হে রাজন, হে রামনাদবাসী ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা যে দয়া প্রকাশ করিয়া হৃদয়ের সহিত আমাকে অভিনন্দন প্রদান করিয়াছেন, সেজন্য আপনারা আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনারা আমার প্রতি যে আন্তরিক ভালবাসা প্রকাশ করিতেছেন, তাহা আমি প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছি। কারণ মুখের ভাষা অপেক্ষা হৃদয়ে হৃদয়ে ভাববিনিময় অতি অপূর্ব—আত্মা নীরবে অথচ অভ্রান্ত ভাষায় অপর আত্মার সহিত আলাপ করেন, তাই আমি আপনাদের ভাব প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছি। হে রামনাদাধিপ, আমাদের ধর্ম ও মাতৃভূমির জন্য যদি এই দীন ব্যক্তি-দ্বারা পাশ্চাত্যদেশে যদি কোন কার্য নিষ্পন্ন হইয়া থাকে, যদি নিজ গৃহেই অজ্ঞাত ও গুপ্তভাবে রক্ষিত অমূল্য রত্নরাজির প্রতি আমাদের স্বদেশবাসীর চিত্ত আকৃষ্ট করিবার জন্য কোন কার্য কৃত হইয়া থাকে, যদি তাহারা অজ্ঞতাবশে তৃষ্ণার তাড়নায় প্রাণত্যাগ না করিয়া বা অপর স্থানের মলিন পয়ঃপ্রণালীর জলপান না করিয়া তাহাদের গৃহের নিকটবর্তী অফুরন্ত নির্ঝরের নির্মল জল পান করিতে আহূত হইয়া থাকে, যদি আমাদের স্বদেশবাসীকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে কর্মপরায়ণ করিবার জন্য—রাজনীতিক উন্নতি, সমাজসংস্কার বা কুবেরের ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও ধর্মই যে ভারতের প্রাণ, ধর্ম লুপ্ত হইলে যে ভারতও মরিয়া যাইবে, ইহা বুঝাইবার জন্য যদি কিছু করা হইয়া থাকে, হে রামনাদাধিপ, ভারত অথবা ভারতেতর দেশে আমাদ্বারা কৃত কার্যের জন্য প্রশংসার ভাগী আপনি। কারণ, আপনিই আমার মাথায় প্রথম এই ভাব প্রবেশ করাইয়া দেন এবং আপনিই পুনঃপুনঃ আমাকে কার্যে উত্তেজিত করেন। আপনি যেন অন্তর্দৃষ্টিবলে ভবিষ্যৎ জানিতে পারিয়া আমাকে বরাবর সাহায্য করিয়া আসিয়াছেন, কখনই উৎসাহদানে বিরত হন নাই। অতএব আপনি যে আমার সফলতায় প্রথম আনন্দ প্রকাশ করিতেছেন এবং আমি যে দেশে ফিরিয়া আপনার রাজ্যেই ভারতের মৃত্তিকা প্রথম স্পর্শ করিলাম, ইহা ঠিকই হইয়াছে।
হে ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের রাজা পূর্বেই বলিয়াছেন—আমাদিগকে বড় বড় কাজ করিতে হইবে, অদ্ভুত শক্তির বিকাশ দেখাইতে হইবে, অপর জাতিকে অনেক বিষয় শিখাইতে হইবে। দর্শন ধর্ম বা নীতিবিজ্ঞানই বলুন, অথবা মধুরতা কোমলতা বা মানবজাতির প্রতি অকপট প্রীতিরূপ সদ্গুণরাজিই বলুন, আমাদের মাতৃভূমি এই সব- কিছুরই প্রসূতি। এখনও ভারতে এইগুলি বিদ্যমান, আর পৃথিবী সম্বন্ধে যতটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমি এখন দৃঢ়ভাবে সাহসের সহিত বলিতে পারি, এখনও ভারত এই-সব বিষয়ে পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
এই আশ্চর্য ব্যাপারটি লক্ষ্য করিয়া দেখুন। গত চার-পাঁচ বৎসর ধরিয়া পৃথিবীতে অনেক গুরুতর রাজনীতিক পরিবর্তন ঘটিতেছে। পাশ্চাত্যদেশের সর্বত্রই বড় বড় সম্প্রদায় উঠিয়া বিভিন্ন দেশের প্রচলিত নিয়মপদ্ধতিগুলি একেবারে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিবার চেষ্টায় কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইতেছে; আমাদের দেশের লোককে জিজ্ঞাসা করুন, তাহারা এই- সকল কথা কিছু শুনিয়াছে কিনা। কিছুই শুনে নাই। কিন্তু চিকাগোয় ধর্মমহাসভা বসিয়াছিল, ভারত হইতে একজন সন্ন্যাসী প্রেরিত হইয়া সেখানে সাদরে গৃহীত হন এবং সেই অবধি পাশ্চাত্যদেশে কার্য করিতেছিলেন—এখানকার অতি দরিদ্র ভিক্ষুকও তাহা জানে। লোকে বলিয়া থাকে, আমাদের দেশের সাধারণ লোক বড় স্থূলবুদ্ধি, তাহারা দুনিয়ার কোন প্রকার সংবাদ রাখে না, রাখিতে চাহেও না। পূর্বে আমারও ঐ-প্রকার মতের দিকে একটা ঝোঁক ছিল; কিন্তু এখন বুঝিতেছি, কাল্পনিক গবেষণা অথবা ক্ষিপ্রগতিতে দেশ-দর্শক ও ভূ-পর্যটকগণের লিখিত পুস্তক-পাঠ অপেক্ষা অভিজ্ঞতা অনেক বেশী শিক্ষাপ্রদ।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে আমি এই জ্ঞানলাভ করিয়াছি যে, আমাদের দেশের সাধারণ লোক নির্বোধও নহে বা তাহারা যে জগতের সংবাদ জানিতে কম ব্যাকুল, তাহাও নহে; পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোক যেমন সংবাদ-সংগ্রহে আগ্রহশীল, ইহারাও সেইরূপ। তবে প্রত্যেক জাতিরই জীবনের এক-একটি উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেক জাতিই প্রাকৃতিক নিয়মে কতকগুলি বিশেষত্ব লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সকল জাতি মিলিয়া যেন এক মহা ঐকতান বাদ্যের সৃষ্টি করিয়াছে—প্রত্যেক জাতিই যেন উহাতে এক-একটি পৃথক্ পৃথক্ সুর সংযোজন করিতেছে। উহাই তাহার জীবনীশক্তি। উহাই তাহার জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড, মূলভিত্তি। আমাদের এই পবিত্র মাতৃভূমির মূলভিত্তি, মেরুদণ্ড বা জীবনকেন্দ্র—একমাত্র ধর্ম। অপরে রাজনীতির কথা বলুক, বাণিজ্য-বলে অগাধ ধনরাশি উপার্জনের গৌরব, বাণিজ্যনীতির শক্তি ও উহার প্রচার, বাহ্য স্বাধীনতালাভের অপূর্ব সুখের কথা বলুক। হিন্দু এই-সকল বুঝে না, বুঝিতে চাহেও না। তাহার সহিত ধর্ম, ঈশ্বর, আত্মা, মুক্তি-সম্বন্ধে কথা বলুন। আমি আপনাদিগকে নিশ্চয়ই বলিতেছি, অন্যান্য দেশের অনেক তথাকথিত দার্শনিক অপেক্ষা আমাদের দেশের সামান্য কৃষকের পর্যন্ত এই-সকল তত্ত্বসম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞান আছে। ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আপনাদিগকে বলিয়াছি, এখনও আমাদের জগৎকে শিখাইবার কিছু আছে। এই জন্যই শত শত বর্ষের অত্যাচার এবং প্রায় সহস্র বর্ষের বৈদেশিক শাসনের পীড়নেও এই জাতি এখনও জীবিত রহিয়াছে। এই জাতি এখনও জীবিত, কারণ এখনও এই জাতি ঈশ্বর ও ধর্মরূপ মহারত্নকে পরিত্যাগ করে নাই।