দাক্ষিণাত্যবাসী তোমাদের নিকট আর্যাবর্তবাসিগণ বিশেষভাবে ঋণী, কারণ ভারতে আজ যে-সকল শক্তি সক্রিয়, তাহাদের অধিকাংশেরই মূল দাক্ষিণাত্য। শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকারগণ, যুগপ্রবর্তনকারী আচার্যগণ, যথা শঙ্কর, রামানুজ ও মধ্ব—ইঁহারা সকলেই দাক্ষিণাত্যে জন্মিয়াছিলেন। যে মহাত্মা শঙ্করের নিকট জগতের প্রত্যেক অদ্বৈতবাদীই ঋণী; যে মহাত্মা রামানুজের স্বর্গীয় স্পর্শ পদদলিত পারিয়াগণকেও আলওয়ারে পরিণত করিয়াছিল, সমগ্র ভারতে শক্তিসঞ্চারকারী আর্যাবর্তের সেই একমাত্র মহাপুরুষ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের অনুবর্তিগণও যে মহাত্মা মধ্বের শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন—তাঁহাদের সকলেরই জন্মস্থান দাক্ষিণাত্য। বর্তমানকালেও বারাণসীধামের শ্রেষ্ঠ গৌরব-স্বরূপ মন্দিরসমূহে দাক্ষিণাত্যবাসীরই প্রাধান্য, তোমাদের ত্যাগই হিমালয়ের সুদূরবর্তী চূড়াস্থিত পবিত্র দেবালয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করিতেছে। অতএব মহাপুরুষগণের পূতশোণিতে পূরিতধমনী, তথাবিধ আচার্যগণের আশীর্বাদে ধন্যজীবন, তোমরা যে ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী সর্বপ্রথম বুঝিবে ও আদরপূর্বক গ্রহণ করিবে, তাহাতে আর বিস্ময়ের কি আছে!
দাক্ষিণাত্যই চিরদিন বেদবিদ্যার ভাণ্ডার, সুতরাং তোমরা বুঝিবে যে, হিন্দুধর্ম-আক্রমণকারী অজ্ঞ সমালোচকগণের পুনঃপুনঃ প্রতিবাদ সত্ত্বেও এখনও শ্রুতিই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেরুদণ্ডস্বরূপ।
জাতিতত্ত্ববিৎ বা ভাষাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতদিগের নিকট বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণভাগের মূল্য যতই হউক, ‘অগ্নিমীলে’, ‘ইষেত্বোর্জে ত্বা’, ‘শন্নোদেবীরভীষ্টয়ে’৮ প্রভৃতি বৈদিকমন্ত্র উচ্চারণ সহকারে ভিন্ন ভিন্ন রূপে বেদীযুক্ত বিভিন্ন যজ্ঞে নানাবিধ আহুতি দ্বারা প্রাপ্য ফলসমূহ যতই বাঞ্ছনীয় হউক, এই-সব কিছুরই একমাত্র উদ্দেশ্য ভোগ। এগুলি মোক্ষজনক—এ কথা বলিয়া কেহ কখনও তর্ক করে নাই। সুতরাং আধ্যাত্মিকতা ও মোক্ষমার্গের উপদেশক জ্ঞানকাণ্ড, যাহা আরণ্যক বা শ্রুতিশির বলিয়া কথিত হয়, তাহাই ভারতে চিরকাল শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করিয়াছে এবং চিরকাল করিবে।
সনাতন ধর্মের নানা মতমতান্তররূপ গোলকধাঁধায় দিগ্ভ্রান্ত, একমাত্র যে ধর্মের সর্বজনীন উপযোগিতা তৎপ্রচারিত ‘অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্’ ব্রহ্মের অবিকল প্রতিবিম্ব-স্বরূপ—পূর্ব হইতেই প্রতিকূল চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকায় তাহার মর্মবোধে অক্ষম, এবং জড়বাদসর্বস্ব জাতির নিকট ঋণসূত্রে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিকতার মনাদণ্ড অবলম্বন করিয়া অন্ধকারে অন্বেষণপরায়ণ আধুনিক হিন্দুযুবক বৃথাই তাহার পূর্বপুরুষগণের ধর্ম বুঝিতে চেষ্টা করে এবং হয় ঐ চেষ্টা একেবারে পরিত্যাগ করিয়া ঘোর অজ্ঞেয়বাদী হইয়া পড়ে, অথবা স্বাভাবিক ধর্মভাবের প্রেরণায় পশুজীবন-যাপনে অসমর্থ হইয়া প্রাচ্যগন্ধী বিবিধ পাশ্চাত্য জড়বাদের নির্যাস অসাবধানে পান করে, এবং শ্রুতির এই ভবিষ্যদ্বাণী সফল করেঃ পরিযন্তি মূঢ়া অন্ধেনৈব নীয়মানা যথাঽন্ধাঃ।৯ তাঁহারাই কেবল বাঁচিয়া যান, যাঁহাদের আত্মা সদ্গুরুর জীবনপ্রদ স্পর্শবলে জাগ্রত হয়।
ভগবান্ ভাষ্যকার ঠিকই বলিয়াছেনঃ
