প্রথমে নিশ্চয় করিয়া জান—তাহারা কি করিতেছে (শতকরা নিরানব্বই জনের অধিক নিন্দুকই এ-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ), তখন বেদান্তদর্শনের আলোকে উহা আপনিই ব্যাখ্যাত হইয়া যাইবে। তথাপি এ কর্মগুলি অবশ্য-কর্তব্য নয়। বরং ‘মনু’ খুলিয়া দেখ—উহা প্রত্যেক বৃদ্ধকে চতুর্থাশ্রম (সন্ন্যাস) গ্রহণ করিতে আদেশ করিতেছে, এবং তাহারা উহা গ্রহণ করুক বা না করুক, তাহাদিগকে সমুদয় কর্ম অবশ্যই ত্যাগ করিতে হইবে।
সর্বত্রই ইহা পুনঃপুনঃ বলা হইয়াছে যে, এই সমুদয় কর্মকাণ্ডে সমাপ্ত হয়—‘জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।’২৮ এই-সকল কারণে অন্যান্য দেশের অনেক ভদ্রলোক অপেক্ষা একজন হিন্দু-কৃষকও অধিক ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন। আমার বক্তৃতায় ইওরোপীয় দর্শন ও ধর্মের অনেক শব্দ ব্যবহারের জন্য কোন বন্ধু সমালোচনাচ্ছলে অনুযোগ করিয়াছেন। সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিতে পারিলে আমার পরম আনন্দ হইত। উহা অপেক্ষাকৃত সহজ হইত, কারণ সংস্কৃত ভাষাই ধর্মভাব প্রকাশের একমাত্র সঠিক বাহন। কিন্তু বন্ধুটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে, আমার শ্রোতা ছিলেন পাশ্চাত্য নরনারীগণ। যদিও কোন ভারতীয় খ্রীষ্টান মিশনারী বলিয়াছিলেন, হিন্দুরা তাহাদের সংস্কৃত গ্রন্থের অর্থ ভুলিয়া গিয়াছে, মিশনারীগণই উহার অর্থ আবিষ্কার করিয়াছেন, তথাপি আমি সেই সমবেত বৃহৎ মিশনারীমণ্ডলীর মধ্যে একজনকেও দেখিতে পাইলাম না, যিনি সংকৃত ভাষায় একটি পঙ্ক্তি পর্যন্ত বুঝেন; কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকে বেদ, বেদান্ত ও হিন্দুধর্মের যাবতীয় পবিত্র শাস্ত্র সম্বন্ধে সমালোচনা করিয়া বড় বড় গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন।
আমি কোন ধর্মের বিরোধী—এ কথা সত্য নয়। আমি ভারতীয় খ্রীষ্টান মিশনারীদের বিরোধী—এ কথাও সত্য নয়। তবে আমি আমেরিকায় তাঁহাদের টাকা তুলিবার কতকগুলি উপায়ের প্রতিবাদ করি।
বালকবালিকাদের পাঠ্যপুস্তকে অঙ্কিত ঐ চিত্রগুলির অর্থ কি? চিত্রে অঙ্কিত রহিয়াছে—হিন্দুমাতা তাহার সন্তান গঙ্গায় কুমিরের মুখে নিক্ষেপ করিতেছে। জননী কৃষ্ণকায়া, কিন্তু শিশুটি শ্বেতাঙ্গরূপে অঙ্কিত; ইহার উদ্দেশ্য শিশুগণের প্রতি অধিক সহানুভূতি আকর্ষণ ও অধিক চাঁদাসংগ্রহ। একটি ছবিতে একজন পুরুষ তাহার স্ত্রীকে একটি কাষ্ঠস্তম্ভে বাঁধিয়া নিজ হস্তে পুড়াইতেছে; স্ত্রী যেন ভূত হইয়া তাহার স্বামীর শত্রুকে পীড়ন করিবে— ঐ-প্রকার ছবির অর্থ কি? বড় বড় রথ রাশি রাশি মানুষকে চাপা দিয়া মারিয়া ফেলিতেছে—এ-সকল ছবির অর্থ কি? সেদিন এখানে (আমেরিকায়) ছেলেদের জন্য একখানি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে একজন পাদরী ভদ্রলোক তাঁহার কলিকাতা-দর্শনের কথা বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, তিনি দেখিয়াছেন—কলিকাতার রাস্তায় একখানি রথ কতকগুলি ধর্মোন্মত্ত ব্যক্তির উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছে।
