অতএব উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পঞ্জাববাসীরা বঙ্গদেশ, বোম্বাই ও মান্দ্রাজের অধিবাসিগণ অপেক্ষা ধর্মবিষয়ে অধিক শিক্ষিত। দশনামী, বৈরাগী, পন্থী প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ত্যাগী পরিব্রাজকগণ প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে ধর্মভাব লইয়া যাইতেছেন; মূল্য এক-টুকরা রুটিমাত্র। আর তাঁহাদের মধ্যে অনেকে কি মহৎ ও নিঃস্বার্থচরিত্র! স্বাধীন বা কাচুপন্থী সম্প্রদায়ের (যাঁহারা নিজেদের কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না) একজন সন্ন্যাসী আছেন। তাঁহারই চেষ্টায় সমগ্র রাজপুতানায় শত শত বিদ্যালয় ও দাতব্য আশ্রম স্থাপিত হইয়াছে। তিনি জঙ্গলের ভিতর হাসপাতাল খুলিয়াছেন, হিমালয়ের দুর্গম গিরিনদীর উপরে লৌহসেতু নির্মাণ করাইয়াছেন, কিন্তু তিনি কখনও মুদ্রা স্পর্শ করেন না; তাঁহার একখানি কম্বল ছাড়া সাংসারিক সম্বল আর কিছুই নাই, এইজন্য তাঁহাকে লোকে ‘কম্ব্লী স্বামী’ বলিয়া ডাকে—তিনি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া আহার সংগ্রহ করেন। তাঁহাকে কখনও একাদিক্রমে একই বাড়িতে পুরা ভিক্ষা করিতে দেখি নাই, পাছে গৃহস্থের কোন ক্লেশ হয়। আর এরূপ সাধু—তিনি একা নহেন, এরূপ শত শত সাধু রহিয়াছেন। তোমরা কি মনে কর, যতদিন এই ভূদেবগণ ভারতে জীবিত থাকিয়া তাঁহাদের দেবচরিত্ররূপ দুর্ভেদ্য প্রাচীর দ্বারা সনাতন ধর্মকে রক্ষা করিতেছেন, ততদিন এই প্রাচীন ধর্মের বিনাশ হইবে?
এই দেশে (আমেরিকায়) পাদরিগণ বৎসরের মধ্যে মাত্র ছয় মাস প্রতি রবিবার দুই ঘণ্টা ধর্মপ্রচারের জন্য ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ—এমন কি নব্বই হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পাইয়া থাকেন। আমেরিকাবাসিগণ তাঁহাদের ধর্মরক্ষার জন্য কত লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করিতেছেন, আর বাঙালী যুবকগণ শিক্ষা পাইয়াছেন, ‘কম্ব্লী স্বামী’র ন্যায় দেবতুল্য সম্পূর্ণ নিঃসার্থ ব্যক্তিগণ অলস ভবঘুরে মাত্র! ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’২৩ —আমার ভক্তদের যাহারা ভক্ত, তাহারাই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, এই আমার মত।
একটি চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত লও—একজন অতি অজ্ঞ বৈরাগীর কথা ধর। তিনি যখন কোন গ্রামে গমন করেন, তিনিও তুলসীদাস বা চৈতন্যচরিতামৃত হইতে যাহা জানেন, অথবা দাক্ষিণাত্যে হইলে আলওয়ারদিগের নিকট যাহা শিখিয়াছেন, তাহা শিখাইতে চেষ্টা করেন। ইহা কি কিছু উপকার করা নয়? আর এই সমুদয়ের বিনিময়ে তাঁহার প্রাপ্য এক-টুকরা রুটি ও একখণ্ড কৌপীন। ইঁহাদিগকে নির্দয়ভাবে সমালোচনা করিবার পূর্বে ভ্রাতৃগণ, চিন্তা কর— তোমরা তোমাদের স্বদেশবাসীর জন্য কি করিয়াছ, যাহাদের ব্যয়ে তোমরা শিক্ষা পাইয়াছ, যাহাদিগকে শোষণ করিয়া তোমাদের পদগৌরব রক্ষা করিতে হয়, এবং ‘বাবাজীগণ ভবঘুরে মাত্র’ এই শিক্ষার জন্য তোমাদের শিক্ষকগণকে বেতন দিতে হয়।
