সর্বপ্রকার উন্নতি, অগ্রগতি, কল্যাণ কিংবা অবনতি—সবই আপেক্ষিক। ইহা কোন একটি মান নির্দেশ করে; কোন মানুষকে বুঝিতে হইলে পূর্ণত্ব সম্বন্ধে তাহার স্বকীয় মানের পরিপেক্ষিতে তাহাকে বুঝিতে হইবে। জাতিগত জীবনে এইটি স্পষ্টতরভাবে দেখিতে পাইবেন। এক জাতি যাহা ভাল বলিয়া মনে করে, অন্য জাতি তাহা ভাল নাও বলিতে পারে। আপনাদের দেশে জ্ঞাতি-ভাইবোনের মধ্যে বিবাহ খুবই সঙ্গত, কিন্তু ভারতে ঐরূপ বিবাহ আইন-বিরুদ্ধ; শুধু তাই নয়, উহাকে অতি ভয়ানক নিষিদ্ধ যৌন-সংসর্গ মনে করা হয়। এ দেশে বিধবা-বিবাহ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। ভারতে উচ্চবর্ণের নারীর দুইবার বিবাহ চরম মর্যাদাহানিকর। অতএব দেখিতেছেন, আমরা এত বিভিন্ন ভাবের ভিতর দিয়া কাজ করি যে, একটি জাতিকে অপর জাতির মানদণ্ডের দ্বারা বিচার করা উচিত হইবে না, ইহা সম্ভবও নয়। অতএব একটি জাতি কোন্ আদর্শকে তাহার সামনে রাখিয়াছে, তাহা জানা আমাদের কর্তব্য। বিভিন্ন জাতির প্রসঙ্গে প্রথমেই আমরা একটা ধারণা করিয়া বসি যে, সকল জাতির নৈতিক নিয়মাবলী ও আদর্শ এক। যখন অপরকে বিচার করিতে যাই, তখন ধরিয়া লই যে, আমরা যাহা ভাল বলিয়া মনে করি, তাহা সকলের পক্ষেই ভাল হইবে। আমরা যাহা করি, তাহাই উচিত কর্ম; আমরা যাহা করি না, অপরে তাহা করিলে ঘোর নীতিবিরুদ্ধ হইবে। সমালোচনার উদ্দেশ্যে আমি এ-কথা বলিতেছি না, কেবল সত্যকে আপনাদের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া ধরিতেছি। যখন শুনি পদতলে সঙ্কুচিত করার জন্য পাশ্চাত্য নারীগণ চীনা মেয়েদের ধিক্কার দেয়, তখন তাহারা চিন্তা করে না তাহাদের আঁটসাঁট কাঁচুলি ব্যবহার জাতির অধিকতর ক্ষতি করিতেছে। ইহা একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। আপনারা অবশ্যই জানেন, কর্সেট ব্যবহারে শরীরের যতটা ক্ষতি হইয়াছে বা হইতেছে, পদতল সঙ্কুচিত করায় তার লক্ষ ভাগের এক ভাগ ক্ষতিও হয় না। কারণ প্রথমোক্ত উপায়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ স্থানচ্যুত হয় এবং মেরুদণ্ডটি সাপের মত বাঁকিয়া যায়। যদি মাপ নেওয়া হয়, তাহা হইলে ঐ বক্রতা লক্ষ্য করিতে পারিবেন। দোষ দেখাইবার জন্য নয়, শুধু অবস্থাটি বুঝাইবার জন্য বলিতেছি। আপনারা অন্য দেশের নারীদের অপেক্ষা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করেন এবং তাহারা আপনাদের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করে না বলিয়া তাহাদের ব্যবহারে আপনারা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হন। ঠিক একই কারণে অন্যান্য জাতির নারীগণও আপনাদের কথা ভাবিয়া শিহরিত হয়।
সুতরাং দুই পক্ষের ভিতরই একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। একটা সাধারণ মিলনভূমি, একটা সর্বজনীন বোধের ক্ষেত্র ও একটা সাধারণ মানবতা আছে, যাহা আমাদের কর্মের ভিত্তি হইবে। আমাদের সেই পূর্ণ ও নির্দোষ মানবপ্রকৃতি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, যাহা এখন শুধু আংশিকভাবে এখানে ওখানে কাজ করিতেছে। পূর্ণত্বের চরম বিকাশ একটি মানুষে সম্ভব নয়। আপনি একটি অংশকে রূপ দিন, আমিও আমার সাধ্যমত সামান্যভাবে আর একটি অংশ রূপায়িত করি। এখানে একজন একটি ক্ষুদ্র অংশ গ্রহণ করে, অন্যত্র আর একজন আর একটি অংশ গ্রহণ করে। পূর্ণত্ব হইল এই সমস্ত অংশের সমষ্টিরূপ। ব্যষ্টির ক্ষেত্রে যেমন, জাতির ক্ষেত্রেও সেইরূপ। প্রত্যেক জাতিকেই একটি ভূমিকা অভিনয় করিতে হয়; প্রত্যেক জাতিকে মানব স্বাভাবের একটি দিক্ বিকশিত করিতে