অতঃপর নারীর দুহিতারূপে আসা যাক। ভারতীয় পরিবারে কন্যা একটি অতি কঠিন সমস্যা। কন্যা এবং বর্ণ-জাতি—এই দুইটি মিলিয়া হিন্দুকে সর্বস্বান্ত করে, কারণ কন্যার বিবাহ একই বর্ণের ভিতর দিতেই হবে, এবং বর্ণের ভিতরও আবার ঠিক একই প্রকার বংশমর্যাদার পাত্রের সহিত বিবাহ দিতে হইবে। সেইজন্য বেচারী পিতাকে কন্যার বিবাহের জন্য অনেক সময় ভিখারী হইয়া যাইতে হয়। পাত্রের পিতা পুত্রের জন্য বিরাট পণ দাবী করেন, এবং কন্যার পিতাকে কন্যার বর সংগ্রহ করিবার জন্য যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিতে হয়। সেইজন্য হিন্দুর জীবনে কন্যা যেন একটি কঠিন সমস্যা। মজার কথা ইংরেজীতে কন্যাকে বলা হয় ‘ডটর’, সংস্কৃতে উহার প্রতিশব্দ ‘দুহিতা’। ইহার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এই যে, প্রাচীনকালের পরিবারে কন্যারা গো দোহন করিতে অভ্যস্ত ছিল এবং ‘দুহিতা’ শব্দটি দোহন করা অর্থে ‘দুহ্’ ধাতু হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ‘দুহিতা’র প্রকৃত অর্থ হইতেছে দোহনকারিণী। পরে ‘দুহিতা’ শব্দটির একটি নূতন অর্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দোহনকারিণী—দুহিতা পরিবারের সমস্ত ‘দুগ্ধ’ দোহন করিয়া লইয়া যায়, ইহাই হইল দ্বিতীয় অর্থ।
ভারতীয় নারী যে-সকল বিভিন্ন সম্পর্কে সম্বন্ধ, সেগুলি বর্ণনা করিলাম। আমি আপনাদের পূর্বে বলিয়াছি যে, হিন্দুসমাজে জননীর স্থান সকলের উপরে, তাঁহার পর জায়া এবং তারপর কন্যা। এই পর্যায়ের ক্রম অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল। বহু বৎসর সে-দেশে বাস করিয়াও কোন বিদেশী ইহা বুঝিতে পারেন না। উদাহরণ-স্বরূপ, আমাদের ভাষার ব্যক্তিবাচক ‘সর্বানাম’-এর তিনটি রূপ আছে। ইহারা অনেকটা ‘ক্রিয়া’র মত কাজ করে। একটি খুবই সম্মানসূচক, দ্বিতীয়টি মধ্যম এবং সর্বনিম্নটি অনেকটা ইংরেজীর দাউ (thou) ও দী (thee)-এর মত। শিশু এবং ভৃত্যদের সম্পর্কে শেষেরটি প্রয়োগ করা হয়। মধ্যমটি সমান সমান লোকের মধ্যে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং দেখিতেছেন যে, আত্মীয়তার সর্বপ্রকার জটিল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সর্বনামগুলি ব্যবহার করিতে হয়। উদাহরণ-স্বরূপ, আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনীকে আজীবন আমি ‘আপনি’ বলিয়া সম্বোধন করি, কিন্তু তিনি কখনও আমাকে ‘আপনি’ বলিবেন না, তিনি আমাকে ‘তুমি’ বলিবেন, ভুলক্রমেও তিনি আমাকে ‘আপনি’ বলিবেন না; যদি বলেন, তাহাতে অমঙ্গল বুঝিতে হইবে।
গুরুজনদের প্রতি ভালবাসা বা শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে হইলে সেইরূপ, সর্বদা ঐ প্রকার ভাষাতেই করিতে হইবে। পিতামাতাকে তো দূরের কথা, বড় ভাই বা বোনকেও ‘তু’, ‘তুম্’ বা ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিতে আমার সাহসই হইবে না। আর মাতাপিতার নাম ধরিয়া আমরা কখনই ডাকি না। যখন আপনাদের দেশের প্রথা জানিতাম না, তখন একটি খুবই মার্জিত-রুচি পরিবারে পুত্রকে জননীর নাম ধরিয়া ডাকিতে দেখিয়া আমি গভীরভাবে মর্মাহত হইয়াছিলাম। যাহা হউক, পরে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। বুঝিলাম, ইহাই এই দেশের রীতি। