বই-পড়া জ্ঞানের ওপর ধর্ম নির্ভর করে না। ধর্ম আত্মাই, ধর্ম ঈশ্বর, শুধু বই-পড়া জ্ঞান বা বক্তৃতা-শক্তির দ্বারা ধর্ম লাভ হয় না। সব চেয়ে বিদ্বান্ ব্যক্তিকে বল—আত্মাকে আত্মা-রূপে চিন্তা করতে, তিনি পারবেন না। আত্মার সম্বন্ধে তুমি একটা কল্পনা করতে পার, তিনিও পারেন। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষা ব্যতীত আত্মস্বরূপে চিন্তা অসম্ভব। ঈশ্বর-তত্ত্ব যতই শোন না কেন—তুমি একজন বড় দার্শনিক, আরও বড় ঈশ্বর-তত্ত্বজ্ঞ হতে পার—তবু একটি হিন্দু বালক বলবে ‘ওর সঙ্গে ধর্মের কিছু সম্বন্ধ নেই। আত্মাকে আত্মস্বরূপে চিন্তা করতে পার?’ তা হলে সকল সংশয়ের শেষ, তা হলেই মনের সব বাঁকাচোরা সোজা হয়ে যাবে। জীবাত্মা (মানুষ) যখন পরমাত্মার (ঈশ্বরের) সম্মুখীন হয়, তখনই সব ভয় শূন্যে মিলিয়ে যায়, সব সন্দিগ্ধ চিন্তা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়।
পাশ্চাত্যের বিচারে কোন ব্যক্তি অদ্ভুত বিদ্বান্ হতে পারেন, তবু তিনি হয়তো ধর্ম বিষয়ে ‘অ, আ, ক, খ’ না জানতে পারেন। আমি তাঁকে তাই বলব। জিজ্ঞাসা করব, ‘আপনি কি আত্মাকে আত্মা বলে ভাবতে পারেন? আপনি কি আত্ম-বিষয়ক বিজ্ঞানে পারদর্শী? আপনি জড়ের ঊর্ধ্বে নিজ আত্মাকে বিকশিত করেছেন?’ যদি তা না করে থাকেন, তা হলে তাঁকে বলব, ‘আপনার ধর্ম লাভ হয়নি, যা হয়েছে তা শুধু কথা, শুধু বই, শুধু বৃথা গর্ব!’
আর ঐ ‘হতভাগ্য’ হিন্দুটি মূর্তির সামনে বসে দেবতার সঙ্গে তাদাত্ম্য চিন্তা করবার চেষ্টা করে শেষে বলে, ‘হে ঈশ্বর, পারলাম না তোমায় আত্মস্বরূপে ধারণা করতে, অতএব এই সাকার মূর্তিতেই তোমায় চিন্তা করি।’ তখন সে চোখ খোলে, ঈশ্বরের রূপ প্রত্যক্ষ করে, প্রণাম করে বার বার প্রার্থনা করে। প্রার্থনার শেষে আবার বলে, ‘হে ঈশ্বর, আমায় ক্ষমা কর, তোমার এই অসম্পূর্ণ পূজার জন্য।’
তোমরা কেবল শুনে আসছ, হিন্দুরা পাথর পূজা করে। তাদের অন্তরের প্রকৃতি সম্বন্ধে তোমরা কি ভাব? এই দেখ, আমি হচ্ছি ইতিহাসে প্রথম হিন্দু সন্ন্যাসী, যে সমুদ্র পেরিয়ে এই পাশ্চাত্য দেশে এসেছে। এসে অবধি শুনছি, তোমাদের সমালোচনা, তোমাদের ঐ-সব কথা। তোমাদের সম্বন্ধে আমার দেশের লোকের ধারণা কি? তারা হাসে আর বলে, ‘ওরা শিশু; প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে ওরা বড় হতে পারে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড জিনিষ ওরা তৈরি করতে পারে, কিন্তু ধর্ম-ব্যাপারে ওরা একেবারে শিশু!’ এই হল তোমাদের সম্বন্ধে আমার দেশের লোকের ধারণা।
