—————-
১ যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাদ্ বিস্ফু লিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে স্বরূপাঃ
তথাক্ষরাদ্ বিবিধাঃ সৌম্যভাবাঃ প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপি যন্তি।—মুণ্ডকোপনিষদৎ, ২।১।১
—————–
এই বিষয়টি নিম্নলিখিতভাবে বুঝানো যাইতে পারে। জ্ঞাতাকে কিরূপে জানা যাইবে?১ জ্ঞাতা কখনও নিজেকে জানিতে পারে না। আমি সবই দেখিতে পাই, কিন্তু নিজেকে দেখিতে পাই না। সেই আত্মা—তিনি জ্ঞাতা ও সকলের প্রভু, যিনি প্রকৃত বস্তু—তিনিই জগতের সমুদয় দৃষ্টির কারণ, কিন্তু তাহার পক্ষে প্রতিবিম্ব ব্যতীত নিজেকে দেখা বা নিজেকে জানা অসম্ভব। আপনি আরশি ব্যতীত আপনার মুখ দেখিতে পান না, সেরূপ আত্মাও প্রতিবিম্ব না হইলে নিজের স্বরূপ দেখিতে পান না। সুতরাং এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই আত্মার নিজেকে উপলব্ধির চেষ্টাস্বরূপ। আদি প্রাণকোষ (Protoplasm) তাঁহার প্রথম প্রতিবিম্ব, তারপর উদ্ভিদ্, পশু প্রভৃতি উৎকৃষ্ট ও উৎকৃষ্টতর প্রতিবিম্ব-গ্রাহক হইতে সর্বোত্তম প্রতিবিম্ব-গ্রাহক—পূর্ণ মানবের প্রকাশ হয়। যেমন কোন মানুষ নিজমুখ দেখিতে ইচ্ছা করিয়া একটি ক্ষুদ্র কর্দমাবিল জলপল্বলে দেখিতে চেষ্টা করিয়া মুখের একটা বাহ্য সীমারেখা দেখিতে পাইল। তারপর সে অপেক্ষাকৃত নির্মল জলে অপেক্ষাকৃত উত্তম প্রতিবিম্ব দেখিল, তরপর উজ্জল ধাতুতে ইহা অপেক্ষাও স্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখিল। শেষে একখানি আরশি লইয়া তাহাতে মুখ দেখিল—তখন সে নিজেকে যথাযথ ভাবে প্রতিবিম্ব দেখিল। অতএব বিষয় ও বিষয়ী উভয়-স্বরূপ সেই পুরুষের সর্বশ্রেষ্ট প্রতিবিম্ব—‘পূর্ণ মানব’। আপনারা এখন দেখিতে পাইলেন, মানব সহজ প্রেরণায় কেন সকল বস্তুর উপাসনা করিয়া থাকে, আর সকল দেশেই পূর্ণমানবগণ কেন স্বভাবতই ঈশ্বর রূপে পূজিত হইয়া থাকেন। আপনারা মুখে যাই বলুন না কেন, ইহাদের উপাসনা অবশ্যই করিতে হইবে। এজন্যই লোকে খ্রীষ্ট-বুদ্ধাদি অবতারগণের উপাসনা করিয়া থাকে। তাঁহারা অনন্ত আত্মার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ স্বরূপ। আপনি বা আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে যে কোন ধারণা করি না কেন, ইহারা তাহা অপেক্ষা উচ্চতর। একজন পূর্ণমানব এই সকল ধারণা হইতে অনেক উচ্চে। তাঁহাতেই জগৎরূপ বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়—বিষয় ও বিষয়ী এক হইয়া যায়। তাহার সকল ভ্রম ও মোহ চলিয়া যায়; পরিবর্তে তাহার এই অনুভূতি হয় যে, তিনি চিরকাল সেই পূর্ণ পুরুষই রহিয়াছেন। তবে এই বন্ধন কিরূপে আসিল? এই পূর্ণপুরুষের পক্ষে অবনত হইয়া অপূর্ণ-স্বভাব হওয়া কিরূপে সম্ভব হইল? মুক্তের পক্ষে বদ্ধ হওয়া কিরূপে সম্ভব হইল? অদ্বৈতবাদী বলেন, তিনি কোন কালেই বদ্ধ হন নাই, তিনি নিত্যমুক্ত। আকাশে নানাবর্ণের নানা মেঘ আসিতেছে। উহারা মুহূর্তকাল সেখানে থাকিয়া চলিয়া যায়। কিন্তু সেই এক নীল আকাশ বারাবর সমভাবে রহিয়াছে। আকাশের কখন পরিবর্তন হয় নাই, মেঘেরই কেবল পরিবর্তন হইতেছে। এইরূপ আপনারাও পূর্ব