দুর্লভং ত্রয়মেবৈতৎ দেবানুগ্রহহেতুকম্। মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ॥১০
পরমাণু, দ্ব্যণুক, ত্রসরেণু প্রভৃতি সম্বন্ধীয় অপূর্ব সিদ্ধান্তপ্রসূ বৈশেষিকদের সূক্ষ্ম বিচারসমূহই হউক, অথবা নৈয়ায়িকদের জাতিদ্রব্যগুণসমবায় প্রভৃতি বস্তুসম্বন্ধীয় অপূর্ব বিচারবলীই হউক, অথবা পরিণামবাদের জনকস্বরূপ সাংখ্যদিগের তদপেক্ষা গভীরতর চিন্তাগতিই হউক, অথবা এই বিভিন্নরূপ বিশ্লেষণাবলীর সুপক্ক ফলস্বরূপ ব্যাসসূত্রই হউক, মনুষ্য-মনের এই-সকল বিবিধ সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের একমাত্র ভিত্তি শ্রুতি। এমন কি বৌদ্ধ বা জৈনদিগের দার্শনিক গ্রন্থাবলীতেও শ্রুতির সহায়তা পরিত্যক্ত হয় নাই, আর অন্ততঃ কতকগুলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে এবং জৈনদের অধিকাংশ গ্রন্থে শ্রুতির প্রামাণ্য সম্পূর্ণরূপে স্বীকৃত হইয়া থাকে; তবে তাঁহারা শ্রুতির কোন কোন অংশকে ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক প্রক্ষিপ্ত বলিয়া ‘হিংসক’ শ্রুতি আখ্যা দেন—এবং সেগুলির প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। বর্তমান কালেও স্বর্গীয় মহাত্মা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীও এবম্বিধ মত পোষণ করিতেন।
যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, প্রাচীন ও বর্তমান সমুদয় ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীর কেন্দ্র কোথায়, যদি কেহ নানাবিধ শাখাপ্রশাখাবিশিষ্ট হিন্দুধর্মের প্রকৃত মেরুদণ্ড কি, জানিতে চান, তবে অবশ্য ব্যাসসূত্রকেই এই কেন্দ্র, এই মেরুদণ্ড বলিয়া দেখাইতে হইবে।
হিমাচলস্থিত অরণ্যানীর হৃদয়স্তব্ধকারী গাম্ভীর্যের মধ্যে স্বর্ণদীর গভীর ধ্বনিমিশ্রিত অদ্বৈতকেশরীর ‘অস্থি-ভাতি-প্রিয়’-রূপ১১বজ্রগম্ভীর রবই কেহ শ্রবণ করুন, অথবা বৃন্দাবনের মনোহর কুঞ্জসমূহে ‘পিয়াপীতম্’ কূজনই শ্রবণ করুন, বারাণসীধামের মঠসমূহে সাধুদিগের গভীর ধ্যানেই যোগদান করুন, অথবা নদীয়াবিহারী শ্রীগৌরাঙ্গের ভক্তগণের উদ্দাম নৃত্যেই যোগদান করুন, বড়গেলে তেঙ্গেলে১২ প্রভৃতি শাখাযুক্ত বিশিষ্টাদ্বৈতমতাবলম্বী আচার্যগণের পাদমূলেই উপবেশন করুন, অথবা মাধ্ব সম্প্রদায়ের আচার্যগণের বাক্যই শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করুন, গৃহী শিখদিগের ‘ওয়া গুরুকি ফতে’-রূপ১৩ সমরবাণীই শ্রবণ করুন, অথবা উদাসী ও নির্মলাদিগের গ্রন্থসাহেবের১৪ উপদেশই শ্রবণ করুন, কবীরের সন্ন্যাসী শিষ্যগণকে সৎসাহেব১৫বলিয়া অভিবাদনই করুন, অথবা সখীসম্প্রদায়ের ভজনই শ্রবণ করুন, রাজপুতানার সংস্কারক দাদুর অদ্ভুত গ্রন্থাবলী বা তাঁহার শিষ্য রাজা সুন্দরদাস ও তাঁহা হইতে ক্রমশঃ নামিয়া ‘বিচারসাগর’-এর বিখ্যাত রচয়িতা নিশ্চলদাসের গ্রন্থই (ভারতে গত তিন শতাব্দী ধরিয়া যত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এই বিচারসাগর-গ্রন্থের প্রভাব ভারতীয় জনসমাজে সর্বাপেক্ষা অধিক) পাঠ করুন, এমন কি আর্যাবর্তের ভাঙ্গী মেথরগণকে তাঁহাদের লালগুরুর উপদেশ বিবৃত করিতেই বলুন—তিনি দেখিবেন, এই আচার্যগণ ও সম্প্রদায়সমূহ সকলেই সেই ধর্মপ্রণালীর অনুবর্তী, শ্রুতি যাহার প্রামাণ্য গ্রন্থ, গীতা যাহার ভগবদ্বক্ত্র বিনিঃসৃত টীকা, শারীরক ভাষ্য১৬ যাহার প্রণালীবদ্ধ বিবৃতি আর পরমহংস পরিব্রাজকাচার্যগণ হইতে লালগুরুর মেথর শিষ্যগণ পর্যন্ত ভারতের সমুদয় বিভিন্ন সম্প্রদায় যাহার বিভিন্ন বিকাশ।