আমাদের কতকগুলি স্বদেশী বঙ্গবাসী হিন্দুধর্মের এই পুনরুত্থানকে হিন্দুধর্মের ‘নূতন বিকাশ’ বলিয়া সমালোচনা করিয়াছেন। তাঁহারা উহাকে ‘নূতন’ আখ্যা দিতে পারেন। কারণ হিন্দুধর্ম সবেমাত্র বাঙলা দেশে প্রবেশ করিতেছে; এখানে এতদিন ধর্ম বলিতে কেবল আহার বিহার ও বিবাহ সম্বন্ধীয় কতকগুলি দেশাচারমাত্রকেই বুঝাইত।
রামকৃষ্ণ-শিষ্যগণ হিন্দুধর্মের যে-ভাব সমগ্র ভারতে প্রচার করিতেছেন, তাহা সৎশাস্ত্রের অনুমোদিত কিনা, এই ক্ষুদ্র পত্রে সেই গুরুতর প্রশ্ন বিচার করিবার স্থান নাই। তবে আমি আমাদের সমালোচকগণ কয়েকটি সঙ্কেত দিব, যাহাতে তাহারা আমাদের মত আরও ভালরূপে বুঝিতে পারে।
প্রথমতঃ আমি কখনও এরূপ তর্ক করি নাই যে, কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের গ্রন্থ হইতে হিন্দুধর্মের যথার্থ ধারণা হইতে পারে, যদিও তাঁহাদের কথা ‘অমৃত-সমান’ এবং যাঁহারা উহা শুনেন, তাঁহারা ‘পুণ্যবান্’। হিন্দুধর্ম বুঝিতে হইলে বেদ ও দর্শন পড়িতে হইবে এবং সমুদয় ভারতের প্রধান প্রধান ধর্মাচার্য এবং তাঁহাদের শিষ্যগণের উপদেশাবলী জানিতে হইবে। ভ্রাতৃগণ, যদি তোমরা গৌতমসূত্র হইতে আরম্ভ করিয়া বাৎস্যায়ন-ভাষ্যের আলোকে ‘আপ্ত’২৪ সম্বন্ধে গৌতমের মতবাদ পাঠ কর, শবর ও অন্যান্য ভাষ্যকারগণের সাহায্যে যদি মীমাংসকগণের মত আলোচনা কর, ‘অলৌকিক প্রত্যক্ষ’ ও ‘আপ্ত’ সম্বন্ধে এবং সকলেই ‘আপ্ত’ হইতে পারে কিনা এবং এইরূপ আপ্তদিগের বাক্য বলিয়াই যে বেদের প্রামাণ্য, এই- সকল বিষয়ে তাঁহাদের মত যদি অধ্যয়ন কর, যদি তোমাদের মহীধরকৃত যজুর্বেদভাষ্যের উপক্রমণিকা দেখিবার অবকাশ থাকে, তবে তাহাতে দেখিবে—মানবের আধ্যাত্মিক জীবন ও বেদের নিয়মাবলী সম্বন্ধে আরও সুন্দর সুন্দর বিচার আছে। তাঁহারা তাই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, বেদ অনাদি অনন্ত।
‘সৃষ্টির অনাদিত্ব’ মত সম্বন্ধে বক্তব্য এই, ঐ মত কেবল হিন্দুধর্মের নয়, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেরও একটি প্রধান ভিত্তি।
এখন—ভারতীয় সমুদয় সম্প্রদায়কে মোটামুটি জ্ঞানমার্গী বা ভক্তিমার্গী বলিয়া শ্রেণীবদ্ধ করা যাইতে পারে। যদি তোমরা শ্রীশঙ্করাচার্যকৃত শারীরিকভাষ্যের উপক্রমণিকা পাঠ কর, তবে দেখিবে—সেখানে জ্ঞানের ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পূর্ণভাবে বিচার করা হইয়াছে, আর এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, ব্রহ্মানুভুতি ও মোক্ষ কোনরূপ অনুষ্ঠান, মত, জাতি বা সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে না। যে-কোন ব্যক্তি ‘সাধনচতুষ্টয়’-সম্পন্ন, সে-ই ইহার অধিকারী। সাধনচতুষ্টয় সম্পূর্ণ চিত্তশুদ্ধিকর কতকগুলি অনুষ্ঠানমাত্র।