একটি কথা তোমাদের বলব, কোন নিষ্ঠুর সমালোচনা করছি না। তোমরা কতকগুলি মানুষকে শিক্ষিত কর, খেতে দাও, পরতে দাও, মাইনে দাও—কি কাজের জন্য? তারা আমার দেশে এসে আমার পূর্বপুরুষদের অভিসম্পাত করে, আমার ধর্মকে গাল দেয়, আমার দেশের সব কিছুকে মন্দ বলে। তারা মন্দিরের ধার দিয়ে যেতে বলে, ‘এই পৌত্তলিকের দল, তোরা নরকে যাবি!’ তারা কিন্তু মুসলমানদের একটিও কথা বলতে সাহস করে না, জানে—এখনি খাপ থেকে তলোয়ার বেরিয়া পড়বে! হিন্দু বড় নিরীহ, সে একটু হাসে, চলে যাবার সময় বলে যায়, ‘মূর্খেরা যা বলবার বলুক।’ এই হল তাদের ভাব। তোমরা, যারা গালাগাল দেবার জন্যে মানুষকে শিক্ষিত করে তোল, তারা আমার সামান্য সমালোচনায় আঁতকে উঠে চীৎকার কর, ‘সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত আমাদের ছুঁয়ো না, আমরা আমেরিকান। আমরা দুনিয়া সুদ্ধ লোকের সমালোচনা করব, গাল দেব, শাপ দেব, যা খুশি বলব, কিন্তু আমাদের ছুঁয়ো না, আমরা বড় স্পর্শকাতর—লজ্জাবতী লতা।’
তোমরা যা খুশি করতে পার; আমরাও যে-ভাবে আছি সে-ভাবেই সন্তুষ্ট আছি। একটা বিষয়ে আমরা তোমাদের থেকে ভাল আছি, আমরা আমাদের ছেলেদের এই অদ্ভুত তথ্য গেলাই না যে—পৃথিবীতে সব পবিত্র, শুধু মানুষই খারাপ! তোমাদের ধর্মপ্রচারকেরা যখন আমাদের সমালোচনা করে, তারা যেন মনে রাখে—সমস্ত ভারতবাসী যদি দাঁড়িয়ে ওঠে এবং ভারতসমুদ্রের তলায় যত মাটি আছে, সব যদি পাশ্চাত্য দেশগুলির প্রতি ছুঁড়তে থাকে, তা হলেও তোমরা আমাদের প্রতি যা করে থাক, তার কোটি ভাগের এক ভাগও করা হবে না। কেন, কি জন্যে? আমরা কি কোন দিন কোথাও ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছি—কাউকে ধর্মান্তরিত করবার জন্যে? আমরা তোমাদের বলি, ‘তোমার ধর্মকে স্বাগত জানাচ্ছি, কিন্তু আমাকে আমার ধর্ম নিয়ে থাকতে দাও।’ তোমরা বলে থাক—তোমাদের ধর্ম প্রসারশীল, তোমরা আক্রমণধর্মী। কিন্তু কত জনকে নিতে পেরেছ তোমার মতে? পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ চীনা, তারা বৌদ্ধ; তারপর আছে জাপান, তিব্বত, রাশিয়া, সাইবেরিয়া, বর্মা, শ্যাম। শুনতে হয়তো ভাল লাগবে না, কিন্তু জেনে রেখ—এই যে খ্রীষ্টনীতি, এই ক্যাথলিক চার্চ, সবই বৌদ্ধধর্ম থেকে নেওয়া। কি ভাবে এটা হয়েছিল? এক ফোঁটা রক্তপাত না করে। এত ডম্ফাই তোমাদের, কিন্তু বল তো—তলোয়ার ছাড়া খ্রীষ্টান ধর্ম কোথায় সফল হয়েছে? সারা পৃথিবীর মধ্যে একটি জায়গা দেখাও তো! খ্রীষ্টধর্মের ইতিহাস মন্থন করে আমাকে একটি দৃষ্টান্ত দাও, আমি দুটি চাই না। আমি জানি—তোমাদের পূর্বপুরুষেরা কি করে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাদের সম্মুখে দুটি বিকল্প ছিল, হয় ধর্মান্তর-গ্রহণ, নয় মৃত্যু—এই তো! যতই গর্ব কর, মুসলমানদের থেকে তোমরা কী ভাল করতে পার? ‘আমরাই একমাত্র শ্রেষ্ঠ!’ কেন? ‘কারণ আমরা অপরকে হত্যা করতে পারি।’ আরবরা তাই বলেছিল, তারাও ঐ বড়াই করেছিল, কোথায় তারা আজ? আজও তারা বেদুইন! রোমানরাও ঐ কথা বলত, কোথায় তারা?