আপনাদের ভিতর যাঁহারা হারবার্ট স্পেন্সার পড়িয়াছেন, তাঁহাদের মনে আছে, তিনি তাঁহার শিক্ষাপদ্ধতিকে ‘মঠপদ্ধতি’ বলিয়াছেন। ইহা ইওরোপে প্রয়োগ করা হইয়াছে, কোথাও কোথাও সাফল্যমণ্ডিতও হইয়াছিল। এই পদ্ধতি অনুসারে গ্রামে একজন শিক্ষক থাকিবেন, তাঁহার ভার ঐ গ্রামকে লইতে হইবে। আমাদের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি অতি সাধারণ। কারণ আমাদের পদ্ধতিও অত্যন্ত সরল। প্রত্যেক বালক একটি ছোট মাদুরের আসন লইয়া আসে। তালপাতাতে লেখা আরম্ভ হয়, কারণ কাগজের দাম অনেক। প্রত্যেকটি বালক তাহার আসন বিছাইয়া বসে, দোয়াত ও পুস্তক সঙ্গে লইয়া আসে এবং লিখিতে আরম্ভ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সামান্য পাটীগণিত, কিছু সংস্কৃত ব্যাকরণ, একটু ভাষা ও হিসাব—এই শিক্ষা দেওয়া হয়।
বাল্যকালে এক বৃদ্ধ আমাদের নীতিবিষয়ক একটি ক্ষুদ্র পুস্তক মুখস্থ করাইয়াছিলেন, উহার একটি শ্লোক এখনও আমার মনে আছেঃ ‘গ্রামের হিতের জন্য পরিবার, স্বদেশের মঙ্গলের জন্য গ্রাম, মানবতার জন্য স্বদেশ এবং জগতের হিতের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করিবে।’৬ এইরূপ অনেক শ্লোক ঐ পুস্তকে আছে। আমরা ঐগুলি মুখস্থ করি, এবং শিক্ষক ব্যাখ্যা করিয়া দেন, পরে ছাত্রও ব্যাখ্যা করে। বালক-বালিকারা একত্র এগুলি শিক্ষা করে। ক্রমে তাহাদের শিক্ষা পৃথক্ হইয়া যায়। প্রাচীন সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রধানতঃ ছাত্রদের জন্যই ছিল। ছাত্রীরা কদাচিৎ সেখানে যাইত; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমও ছিল।
বর্তমানকালে ইওরোপীয় ধরনে উচ্চ শিক্ষার উপর অধিকতর ঝোঁক দেখা দিয়াছে। মেয়েরাও এই উচ্চ শিক্ষা লাভ করুক—এই দিকেই জনমত প্রবল হইতেছে। অবশ্য ভারতবর্ষে এমন লোকও আছে, যাহারা মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা চায় না; কিন্তু যাহারা চায়, তাহারাই জয়লাভ করিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় আজও ইংলণ্ডে অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আমেরিকায় হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার মেয়েদের জন্য রুদ্ধ। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ বৎসরেরও অধিক হইল, নারীদের জন্য উহার দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে। আমার মনে আছে, যে বৎসর আমি বি.এ.পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই, সেই বৎসর কয়েকটি ছাত্রীও ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিল। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য একই মান, একই পাঠ্যসূচী ছিল এবং পরীক্ষায় ছাত্রীরা বেশ ভালই করিয়াছিল। মেয়েদের শিক্ষা-ব্যাপারে আমাদের ধর্ম বাধা দেয় না। এইরূপে মেয়েদের শিক্ষা দিতে হইবে, এইভাবে তাহাদিগকে গড়িয়া তুলিতে হইবে, প্রাচীন পুস্তকে আমরা আরও দেখি—ছেলে ও মেয়েরা উভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিতেছে, কিন্তু পরবর্তী কালে সমস্ত জাতির শিক্ষাই অবহেলিত হইয়াছে। বৈদেশিক শাসনে কি আর আশা করা যায়? বিদেশী বিজেতারা আমাদের কল্যাণ করিবার জন্য তো আসে নাই। তাহারা ধন-সম্পদ্ চায়। আমি বারো বৎসর কঠোর অধ্যয়ন করিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বি. এ. পাস করিয়াছি; কিন্তু আমার দেশে আমি মাসে পাঁচ ডলারও উপার্জন করিতে পারি না। ইহা কি আপনারা বিশ্বাস করিবেন? ইহাই প্রকৃত অবস্থা। বিদেশী-প্রবর্তিত শিক্ষায়তনগুলির উদ্দেশ্য—বহুসংখ্যক কেরানী, পোস্টমাস্টার, টেলিগ্রাফ অপারেটর প্রভৃতি তৈরি করিয়া অল্প অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনের উপযোগী একদল কর্মদক্ষ ক্রীতদাস পাওয়া। ইহাই হইল এই শিক্ষার স্বরূপ।
ফলে, বালক-বালিকাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হইতেছে। আমাদের দেশে করিবার অনেক কিছু আছে। যদি আপনারা আমাকে ক্ষমা করেন এবং অনুমতি দেন, তাহা হইলে আপনাদেরই একটি প্রবাদ বাক্য আমি বলি, ‘হংসীর যাহা খাদ্য, হংসেরও খাদ্য তাই।’৭
বিদেশী মহিলারা হিন্দু মেয়েদের কঠোর জীবন দেখিয়া কত চীৎকার করেন—কাঁদেন, কিন্তু হিন্দু পুরুষদের কঠোর জীবনের উপর আপনাদের কোনই দৃষ্টি নাই। আপনাদের চোখের জল কৃত্রিম। ছোট ছোট বালিকাদের বিবাহ হয় কাহাদের সহিত? একজনের যখন বলা হইল যে, বৃদ্ধদের সহিত এই বালিকাদের বিবাহ হয়, তখন সে বলিয়া উঠিল, ‘যুবকেরা তাহা হইলে কি করে? কি আশ্চর্য! বালিকাদের কি বৃদ্ধদের সহিত—কেবল বৃদ্ধদের সহিতই বিবাহ দেওয়া হয়?’ আমরা যে বৃদ্ধ হইয়াই জন্মগ্রহণ করি—বোধ হয় আমাদের দেশের সব লোকই ঐরূপ।
আত্মার মুক্তি ভারতবর্ষের আদর্শ। জগৎটা কিছুই নয়। উহা একটা দৃশ্য মাত্র, একটা স্বপ্ন। এই জীবন কোটি কোটি জীবনের মত একটি। সমস্ত প্রকৃতিই মায়া, একটা ছায়া, ছায়ার আগার। ইহাই হইল ভারতীয় জীবন-দর্শন। শিশুরা জীবনকে অভিনন্দিত করে, ইহাকে মধুর ও সুন্দর বলিয়া মনে করে। কিন্তু কয়েক বছর পরেই যেখান হইতে তাহারা শুরু করিয়াছিল, তাহাদিগকে সেখানেই ফিরিয়া আসিতে হইবে। কাঁদিতে কাঁদিতে জীবন আরম্ভ হইয়াছিল, কাঁদিতে কাঁদিতেই জীবন শেষ হইবে। যৌবন-মত্ত জাতিরাও ভাবে যে, তাহারা যাহা খুশি তাহাই করিতে পারে। তাহারা মনে করে, আমরাই পৃথিবীর অধিপতি— দেবতা, ভগবানের চিহ্নিত জাতি। তাহারা ভাবে—সমগ্র জগৎকে শাসন করিবার, ঈশ্বরের পরিকল্পনা রূপায়িত করিবার, তাহাদের যাহা ইচ্ছা করিবার, পৃথিবীকে ওলট-পালট করিবার আদেশপত্র সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বর যেন তাহাদিগকে দিয়াছেন; হত্যা ও লুণ্ঠন করিবার ছাড়পত্র তাহারা পাইয়াছে। ভগবান্ তাহাদিগকে এই-সব স্বাধীনতা দিয়াছেন, শিশু বলিয়াই তাহারা এই-সব অপকর্ম করে। তাই সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্যের আবির্ভাব হইয়াছে, তাহাদের কত মহিমা ও বর্ণচ্ছটা! কিন্তু তাহারা বিস্মৃতির গর্ভে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে। হয়তো ধ্বংসস্তূপেই সেগুলি বিরাট!