————–
১ গীতা, ১৩।১৩
২ মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি নাহং ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোমভূমি র্ন বায়ু শ্চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্ ।।
—নির্বাণষটকম্, শংকরাচার্য
০৫. মুক্ত আত্মা
আমরা দেখিয়াছি, সাংখ্যের বিশ্লেষণ দ্বৈতবাদে পর্যবসিত—উহার সিদ্ধান্ত, এই যে চরমতত্ত্ব—প্রকৃতি ও আত্মাসমূহ। আত্মার সংখ্যা অনন্ত, আর যেহেতু আত্মা অমিশ্র পদার্থ, সেজন্য উহার বিনাশ নাই, সুতরাং উহা প্রকৃতি হইতে অবশ্যই স্বতন্ত্র। প্রকৃতির পরিণাম হয় এবং তিনি এই সমুদয় প্রপঞ্চ প্রকাশ করেন। সাংখ্যের মতে আত্মা নিষ্ক্রিয়। উহা অমিশ্র, আর প্রকৃতি আত্মার অপবর্গ বা মুক্তি-সাধনের জন্যই এই সমুদয় প্রপঞ্চজাল বিস্তার করেন, আর আত্মা যখন বুঝিতে পারেন, তিনি প্রকৃতি নন, তখনই তাহার মুক্তি। অপরদিকে আমরা ইহাও দেখিয়াছি যে, সাংখ্যদিগকে বাধ্য হইয়া স্বীকার করিতে হয়, প্রত্যেক আত্মাই সর্বব্যাপী। আত্মা যখন অশ্রিত পদার্থ, তখন তিনি সসীম হইতে পারেন না; কারণ সমুদয় সীমাবদ্ধ ভাব দেশ কাল বা নিমিত্তের মধ্য দিয়া আসিয়া থাকে। আত্মা যখন সম্পূর্ণরূপে ইহাদের অতীত, তখন তাঁহাতে সসীম ভাব কিছু থাকিতে পারে না। সসীম হইতে গেলে তাহাকে দেশের মধ্যে থাকিতে হইবে, আর তাহার অর্থ—উহার একটি দেহ অবশ্যই থাকিবে; আবার যাঁহার দেহ আছে, তিনি অবশ্য প্রকৃতির অন্তর্গত। যদি আত্মার আকার থাকিত, তবে তো আত্মা প্রকৃতির সহিত অভিন্ন হইতেন। অতএব আত্মা নিরাকার; আর যাহা নিরাকার তাহা এখান সেখানে বা অন্য কোন স্থানে আছে এ কথা বলা যায় না। উহা অবশ্যই সর্বব্যাপী হইবে। সাংখ্যদর্শন ইহার উপর আর যায় নাই।
সাংখ্যদের এই মতের বিরুদ্ধে বেদান্তিরা প্রথম আপত্তি এই যে, সাংখ্যের এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ নয়। যদি প্রকৃতি একটি অমিশ্র বস্তু হয় এবং আত্মাও যদি অমিশ্র বস্তু হয়, তবে দুইটি অমিশ্র বস্তু হইল, আর যে সকল যুক্তিতে আত্মার সর্বব্যাপিত্ব প্রমাণিত হয়, তাহা প্রকৃতির পক্ষেও খাটিবে, সুতরাং উহাও সমুদয় দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত হইবে। প্রকৃতি যদি এইরূপই হয়, তবে উহার কোনরূপ পরিবর্তন বা বিকাশ হইবে না। ইহাতে মুশকিল হয় এই যে, দুইটি অমিশ্র বা পূর্ণ বস্তু স্বীকার করিতে হয়, আর তাহা অসম্ভব।
এ বিষয়ে বেদান্তীদের সিদ্ধান্ত কি? তাঁহাদের সিদ্ধান্ত এই যে, স্থূল জড় হইতে মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব পর্যন্ত প্রকৃতির সমুদয় বিকার যখন অচেতন, তখন যাহাতে মন চিন্তা করিতে পারে এবং প্রকৃতি কার্য করিতে পারে, তাহার জন্য উহাদের পশ্চাতে উহদের পরিচালক শক্তিস্বরূপ একজন চৈতন্যবান্ পুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার করা আবশ্যক। বেদান্তী বলেন, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতে এই চৈতন্যবান্ পুরুষ রহিয়াছেন, তাহাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি, সুতরাং এই জগৎ তাহা হইতে পৃথক নয়। তিনি