আমাদের শাস্ত্র এইরূপ বলেঃ গর্ভকালীন প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ কর। জননীকে কেন পূজা করিতে হয়? কারণ তিনি নিজেকে পবিত্র করিয়াছেন। পবিত্রতা স্বরূপিণী হইবার জন্য তিনি দুশ্চর তপস্যা করিয়াছেন। আপনারা স্মরণ রাখিবেন, ভারতবর্ষে কোন নারী কোন পুরুষকে দেহ দান করার কথা ভাবিতেই পারেন না, দেহ তাঁহার নিজস্ব। যাহাকে দাম্পত্য অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে, ইংরেজরা সমাজসংস্কার হিসাবে বর্তমান ভারতবর্ষে তাহা প্রবর্তন করিয়াছে; কিন্তু কোন ভারতবাসীই ঐ আইনের সুযোগ গ্রহণ করিবে না। পুরুষ যখন নারীর দেহ-সম্পর্কে আসে, তখন নারী কত না প্রার্থনা ও ব্রতদ্বারা ঐ মিলন পরিবেশকে নিয়ন্ত্রিত করে! কারণ যে-পথে শিশুর আগমন, তাহা যে স্বয়ং ঈশ্বরের পবিত্রতম প্রতীক। ইহা স্বামী-স্ত্রীর মিলিত শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা, যে-প্রার্থনা প্রচণ্ড ভাল অথবা মন্দ শক্তির সম্ভাবনাযুক্ত আর একটি জীবকে এই জগতে লইয়া আসিতেছে। ইহা কি একটা হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার? ইহা কি শুধু ইন্দ্রিয়ের পরিতৃপ্তি? ইহা কি দেহের পাশবিক সুখসম্ভোগ? হিন্দু বলে, ‘না, না, সহস্রবার না।’
কিন্তু এইটির অনুগামী আর একটি ভাব আছে। সর্বংসহা সর্বক্ষমাশীলা জননীর প্রতি ভালবাসার আর্দশ লইয়া আমাদের আলোচনা আরম্ভ হইয়াছিল। জননীকে যে পূজা করা হয়, তাহার উৎস এইখানেই। আমাকে পৃথিবীতে আনিবার জন্য তিনি তপস্বিনী হইয়াছিলেন। আমি জন্মাইব বলিয়া তিনি বৎসরের পর বৎসর তাঁহার শরীর-মন, আহার-পরিচ্ছদ, চিন্তা-কল্পনা পবিত্র রাখিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি পূজনীয়া। তারপর আমরা কোন্ ভাবটি পাই? মাতৃত্বের সহিত সংযুক্ত হইয়া আছে জায়াভাব।
আপনারা—পাশ্চাত্যদেশের লোকেরা—ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যপরায়ণ। আমি এই কাজটি করিতে চাই, যেহেতু আমি এটি পচ্ছন্দ করি। আমি সকলকে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিব। কেন? আমার খুশি। আমি নিজের পরিতৃপ্তি চাই, সেইজন্য আমি এই নারীটিকে বিবাহ করিব। কেন? আমি তাহাকে পছন্দ করি। এই নারী আমাকে বিবাহ করিয়াছে। কেন? সে আমাকে পছন্দ করে। এইখানেই ইহার পরিসমাপ্তি। এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে সে আর আমি—এই দুইজনেই আছি, আমি তাহাকে এবং সে আমাকে বিবাহ করিয়াছে। ইহাতে কাহারও কোন ক্ষতি নাই, আর কাহারও কোন দায়িত্ব নাই। আপনাদের শ্রীমান্ ও শ্রীমতীরা বনে গিয়া তাহাদের রুচিমত জীবন যাপন করিতে পারে। কিন্তু তাহাদের যখন সমাজে বাস করিতে হয়, তখন তাহাদের বিবাহ আমাদের শুভাশুভের সহিত জড়িত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাহাদের সন্তানগণ অগ্নিসংযোগকারী, হত্যাকারী দস্যু, পরস্বাপহারী, মদ্যপ, জঘন্যাচারী ও ক্রূরকর্মা—সাক্ষাৎ দানব হইতে পারে।
