ভক্তিমার্গ সম্বন্ধে বক্তব্য এই, বাঙালী সমালোচকগণও বেশ জানেন যে, ভক্তিমার্গের কোন কোন আচার্য বলিয়াছেন, মুক্তির জন্য জাতি বা লিঙ্গে কিছু আসে যায় না, এমন কি মনুষ্যজন্ম পর্যন্ত আবশ্যক নয়; একমাত্র প্রয়োজন—ভক্তি।
জ্ঞান ওই ভক্তি সর্বত্র নিরপেক্ষ বলিয়া প্রচারিত হইয়াছে। সুতরাং কোন আচার্যই এরূপ বলেন নাই যে, মুক্তিলাভে কোন বিশেষ মতাবলম্বীর, বিশেষ বর্ণের বা বিশেষ জাতির অধিকার। এ বিষয়ে ‘অন্তরা চাপি তু তদ্দৃষ্টেঃ’২৫—এই বেদান্তসূত্রের উপর শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব-কৃত ভাষ্য পাঠ কর।
সমুদয় উপনিষদ্ অধ্যয়ন কর, এমন কি সংহিতাগুলির মধ্যে কোথাও অন্যান্য ধর্মে মোক্ষের যে সঙ্কীর্ণ ভাব আছে, তাহা পাইবে না। অপর ধর্মের প্রতি সহানুভূতির ভাব সর্বত্রই রহিয়াছে, এমন কি অধ্বর্যুবেদের সংহিতাভাগের চত্বারিংশৎ অধ্যায়ের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্লোকে আছে—(যদি আমার ঠিক স্মরণ থাকে) ‘ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।’২৬ এই ভাব হিন্দুধর্মের সর্বত্র রহিয়াছে।
যতদিন কেহ সামাজিক নিয়ম পালন করিয়া চলিয়াছে, ততদিন ভারতে কেহ কি কখনও নিজ ইষ্টদেবতা নির্বাচনের জন্য, নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী হইবার জন্য নিগৃহীত হইয়াছে? সামাজিক নিয়মভঙ্গের অপরাধে সমাজ যে-কোন ব্যক্তিকে শাসন করিতে পারেন, কিন্তু কোন ব্যক্তি—এমন কি অতি নীচ পতিত পর্যন্ত কখনও হিন্দুধর্ম-মতে মুক্তির অনধিকারী নয়। এই দুইটি একসঙ্গে মিশাইয়া গোল করিও না। ইহার উদাহরণ দেখ। মালাবারে একজন চণ্ডালকে একজন উচ্চবর্ণের লোকের সঙ্গে এক রাস্তায় চলিতে দেওয়া হয় না, কিন্তু সে মুসলমান বা খ্রীষ্টান হইলে তাহাকে অবাধে সর্বত্র যাইতে দেওয়া হয়, আর এই নিয়ম একজন হিন্দু রাজার রাজ্যে কত শতাব্দী ধরিয়া রহিয়াছে! ইহা একটু অদ্ভুত রকমের বোধ হইতে পারে, কিন্তু অতিশয় প্রতিকূল অবস্থার ভিতরও অপরাপর ধর্মের প্রতি হিন্দুধর্মের সহানুভূতির ভাবও ইহাতে প্রকাশিত হইতেছে।
হিন্দুধর্ম একটি বিষয়ে জগতের অন্যান্য ধর্ম হইতে পৃথক্, একটি ভাব প্রকাশ করিতে সাধুগণ সংস্কৃতভাষার সমুদয় শব্দরাশি প্রায় নিঃশেষিত করিয়াছেন যে, মানুষকে এই জীবনেই ব্রহ্ম উপলব্ধি করিতে হইবে, এবং অদ্বৈতবাদ আর একটু অগ্রসর হইয়া বলেন যে, ‘ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি’—এ কথা খুব যুক্তিসঙ্গতও বটে।
এই মতের ফলস্বরূপ প্রেরণার অতি উদার ও মহৎ ভাব আসিতেছে—ইহা শুধু বৈদিক ঋষিগণ বলিয়াছেন, তাহা নয়; শুধু বিদুর, ধর্মব্যাধ২৭ ও অপরাপর প্রাচীন মহাপুরুষেরা ইহা বলিয়াছেন, তাহা নয়, কিন্তু সেদিন সেই দাদূপন্থী-সম্প্রদায়ভুক্ত ত্যাগী নিশ্চলদাসও নির্ভিকভাবে তাঁহার ‘বিচারসাগর’ গ্রন্থে ঘোষণা করিয়াছেনঃ
যো ব্রহ্মবিদ্ ওই ব্রহ্ম, তাকু বাণী বেদ।
সংস্কৃত ঔর ভাষামে করত ভ্রমকি ছেদ॥