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা কখনই পিতামাতার উপস্থিতিতে তাঁহাদের নাম উচ্চারণ করি না। এমন কি তাঁহাদের সামনেও ‘প্রথম পুরুষের বহুবচন’-এ উল্লেখ করি। এইরূপে আমরা দেখি যে, ভারতীয় নারী-পুরুষের সমাজ-জীবনে এবং সম্পর্কের তারতম্যে জটিলতম জাল বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে। আমাদের দেশে গুরুজনদের সম্মুখে কেহ স্ত্রীর সহিত কথা বলে না। একাকী যখন অপর কেহ থাকে না বা শুধু ছোটরা থাকে, তখনই স্ত্রীর সহিত কথাবার্তা বলা যায়। যদি আমি বিবাহ করিতাম, তাহা হইলে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রীর সামনে স্ত্রীর সহিত কথা বলিতাম, কিন্তু বড় বোন বা পিতামাতার সম্মুখে বলিতাম না। ভগিনীদের নিকট তাহাদের স্বামী সম্বন্ধে কোন কথা আমি বলিতে পারি না। ভাবটি এই যে, আমরা সন্ন্যাস-কেন্দ্রিক জাতি। এই একটি ভাবের উপর সমগ্র সমাজ-ব্যবস্থার দৃষ্টি নিবদ্ধ রহিয়াছে। বিবাহকে একটা অপবিত্র, একটা নিম্ন পর্যায়ের ব্যাপার বলিয়া মনে করা হয়। সেইজন্য প্রেমের বিষয় লইয়া কোন আলোচনা কখনও করা চলিবে না। মা, ভাই, বোন বা অপর কাহারও সামনে আমি কোন উপন্যাস পড়িতে পারি না। তাঁহারা আসিলে উপন্যাসটি বন্ধ করিয়া দিই।
পান-ভোজনের ব্যাপারেও এই একই রীতি। আমরা গুরুজনদের সম্মুখে আহার করি না। শিশু বা সম্পর্কে ছোট না হইলে কোন পুরুষের সম্মুখে আমাদের মেয়েরা কখনও আহার করে না। মেয়েরা বলে, ‘মরিয়া যাইব, তবু স্বামীর সম্মুখে কিছু চিবাইতে পারিব না।’ মাঝে মাঝে ভাই ও বোনেরা একত্র খাইতে বসিতে পারে। ধরুন আমি এবং আমার ভগিনী একসঙ্গে খাইতেছি, এমন সময় ভগিনীর স্বামী দরজার গোড়ায় আসিয়া পড়িল— তখনই ভগিনী খাওয়া বন্ধ করিয়া দিবে, আর স্বামী-বেচারা সরিয়া পড়িবে।
যে-সব প্রথা আমাদের দেশের একান্ত নিজস্ব, সেইগুলি আমি বলিলাম। ইহাদের ভিতর কতকগুলি আমি অন্যান্য দেশেও লক্ষ্য করিয়াছি। আমি কখনও বিবাহ করি নাই। বধূসম্বন্ধীয় জ্ঞান আমার সম্পূর্ণ নয়। মাতা এবং ভগিনী যে কি, তাহা আমি জানি; অপরের বধূ আমি দেখিয়াছি মাত্র, তাহা হইতে যেটুকু জ্ঞান সংগ্রহ করিয়াছি, তাহাই আপনাদের বলিলাম।
শিক্ষা এবং সংস্কৃতি নির্ভর করে পুরুষের উপর; অর্থাৎ যেখানে পুরুষেরা উচ্চসংস্কৃতিসম্পন্ন, সেখানে মেয়েরাও ঐরূপ হইবে। যেখানে পুরুষদের সংস্কৃতি নাই, সেখানে মেয়েদেরও নাই। অতি প্রাচীনকাল হইতে হিন্দুপ্রথা-অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামীণ ব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল। স্মরণাতীত কাল হইতে সমস্ত ভূমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হইয়াছিল। আপনাদের ভাষায় এগুলি ছিল সরকারের। জমির উপর কাহারও কোন ব্যক্তিগত অধিকার নাই। ভারতবর্ষে রাজস্ব জমি হইতে আসে, কারণ প্রত্যেকে সরকার হইতে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ভোগ করে। এই জমি একটি গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পত্তি, এবং পাঁচ দশ কুড়ি বা একশ-টি পরিবার একত্র ঐ জমি দখলে রাখিতে পারে। সমস্ত জমি তাহারাই নিয়ন্ত্রণ করে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব তাহারা সরকারকে দেয় এবং একটি চিকিৎসক এবং শিক্ষকের ভরণপোষণ করে, ইত্যাদি।