এখন ভারতবর্ষের সমাজ-ব্যবস্থার ভিত্তি কি? ইহা বর্ণভিত্তিক বিধান। আমার জন্ম—বর্ণ বা জাতির জন্য, তাহার জন্যই আমার জীবন। অবশ্য আমার নিজের কথা বলিতেছি না। সন্ন্যাস গ্রহণ করিবার ফলে আমরা জাতি-বর্ণের বহির্ভূত। যাহারা সমাজে বাস করে, আমি তাহাদের কথা বলিতেছি। কোন এক বর্ণে জন্ম বলিয়া সেই বর্ণের ধর্মানুযায়ী আমাকে সমস্ত জীবন যাপন করিতেই হইবে। অর্থাৎ আপনাদের দেশের আধুনিক ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, পাশ্চাত্য মানব আজন্ম স্বাতন্ত্র্যবাদী, আর হিন্দু সমাজতান্ত্রিক, পুরাপুরি সমাজতান্ত্রিক। সেইজন্য শাস্ত্র বলে যে, যদি পুরুষকে তাহার মনের মত যে-কোন নারী বিবাহ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং নারীকেও তাহার মনের মত যে-কোন পুরুষকে বিবাহ করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তখন কি হয়? তুমি প্রেমে পড়। মেয়েটির পিতা হয়তো উন্মাদ বা যক্ষ্মারোগী। মেয়েটি হয়তো একটি পাঁড়-মাতাল ছেলের মুখ দেখিয়া মুগ্ধ হইল। সমাজবিধি কি বলে? ধর্মের অনুশাসনে এই-সব বিবাহ অবৈধ। মদ্যপায়ী, ক্ষয়রোগী, উন্মাদ প্রভৃতির সন্তানদিগকে বিবাহ করিতে দেওয়া হইবে না। ধর্ম বলে, বিকলাঙ্গ কুব্জ বিকৃতবুদ্ধি জড়বৎ ব্যক্তিদের বিবাহ একেবারে নিষিদ্ধ।
কিন্তু মুসলমানরা আরব হইতে ভারতবর্ষে আসিল, তাহাদের আছে আরবী আইন, আর আরবের মরুভূমির আইন আমাদের উপর জোর করিয়া চাপানো হইল। ইংরেজরা আসিল তাহাদের আইন লইয়া। যতদূর সাধ্য তাহাও আমাদের উপর চালু করিল। আমরা পরাজিত জাতি। ইংরেজ যদি বলে, ‘কাল তোমার ভগিনীকে বিবাহ করিব’, আমরা কি করিতে পারি?
আমাদের সমাজ-বিধানে বলে, পরস্পরের মধ্যে রক্ত-সম্পর্কের দূরত্ব যতই থাকুক না কেন, এক জ্ঞাতিগোত্রের ভিতর বিবাহ অবৈধ। কারণ ঐরূপ বিবাহের দ্বারা জাতির অধোগতি হয়, বংশ লোপ পায়। কিছুতেই এ ধরনের বিবাহ হইতে পারে না এবং এইখানেই এ প্রসঙ্গ থামিয়া যায়। সুতরাং আমার বিবাহ-ব্যাপারে আমার নিজের কোন মত নাই, আমার ভগিনীর বিবাহ-ব্যাপারে—তাহারও মতামত কিছু নাই। জাতি-বর্ণের অনুশাসনের দ্বারা সব কিছু নির্ধারিত হয়।
অনেক সময় আমাদের দেশে শৈশবেই বিবাহ দেওয়া হয়। কেন? সমাজের আদেশ। পুত্র-কন্যাদের সম্মতি ছাড়াই যদি তাহাদের বিবাহ দিতে হয়, তাহা হইলে প্রেমের উন্মেষের পূর্বে শৈশবেই বিবাহ দেওয়া উচিত। যদি তাহারা পৃথক্ভাবে বড় হয়, তাহা হইলে বালকের হয়তো অন্য আর একটি বালিকাকে ভাল লাগিতে পারে এবং বালিকাও হয়তো আর একটি বালককে পচ্ছন্দ করিতে পারে। ফলে একটা মন্দ কিছু ঘটিতে পারে। সেইজন্য সমাজ বলে যে, ঐখানেই উহা বন্ধ করিয়া দাও। আমার ভগিনী বিকলাঙ্গ সুশ্রী বা কুশ্রী, তাহা আমি গ্রাহ্যই করি না, সে আমার ভগিনী—ইহাই যথেষ্ট। সে আমার ভ্রাতা—এইটুকু জানিলেই আমার যথেষ্ট হইল। সুতরাং তাহারা পরস্পরকে ভালবাসিবে। আপনারা বলিতে পারেন, ‘অনেকখানি আনন্দ হইতে তাহারা বঞ্চিত। পুরুষের পক্ষে একটি নারীর প্রেমে পড়ার এবং নারীর পক্ষে একজন পুরুষের প্রেমে পড়ার কি অপূর্ব হৃদয়াবেগ, সে আনন্দ হইতে তাহারা বঞ্চিত হয়। ইহা তো ভ্রাতা-ভগিনীর ভালবাসার মত। যেন ভালবাসিতে তাহারা বাধ্য।’ ভাল, তাহাই হউক। কিন্তু হিন্দু বলে, ‘আমরা সমাজতান্ত্রিক। একটি পুরুষ বা নারীর তীব্র সুখের জন্য আমরা শত শত লোকের মস্তকে দুঃখের বোঝা চাপাইতে চাই না।’