যিনি ব্রহ্মবিৎ, তিনিই ব্রহ্ম; তাঁহার বাক্যই বেদ। সংস্কৃত অথবা দেশীয় যে-কোন ভাষায় তিনি বলুন না কেন, তাহাতেই লোকের অজ্ঞান দূর হয়।
অতএব দ্বৈতবাদ অনুসারে ঈশ্বরকে লাভ করা এবং অদ্বৈতবাদ মতে ব্রহ্মভাবাপন্ন হওয়াই বেদের সমুদয় উপদেশের লক্ষ্য, এবং অন্য যাহা কিছু শিক্ষা বেদে আছে, তাহা সেই লক্ষ্যে পৌঁছিবার সোপানমাত্র। ভগবান্ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের এই মহিমা যে, তিনি নিজ প্রতিভাবলে ব্যাসের ভাবগুলি অপূর্বভাবে বিবৃত করিয়াছেন।
নিরপেক্ষ সত্য হিসাবে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; আপেক্ষিক সত্য হিসাবে এই ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশের উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতে বা ভারতের বাহিরে সকল ধর্মসম্প্রদায়ই সত্য! তবে কোন কোনটি অপরগুলি অপেক্ষা উচ্চতর, এই মাত্র। মনে কর, কোন ব্যক্তি বরাবর সূর্যাভিমুখে যাত্রা করিল। প্রতি পদক্ষেপে সে সূর্যের নূতন নূতন দৃশ্য দেখিবে। যতদিন না সে প্রকৃত সূর্যের নিকট পৌঁছিতেছে, ততদিন তাহার কাছে সূর্যের আকার দৃশ্য ও বর্ণ প্রতিমুহূর্তে নূতন হইতে থাকিবে। প্রথম সূর্যকে সে একটি বৃহৎ গোলকের ন্যায় দেখিয়াছিল। তারপর উহার আকৃতি ক্রমশঃ বড় হইতেছিল। প্রকৃতি সূর্য বাস্তবিক কখনও তাঁহার প্রথমে দৃষ্ট গোলকের মত বা পরে দৃষ্ট সূর্যসমূহের মত নয়। তথাপি ইহা কি সত্য নয় যে, সেই যাত্রী বরাবর সূর্যই দেখিতেছিল, সূর্য ব্যতীত অন্য কিছুই দেখে নাই? এইরূপে সমুদয় সম্প্রদায়ই সত্য; কোনটি প্রকৃত সূর্যের নিকটে, কোনটি বা দূরে! সেই প্রকৃত সূর্যই আমাদের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্।’
আর যখন এই সত্য নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপদেষ্টা একমাত্র বেদ—অন্যান্য ঐশ্বরিক ধারণা যাঁহারই ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ দর্শনমাত্র, যখন ‘সর্বলোকহিতৈষিণী শ্রুতি’ সাধকের হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে সেই নির্বিশেষ পরব্রহ্মে যাইবার সমুদয় সোপানগুলি দিয়া লইয়া যান, আর অন্যান্য ধর্ম যখন ইহাদের মধ্যে এক-একটি রুদ্ধগতি ও স্থিতিশীল সোপান মাত্র, তখন জগতের সমুদয় ধর্ম এই নামরহিত, সীমারহিত, নিত্য বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভুক্ত।
শত শত জীবন ধরিয়া চেষ্টা কর, অনন্তকাল ধরিয়া তোমার অন্তরের অন্তস্তল অনুসন্ধান করিয়া দেখ, তথাপি এমন কোন মহৎ ধর্মভাব আবিষ্কার করিতে পারিবে না, যাহা এই আধ্যাত্মিকতার অনন্ত খনির ভিতর পূর্ব হইতেই নিহিত নাই।
হিন্দুদের তথাকথিত পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রথমে গিয়া দেখ—ইহা কিরূপ ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করিতেছে; প্রথমে জান, উপাসকগণ কোথায় প্রথমে উপাসনা করেন—মন্দিরে, প্রতিমায় অথবা দেহমন্দিরে।