জগতের শুধু নিমিত্তকারণ নন, উপাদানকারণও বটে। কারণ কখনও কার্য হইতে পৃথক নয়। কার্য কারণেরই রূপান্তর মাত্র। ইহা তো আমরা প্রতিদিনই দেখিতেছি। অতএব ইনিই প্রকৃতির কারনস্বরূপ। দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত বা অদ্বৈত-বেদান্তের যত বিভিন্ন মত বা বিভাগ আছে, সকলেরই এই প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, ঈশ্বর এই জগতের শুধু নিমিত্তকারণ নন, তিনি ইহার উপাদান কারণও বটে; যাহা কিছু জগতে আছে, সবই তিনি। বেদান্তের দ্বিতীয় সোপান—এই আত্মাগণও ঈশ্বরের অংশ, সেই অনন্ত বহ্নির এক একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র। অর্থাৎ যেমন একটি বৃহৎ অগ্নিরাশি হইতে সহস্র সহস্র স্ফুলিঙ্গ বহির্গত হয়, তেমনি সেই পুরাতন পুরুষ হইতে এই সমুদয় আত্মা বাহির হইয়াছে।১
এই পর্যন্ত তো বেশ হইল, কিন্তু এই সিদ্ধান্তেও তৃপ্তি হইতেছে না। অনন্তের অংশ—এ কথার অর্থ কি? অনন্ত যাহা, তাহা তো অবিভাজ্য। অনন্তের কোন অংশ হইতে পারে না। পূর্ণ বস্তু কখনও বিভক্ত হইতে পারে না। তবে যে বলা হইল, আত্মাসমূহ তাহা হইতে স্ফুলিঙ্গের মত বাহির হইয়াছে—এ কথার তাৎপর্য কি? অদ্বৈতবেদান্তী এই সমস্যার এইরূপ মীমাংসা করেন যে, প্রকৃতপক্ষে পূর্ণের অংশ নাই। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক আত্মা তাহার অংশ নন, প্রত্যেকে প্রকৃতপক্ষে সেই অনন্ত ব্রহ্মস্বরূপ। তবে এত আত্মা কিরূপে আসিল? লক্ষ লক্ষ জলকণার উপর সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়িয়া লক্ষ লক্ষ সূর্য দেখাইতেছে, আর প্রত্যেক জলকণাতেই ক্ষুদ্রাকারে সূর্যের মূর্তি রহিয়াছে। এইরূপে এই সকল আত্মা প্রতিবিম্ব মাত্র, সত্য নয়। তাহারা প্রকৃতপক্ষে সেই ‘আমি’ নয়, যিনি এই জগতের ঈশ্বর, ব্রহ্মাণ্ডের এই অবিভক্ত সত্তাস্বরূপ। অতএব এই সকল বিভিন্ন প্রাণী, মানুষ, পশু ইত্যাদি প্রতিবিম্ব মাত্র, সত্য নয়। উহারা প্রকৃতির উপর প্রতীত মায়াময় প্রতিবিম্ব মাত্র। জগতে একমাত্র অনন্ত পুরুষ আছেন, আর সেই পুরুষ ‘আপনি’, ‘আমি’ ইত্যাদিরূপে প্রতীয়মান হইতেছেন, কিন্তু এই ভেদপ্রতীতি মিথ্যা বই আর কিছুই নয়। তিনি বিভক্ত হন নাই, বিভক্ত হইয়াছেন বলিয়া বোধ হইতেছে মাত্র। আর তাঁহাতে দেশ-কাল-নিমিত্তের জালের মধ্য দিয়া দেখাইতে এই আপাতপ্রতীয়মান বিভাগ বা ভেদ হইয়াছে। আমি যখন ঈশ্বরকে দেশ-কাল-নিমিত্তের জালের মধ্য দিয়া দেখি, তখন আমি তাহাকে জড়জগৎ বলিয়া দেখি; যখন আর একটি উচ্চতর ভূমি হইতে অথচ সেই জালের মধ্য দিয়াই তাহাকে দেখি, তখন তাহাকে পশুপক্ষী রূপে দেখি; আর একটু উচ্চতর ভূমি হইতে মানবরূপে, আরও উচ্চে যাইলে দেবরূপে দেখিয়া থাকি। তথাপি ঈশ্বর জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের এক অনন্ত সত্তা এবং আমরাই সেই সত্তাস্বরূপ। আমিও সেই, আপনিও সেই—তাঁহার অংশ নয়, পূর্ণই। তিনি অনন্ত জ্ঞাতারূপে সমুদয় প্রপঞ্চের পশ্চাতে দণ্ডায়মান আছেন, আবার তিনি স্বয়ং সমুদয় প্রপঞ্চস্বরূপ। তিনি বিষয় ও বিষয়ী—উভয়ই। তিনিই ‘আমি’ তিনিই ‘তুমি’। ইহা কিরূপে হইল?