশ আরম্ভ হয়, বাহিরে তাহারই পরিণতি হয়; তাঁহারা শিক্ষা করেন নাই, সমুদয় ক্রমবিকাশ পূর্ববর্তী কোন ক্রমসঙ্কোচের পুনর্বিকাশ মাত্র। তাঁহারা জানিতেন না, বীজ উহার চারিপাশের পঞ্চভূত হইতে উপাদান সংগ্রহ করে বটে, কিন্তু বৃক্ষটি নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী হইয়া থাকে। যতদিন না হিন্দুজাতি একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং এক নূতন জাতি তাহার স্থান অধিকার করে, ততদিন প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে যতই চেষ্টা কর না কেন, জীবিত থাকিতে ভারত কখনও ইওরোপ হইতে পারে না।
ভারত কি বিলুপ্ত হইবে, যে-ভারত সমুদয় মহত্ত্ব নীতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন জননী, যে-ভূমিতে সাধুগণ বিচরণ করিতেন, যে-ভূমিতে ঈশ্বরপ্রতিম ব্যক্তিগণ এখনও বাস করিতেছেন? হে ভ্রাতৃগণ, এথেন্সের সেই জ্ঞানী মহাত্মার২৯ লণ্ঠন লইয়া তোমাদের সঙ্গে এই বিস্তৃত জগতের প্রত্যেক নগর, গ্রাম, অরণ্য অন্বেষণে যাইতে রাজী আছি, কোথাও যদি এমন লোক পাও তো দেখাও। এ কথা ঠিক যে, ফল দেখিয়াই গাছ চেনা যায়। ভারতের প্রত্যেক আমগাছের তলায় পতিত ঝুড়ি ঝুড়ি কীটদষ্ট, অপক্ক আম কুড়াও এবং তাহাদের প্রত্যেকটি সম্বন্ধে একশতটি করিয়া গবেষণাপূর্ণ গ্রন্থ রচনা কর। তথাপি তুমি একটি আমেরও সঠিক বর্ণনা লিখিতে পারিবে না। গাছ হইতে একটি সুপক্ক সরস সুমিষ্ট আম পাড়িয়া লও, তবেই তুমি আমের সকল তত্ত্ব অবগত হইবে।
এইভাবে এই ঈশ্বরকল্প মানবগণই হিন্দুধর্ম কি, তাহা প্রকাশ করেন। এই জাতি শতাব্দী দ্বারা কৃষ্টির পরিমাপ করে, যে জাতিরূপ বৃক্ষ সহস্র বর্ষ ধরিয়া ঝঞ্ঝাবাত সহ্য করিয়াও অনন্ত তারুণ্যের অক্ষয় তেজে এখনও গৌরবান্বিত হইয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে, এই দেবমানবদের জীবন দেখিলেই সেই জাতির স্বরূপ, শক্তি ও সম্ভাবনার বিষয় জানা যায়।
ভারত কি মরিয়া যাইবে? তাহা হইলে জগৎ হইতে সমুদয় আধ্যাত্মিকতা বিলুপ্ত হইবে; চরিত্রের মহান্ আদর্শসকল বিলুপ্ত হইবে, সমুদয় ধর্মের প্রতি মধুর সহানুভূতির ভাব বিলুপ্ত হইবে, সমুদয় ভাবুকতা বিলুপ্ত হইবে; তাহার স্থলে কাম ও বিলাসিতা যুগ্ম দেবদেবীরূপে রাজত্ব চালাইবে; অর্থ—সে পূজার পুরোহিত; প্রতারণা, পাশব বল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা—তাহার পূজাপদ্ধতি আর মানবাত্মা তাহার বলি। এ অবস্থা কখনও হইতে পারে না। কর্মশক্তি হইতে সহ্যশক্তি অনন্তগুণে শ্রেষ্ঠ। ঘৃণাশক্তি হইতে প্রেমশক্তি অনন্তগুণ অধিক শক্তিমান্। যাঁহারা মনে করেন হিন্দুধর্মের বর্তমান পুনরুত্থান কেবল দেশপ্রীতিজাত আবেগের একটি বিকাশমাত্র, তাঁহারা ভ্রান্ত।