হয়; এবং আমাদিগকে এই সমস্তই একসঙ্গে গ্রথিত করিতে হইবে। সম্ভবতঃ সুদূর ভবিষ্যতে এমন এক জাতির উদ্ভব হইবে, যে-জাতির ভিতর বিভিন্ন জাতিদ্বারা অর্জিত বিস্ময়কর উৎকর্ষগুলি প্রকাশিত হইবে এবং উহা আর একটি নূতন জাতিরূপে দেখা দিবে। এই জাতির মত একটি জাতির কথা মানুষ এখনও কল্পনা করিতে পারে নাই। এইটুকু বলা ছাড়া কাহারও সমালোচনা করিয়া আমার বলিবার কিছু নাই। জীবনে ভ্রমণ বড় কম করি নাই। সর্বদা চক্ষু খুলিয়া রাখিয়াছি এবং যতই আমি ঘুরি, ততই আমার মুখ বন্ধ হইয়া যায়, সমালোচনা করিতে আর পারি না।
এখন ‘ভারতীয় নারী’র প্রসঙ্গ। ভারতে জননীই আদর্শ নারী। মাতৃভাবই ইহার প্রথম ও শেষ কথা। ‘নারী’-শব্দ হিন্দুর মনে মাতৃত্বকেই স্মরণ করাইয়া দেয়। ভারতে ঈশ্বরকে ‘মা’ বলিয়া সম্বোধন করা হয়। আমাদের শৈশবে প্রতিদিন প্রাতঃকালে একপাত্র জল লইয়া মায়ের কাছে রাখিতে হয়। তিনি তাঁহার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উহাতে ডুবাইয়া দেন এবং আমরা ঐ জল পান করি।
পাশ্চাত্যে নারী জায়া। সেখানে জায়ারূপেই নারীত্বের ভাবটি কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে—নারীত্বের সমগ্র শক্তি মাতৃত্বে ঘনীভূত হইয়াছে। পাশ্চাত্যে স্ত্রীই গৃহকর্ত্রী, ভারতীয় গৃহে কর্ত্রী—জননী। পাশ্চাত্যে গৃহে যদি মা আসেন, তবে তাঁহাকে (ছেলের) স্ত্রীর অধীন হইয়া থাকিতে হইবে; ঘরকরনা স্ত্রীর। মা সর্বদা আমাদের গৃহেই বাস করেন; স্ত্রীকে তাঁহার অধীনে থাকিতেই হইবে। ভাবের এই-সব প্রভেদ আপনারা লক্ষ্য করুন।
আমি কেবল তুলনার প্রস্তাব করিতেছি। প্রকৃত তথ্য উল্লেখ করিতেছি, যাহাতে আমরা দুই দিকের তুলনা করিতে পারি। এই তুলনাটি করুনঃ যদি আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, ‘স্ত্রী-রূপে ভারতীয় নারীর স্থান কোথায়?’ এই প্রশ্নে ভারতবাসী প্রতিপ্রশ্ন করিবে, ‘জননী-রূপে মার্কিন মহিলার মার্যাদা কি?’ সেই সর্বমহিমময়ী, যিনি আমায় এই শরীর দিয়াছেন তিনি কোথায়? নয় মাস যিনি আমাকে তাঁর শরীরে ধারণ করিয়াছেন, তিনি কোথায়? কোথায় তিনি, যিনি আমার প্রয়োজন হইলে বার বার জীবন দিতে প্রস্তুত? কোথায় তিনি, আমার প্রতি যাঁহার স্নেহ অফুরন্ত—তা আমি যতই দুষ্ট ও হীনপ্রকৃতি হই না কেন? কোথায় সেই জননী—আর কোথায় স্ত্রী, যে নারী স্বামীর দ্বারা সামান্য অবহেলিত হইলে বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য আদালতের আশ্রয় লয়? অহো মার্কিন মহিলাবৃন্দ, আপনাদের ভিতর কোথায় সেই জননী? আপনাদের দেশে তাঁহাকে আমি খুঁজিয়া পাই না। আপনাদের দেশে আমি এমন পুত্র দেখি নাই, যাহার কাছে জননীর স্থান সর্বপ্রথম। যখন আমরা দেহত্যাগ করি, তখনও আমরা চাই না যে, আমাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারা আমাদের জননীর স্থান গ্রহণ করে। ধন্য আমাদের জননী! যদি মায়ের পূর্বে আমাদের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আবার মায়ের কোলেই মাথা রাখিয়া আমরা মরিতে চাই। কোথায় নারী? ‘নারী’ কি এমনই একটি শব্দ, যাহা কেবল স্থূল দেহের সঙ্গে যুক্ত? হিন্দু-মন সেই-সব আদর্শকে ভয় করে, যেগুলি অনুসারে দেহ দেহেই আসক্ত হইবে। না, না! নারী, দেহ-সংক্রান্ত কোন কিছুর সহিত তুমি যুক্ত হইবে না। তোমার নাম চিরকালের জন্য পবিত্র বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ‘মা’- নাম ছাড়া এমন কি শব্দ আছে, যাহাকে কোনপ্রকার কামভাব স্পর্শ করিতে পারে না, কোনপ্রকার পশুভাব যাহার নিকটে আসিতে পারে না? এই মাতৃত্বই ভারতবর্ষের আদর্শ।