হইতে পূর্ণস্বভাব, অনন্তকাল ধরিয়া পূর্ণই আছেন। কিছুই আপনাদের প্রকৃতিকে কখন পরিবর্তিত করিতে পারে না, কখন করিবেও না। আমি অপূর্ণ, আমি নর, আমি নারী, আমি পাপী, আমি মন, আমি চিন্তা করিয়াছি, আমি চিন্তা করিব—এইসব ধারণা ভ্রমমাত্র। আপনি কখনই চিন্তা করেন না, আপনার কোন কালে দেহ ছিল না, আপনি কোনকালে অপূর্ণ ছিলেন না। আপনি এই ব্রহ্মাণ্ডের অনন্দময় প্রভু। যাহা কিছু আছে বা হইবে, আপনি তৎসমুদয়ের সর্বশক্তিমান্ নিয়ন্তা—এই সূর্য চন্দ্র তারা পৃথিবী উদ্ভিদ্, আমাদের এই জগতের প্রত্যেক অংশের মহান্ শাস্তা। আপনার শক্তিতেই সূর্য কিরণ দিতেছে, তারাগণ তাহাদের প্রভাব বিকিরণ করিতেছে, পৃথিবী সুন্দর হইয়াছে। আপনার আনন্দের শক্তিতেই সকলে পরস্পরকে ভালবাসিতেছে এবং পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হইতেছে। আপনি সকলের মধ্যে রহিয়াছেন, আপনি সর্বস্বরূপ। কাহাকে ত্যাগ করিবেন, কাহাকেই বা গ্রহণ করিবেন? আপনিই সর্বেসর্বা। এই জ্ঞানের উদয় হইলে মায়ামোহ তৎক্ষণাৎ চলিয়া যায়।
———–
১ বিজ্ঞতারমরে কেন বিজ্ঞনীয়াৎ।—বৃহদারণ্যক উপনিষদ্, ৪।৫।১৫
———–
আমি একবার ভারতের মরুভূমিতে ভ্রমণ করিতেছিলাম; এক মাসের উপর ভ্রমণ করিয়াছিলাম, আর প্রত্যহই আমার সম্মুখে অতিশয় মনোরম দৃশ্যসমূহ—অতি সুন্দর সুন্দর বৃক্ষ হ্রদাদি দেখিতে পাইতাম। একদিন অতিশয় পিপাসার্ত হইয়া একটি হ্রদে জলপান করিব, ইচ্ছা করিলাম। কিন্তু যেমন হ্রদের দিকে অগ্রসর হইয়াছি তেমনি উহা অন্তর্হিত হইল। তৎক্ষণাৎ আমার মস্তিষ্কে যেন প্রবল আঘাতের সহিত এই জ্ঞান আসিল—সারা জীবন ধরিয়া যে মরীচিকার কথা পড়িয়া আসিয়াছি, এ সেই মরিচীকা। তখন আমি আমার নিজের নির্বুদ্ধিতা স্মরণ করিয়া হাসিতে লাগিলাম, গত এক মাস ধরিয়া যে সব সুন্দর দৃশ্য ও হ্রদাদি দেখিতে পাইতেছিলাম, ঐগুলি মরীচিকা ব্যতীত আর কিছুই নয়, অথচ আমি তখন উহা বুঝিতে পারি নাই। পরদিন প্রভাতে আমি আবার চলিতে লাগিলাম—সেই হ্রদ ও সেই সব দৃশ্য আবার দেখা গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার এই জ্ঞান আসিল যে, উহা মরিচিকা মাত্র। একবার জানিতে পারায় উহার ভ্রমোৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। এইরূপে এই জগদ্ভ্রান্তি একদিন ঘুচিয়া যাইবে। এই-সকল ব্রহ্মাণ্ড একদিন আমাদের সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত হইবে। ইহারই নাম প্রত্যক্ষানুভূতি। ‘দর্শন’ কেবল কথার কথা বা তামাশা নয়; ইহাই প্রত্যক্ষ অনুভূত হইবে। এই শরীর যাইবে, এই পৃথিবী এবং আর যাহ কিছু সবই যাইবে— আমি দেহ বা আমি মন, এই বোধ কিছুক্ষণের জন্য চলিয়া যাইবে, অথবা যদি কর্ম সম্পূর্ণ ক্ষয় হইয়া থাকে, তবে একেবারে চলিয়া যাইবে, আর ফিরিয়া আসিবে না; আর যদি কর্মের কিয়দংশ অবশিষ্ট থাকে, তবে যেমন কুম্ভকারের চক্র—মৃৎপাত্র প্রস্তুত হইয়া গেলেও পূর্ববেগে কিয়ৎক্ষণ ঘুরিতে থাকে, সেরূপ মায়ামোহ সম্পূর্ণরূপে দূর হইয়া গেলেও এই দেহ কিছুদিন থাকিবে। এই জগৎ, নরনারী, প্রাণী—সবই আবার আসিবে, যেমন পরদিনেও মরীচিকা দেখা গিয়াছিল। কিন্তু পূর্বের ন্যায় উহারা শক্তি বিস্তার করিতে