মেমফিস নগরে আমি একজন পাদরী ভদ্রলোককে প্রচারকালে বলিতে শুনিয়াছি, ভারতের প্রত্যেক পল্লীগ্রামে ক্ষুদ্র শিশুদের কঙ্কালপূর্ণ একটি করিয়া পুষ্করিণী আছে।
হিন্দুরা খ্রীষ্টশিষ্যগণের কি ক্ষতি করিয়াছে যে, প্রত্যেক খ্রীষ্টান বালকবালিকাকেই শিক্ষা দেওয়া হয়—যেন তাহারা হিন্দুদিগকে ‘দুষ্ট’, ‘হতভাগা’ ও পৃথিবীর মধ্যে ভয়ানক ‘দানব’ বলিয়া অভিহিত করে? এখানে বালকবালিকাদের রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার অঙ্গীভূত—খ্রীষ্টান ব্যতীত অপর সকলকে, বিশেষতঃ হিন্দুকে ঘৃণা করিতে শেখানো, যাহাতে তাহারা শৈশবকাল হইতেই খ্রীষ্টান মিশনে চাঁদা দিতে শেখে।
সত্যের খাতিরে না হইলেও অন্ততঃ তাঁহাদের সন্তানগণের নৈতিক জীবনের খাতিরেও খ্রীষ্টান মিশনারীগণের আর এরূপ ভাবের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। বালকবালিকাগণ যে বড় হইয়া অতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর নরনারীতে পরিণত হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? কোন প্রচারক—যতই অনন্ত নরকের যন্ত্রণা এবং প্রজ্বলিত অগ্নি ও গন্ধকধূমের বর্ণনা করিতে পারেন, গোঁড়াদিগের মধ্যে তাঁহার ততই অধিক প্রতিপত্তি হয়। আমার কোন বন্ধুর একটি অল্পবয়স্কা দাসীকে—‘পুনরুত্থান’-সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচার শ্রবণের ফলে বাতুলালয়ে পাঠাইতে হইয়াছিল। তাহার পক্ষে জ্বলন্ত গন্ধক ও নরকাদির মাত্রাটি কিছু অতিরিক্ত হইয়াছিল।
আবার মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে লিখিত গ্রন্থগুলি দেখ। যদি কোন হিন্দু খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধে এরূপ এক পঙ্ক্তি লেখে, তাহা হইলে মিশনারীগণ প্রতিহিংসায় বিষোদ্গার করিতে থাকেন।
স্বদেশবাসিগণ, আমি এই দেশে এক বৎসরের অধিক কাল; আমি ইঁহাদের সমাজের প্রায় সকল অংশই দেখিয়াছি। এখন উভয় দেশের তুলনা করিয়া তোমাদিগকে বলিতেছি, মিশনারীরা পৃথিবীর সর্বত্র বলিয়া বেড়ান, আমরা শয়তান; প্রকৃতপক্ষে আমরা শয়তান নই, আর তাঁহারাও নিজেদের দেবদূত বলিয়া দাবী করেন, তাঁহারাও দেবদূত নন। মিশনারীগণ হিন্দুবিবাহপ্রণালীর দুর্নীতি, শিশুহত্যা ও অন্যান্য দোষের কথা যত কম বলেন, ততই মঙ্গল। এমন অনেক দেশ থাকিতে পারে, যেখানকার বাস্তব চিত্রের সমক্ষে মিশনারীগণের অঙ্কিত হিন্দুসমাজের সমুদয় কাল্পনিক চিত্র নিষ্প্রভ হইয়া যাইবে। কিন্তু বেতনভুক্ নিন্দুক হওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য নয়। হিন্দু সমাজ সম্পূর্ণ নির্দোষ—এ দাবী আর কেহ করে করুক, আমি কখনও করিব না। এই সমাজের যে-সকল ত্রুটি অথবা শত শতাব্দী-ব্যাপী দুর্বিপাকবশে ইহাতে যে-সকল দোষ জন্মিয়াছে, সে সম্বন্ধে আর কেহই আমা অপেক্ষা বেশী জানে না। বৈদেশিক বন্ধুগণ, যদি তোমরা যথার্থ সহানুভূতির সঙ্গে সাহায্য করিতে আস, বিনাশ যদি তোমাদের উদ্দেশ্য না হয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হউক, ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা।