জাতিভেদ-প্রথার সহিত ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। কোন ব্যক্তি তাহার বৃত্তি প্রাপ্ত হয়—উত্তরাধিকারসূত্রে; সূত্রধর সূত্রধর-রূপেই জন্মগ্রহণ করে, স্বর্ণকার স্বর্ণকার-রূপেই, শ্রমিক শ্রমিক-রূপেই এবং পুরোহিত পুরোহিত-রূপেই।
দুই প্রকার দান বিশেষ প্রশংসার্হ, বিদ্যাদান আর প্রাণদান। বিদ্যাদানের স্থান সর্বাগ্রে। অপরের জীবন রক্ষা করা উত্তম কর্ম, বিদ্যাদান অধিকতর উত্তম কর্ম। অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদান পাপ, পণ্যের ন্যায় অর্থের বিনিময়ে যিনি বিদ্যা বিক্রয় করেন, তিনি নিন্দার্হ। সরকার মধ্যে মধ্যে এই-সকল শিক্ষাদাতাকে সাহায্য প্রদান করেন এবং তাহার নৈতিক ফল তথাকথিত কোন কোন সুসভ্য দেশে যে-ব্যবস্থা বর্তমান, তাহা অপেক্ষা উত্তম।
বক্তা এ-দেশের সর্বত্র সভ্যতার সংজ্ঞা-সম্পর্কে প্রশ্ন করিয়াছেন। এ প্রশ্ন তিনি অন্যান্য দেশেও করিয়াছেন। অনেক সময় উত্তরের মর্ম হইতঃ আমরা যাহা, তাহাই সভ্যতা। তিনি উক্ত সংজ্ঞা মানিয়া লইতে পারেন নাই।
তাঁহার মতেঃ কোন জাতি জলে স্থলে এমন কি সমস্ত পঞ্চভূতের উপর আধিপত্য লাভ করিতে পারে এবং জীবনের উপযোগিতা-বিষয়ক সমস্যাগুলির আপাত-সমাধান করিতে পারে, তথাপি সভ্যতা ব্যক্তি-জীবনের বাস্তব হইয়া উঠে না। যে আপন আত্মাকে জয় করিতে পারিয়াছে, সভ্যতার পরাকাষ্ঠা তাহারই মধ্যে পরিস্ফুট। জগতে অন্য দেশ অপেক্ষা ভারতেই এইরূপ অবস্থা অধিক দৃষ্ট হয়—কারণ সেখানে ঐহিক বিষয় গৌণ, আধ্যাত্মিকতার সহায়কমাত্র। ভারতীয়গণ প্রাণসত্তায় উজ্জীবিত সকল বস্তুর মধ্যে আত্মার বিকাশ দর্শন করেন, এবং প্রকৃতি-সম্বন্ধে জ্ঞান তাঁহারা এই দৃষ্টিকোণ হইতেই অর্জন করেন। সুতরাং অদম্য ধৈর্যেরস হিত কঠিনতম দুর্ভাগ্য সহ্য করিবার মত ধীর প্রকৃতি এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দেশবাসী অপেক্ষা অধিকতর শক্তি ও জ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ সচেতনতা ভারতে রহিয়াছে। সেইজন্য সেখানে এমন একটি জাতি আছে, যাহাদের নিরবচ্ছিন্ন জীবনধারা দূরদূরান্তের চিন্তানায়কদের আকৃষ্ট করিয়াছে এবং তাহাদের স্কন্ধ হইতে পীড়াদায়ক সাংসারিক বোঝা লাঘব করিতে আহ্বান জানাইয়াছে।
এই বক্তৃতার মুখবন্ধে বলা হয় যে, বক্তাকে বহু প্রশ্ন করা হইয়াছে, তন্মধ্যে কতকগুলির উত্তর তিনি ব্যক্তিগতভাবে দিতে ইচ্ছা করেন। কিন্তু তিনটি প্রশ্নের উত্তর তিনি বক্তৃতামঞ্চ হইতেই দিলেন। এই তিনটিকে নির্বাচন করিবার কারণ ক্রমশঃ জানা যাইবে। এই তিনটি প্রশ্ন হইলঃ (১) ভারতবাসীরা কি তাহাদের সন্তানদের কুমিরের মুখে সমর্পণ করে? (২) তাহারা কি নিজেদের জগন্নাথের রথচক্রের নিম্নে নিক্ষেপ করে? (৩) তাহারা কি বিধবাদিগকে মৃত স্বামীর সহিত একত্র অগ্নিদগ্ধ করিয়া হত্যা করে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর তিনি সেই সুরেই দিলেন, যে-সুরে একজন আমেরিকাবাসী বিদেশে ভ্রমণকালে—নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় রেড-ইণ্ডিয়ানরা যথেচ্ছ ঘুরিয়া বেড়ায় কিনা, অথবা ইওরোপে আজও অনেকে বিশ্বাস করেন—এরূপ উপকথা-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেন! স্বামী বিবেকানন্দের নিকট উক্ত প্রথম প্রশ্নটি অত্যন্ত হাস্যকর এবং উত্তর-দানের অযোগ্য বলিয়াই মনে হইয়াছে।
যখন কতিপয় সদাশয় অথচ অজ্ঞ ব্যক্তির নিকট হইতে তিনি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন, ‘কি কারণে কেবল বালিকাদেরই কুমিরের মুখে সমর্পণ করা হয়?’—তখন তিনি বিদ্রূপ করিয়া উত্তর দেন, ‘বোধ হয় তাহারা অধিকতর নরম ও কোমল বলিয়া, এবং সেই তমসাচ্ছন্ন দেশের জলাশয়সমূহের অধিবাসিগণ দন্তদ্বারা সহজেই তাহাদের চর্বণ করিতে পারিবে বলিয়া এইরূপ করা হয়।’
জগন্নাথ-সম্পর্কিত গল্প সম্বন্ধে বক্তা পবিত্র নগরের—পুরীর প্রাচীন রথযাত্রা-উৎসব বর্ণনা করিয়া এই মন্তব্য করেন যে, সম্ভবতঃ রথের রজ্জু ধরিবার ও টানিবার আগ্রহাতিশয্যে কিছুসংখ্যক পুণ্যকামী ব্যক্তি পা পিছলাইয়া পড়িয়া গিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকিবে। এই ধরনের কিছু দুর্ঘটনা অতিরঞ্জিত হইয়া এমন বিকৃত আকার ধারণ করিয়াছে যে, অন্যান্য দেশের সহৃদয় ব্যক্তিগণ তাহা শ্রবণ করিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠেন।
বিধবাদের অগ্নিদগ্ধ করিয়া হত্যা করিবার কথা বিবেকানন্দ অস্বীকার করেন, এবং সত্য তথ্য উদ্ঘাটিত করিয়া বলেন, হিন্দু বিধবাগণ অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতেন স্বেচ্ছায়।
যে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটিতেছে, সেখানে মহাপ্রাণ ব্যক্তিরা, যাঁহারা সর্বকালে আত্মহত্যার বিরোধী, তাঁহারা বিধবাদের উক্ত কার্য হইতে বিরত হইবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছেন; এবং যে-সকল ক্ষেত্রে স্বাধ্বী বিধবাগণ লোকান্তরে স্বামীর সহগামী হইবার জন্য ঐকান্তিক আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন, তাঁহাদেরই এই অগ্নিপরিক্ষা দিতে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। অর্থাৎ যদি তাঁহারা হস্ত-দুইখানি অগ্নিতে সমর্পণ করিয়া দগ্ধ করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহাদের ঐকান্তিক বাসনা পূরণে আর কোন বাধা দেওয়া হইত না। কিন্তু ভারতই একমাত্র দেশ নয়, যেখানে নারী প্রেমবশতঃ স্বামীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তাঁহার অনুগমন করিয়া অমরলোকে গমন করিয়াছেন। এরূপ ক্ষেত্রে পৃথিবীর সকল দেশেই কিছু নারী প্রাণবিসর্জন করিয়াছে। যে-কোন দেশেই এই ধরনের আবেগ বিরল, এবং ভারতবর্ষেও ইহা অন্যান্য দেশের মতই নিত্যকার সাধারণ ব্যাপার নয়।