পারিবে না, কারণ সঙ্গে সঙ্গে এই জ্ঞানও আসিবে যে, আমি ঐগুলির স্বরূপ জানিয়াছি। তখন ঐগুলি আর আমাকে বদ্ধ করিতে পারিবে না, কোনরূপ দুঃখ কষ্ট শোক আর আসিতে পারিবে না। যখন কোন দুঃখকর বিষয় আসিবে, মন তাহাকে বলিতে পারিবে—আমি জানি তুমি ভ্রমমাত্র। যখন মানুষ এই অবস্থা লাভ করে, তখন তাহাকে ‘জীবন্মুক্ত’ বলে। জীবন্মুক্ত-অর্থে জীবিত অবস্থাতেই মুক্ত। জ্ঞানযোগীর জীবনের উদ্দেশ্য—এই জীবন্মুক্ত হওয়া। তিনিই জীবন্মুক্ত, যিনি, এই জগতে অনাসক্ত হইয়া বাস করিতে পারেন। তিনি জলজ পদ্মপত্রের ন্যায় থাকেন—উহা যেমন জলের মধ্যে থাকিলেও জল উহাকে কখনই ভিজাইতে পারে না, সেরূপ তিনি জগতে নির্লিপ্তভাবে থাকেন। তিনি মনুষ্য জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, শুধু তাই কেন, সকল প্রাণীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ তিনি সেই পূর্ণস্বরূপের সহিত অভেদভাব উপলব্ধি করিয়াছেন; তিনি উপলব্ধি করিয়াছেন যে, তিনি ভগবানের সহিত অভিন্ন। যতদিন আপনার জ্ঞান থাকে যে, ভগবানের সহিত আপনার অতি সামান্য ভেদও আছে, ততদিন আপনার ভয় থাকিবে। কিন্তু যখন আপনি জানিবেন যে, আপনিই তিনি, তাঁহাতে আপনাতে কোন ভেদ নাই, বিন্দুমাত্র ভেদ নাই, তাহার সবটুকুই আপনি, তখন সকল ভয় দূর হইয়া যায়। ‘সেখানে কে কাহাকে দেখে? কে কাহার উপাসনা করে? কে কাহার সহিত কথা বলে? কে কাহার কথা শুনে? যেখানে একজন অপরকে দেখে, একজন অপরকে কথা বলে, একজন অপরের কথা শুনে, উহা নিয়মের রাজ্য। যেখানে কেহ কাহাকেও দেখে না, কেহ কাহাকেও বলে না, তাহাই শ্রেষ্ঠ, তাহাই ভূমা, তাহাই ব্রহ্ম।’ ১ আপনিই তাহা এবং সর্বদাই তাহা আছেন। তখন জগতের কি হইবে? আমরা কি জগতের উপকার করিতে পারিব? এরূপ প্রশ্নই যেখানে উদিত হয় না। এ সেই শিশুর কথার মতো-বড় হইয়া গেলে আমার মিঠাইয়ের কি হইবে? বালকও বলিয়া থাকে, আমি বড় হইলে আমার মার্বেলের কি দশা হইবে? তবে আমি বড় হইব না। ছোট শিশু বলে, আমি বড় হইলে আমার পুতুলগুলির কি দশা হইবে? এই জগৎ সম্বন্ধে পূর্বোক্ত প্রশ্নগুলিও সেরূপ। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান—এই তিন কালেই জগতের অস্তিত্ব নাই। যদি আমরা আত্মার যথার্থ স্বরূপ জানিতে পারি—এই আত্মা ব্যতীত আর কিছুই নাই, আর যাহা কিছু সব স্বপ্ন মাত্র, উহাদের প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্ব নাই, তবে এই জগতের দুঃখ-দারিদ্র, পাপ পুণ্য কিছুই আমাদিগকে চঞ্চল করিতে পারিবে না। যদি উহাদের অস্তিত্বই না থাকে, তবে কাহার জন্য এবং কিসের জন্য আমি কষ্ট করিব? জ্ঞানযোগীরা ইহাই শিক্ষা দেন। অতএব সাহস অবলম্বন করিয়া মুক্ত হউন, আপনাদের চিন্তাশক্তি আপনাদিগকে যতদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতে পারে, সাহসপূর্বক ততদূর অগ্রসর হউন, এবং সাহসপূর্বক উহা জীবনে পরিণত করুন। এই জ্ঞানলাভ করা বড়ই কঠিন। ইহা মহা সাহসীর কার্য। যে সব পুতুল ভাঙিয়া ফেলিতে সাহস করে—শুধু মানসিক বা কুসংস্কাররূপ পুতুল নয়, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়সমূহরূপ যে ভাঙিয়া ফেলিতে পারে—ইহা তাহারই কার্য।