————-
১ বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদের মতে বালুকাকণা হইতে মুক্তার উৎপত্তি—এই লোক-প্রচলিত বিশ্বাসটির কোন ভিত্তি নাই। সম্ভবতঃ ক্ষুদ্রকীটাণুবিশেষ (Parasite) হইতে মুক্তার উৎপত্তি।
————–
কিন্তু আত্মা যে এক, ইহা অপেক্ষাও তাহার প্রবলতর প্রমাণ আছে। শুধু তাই নয়, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড যে এক অখণ্ড সত্তা—ইহাও প্রমাণ করা যাইতে পারে। আর একবার আমরা পূর্বকথিত ‘ক’ ও ‘খ’ নামক অজ্ঞাতবস্তুসূচক চিহ্নের সাহায্য গ্রহণ করিব। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, যাহাকে আমরা বর্হিজগৎ বলি, তাহা ‘ক+মন’, এবং অন্তর্জগৎ ‘খ+মন’। ‘ক’ ও ‘খ’ এই দুইটিই অজ্ঞাত পরিমাণ বস্তু—দুইটি অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। এখন দেখা যাক্, মন কি? দেশ, কাল, নিমিত্ত ছাড়া মন আর কিছুই নয়—উহারাই মনের স্বরূপ। আপনারা কাল ব্যতীত কখন চিন্তা করিতে পারেন না, দেশ ব্যতীত কোন বস্তুর ধারণা করিতে পারেন না এবং নিমিত্ত বা কার্য-কারণ-সম্বন্ধ ছাড়িয়া কোন বস্তুর কল্পনা করিতে পারেন না। পূর্বোক্ত ‘ক’ও‘খ’ এই তিনটি ছাঁচে পড়িয়া মন দ্বারা সীমাবদ্ধ হইতেছে। ঐগুলি ব্যতীত মনের স্বরূপ আর কিছুই নয়। এখন ঐ তিনটি ছাঁচ, যাহাদের নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নাই, সেগুলি তুলিয়া লউন। কি অবশিষ্ট থাকে? তখন সবই এক হইয়া যায়। ‘ক’ও‘খ’ এক বলিয়া বোধ হয়। কেবল এই ম—-এই ছাঁচই উহাদিগকে আপাতদৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ করিয়াছিল। ‘ক’ও‘খ’ উভয়ই অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয়। আমরা উহাদিগের উপর কোন গুণের আরোপ করিতে পারি না। সুতরাং গুণ-বা বিশেষণ-রহিত বলিয়া উভয়ই এক। যাহা গুণরহিত ও নিরপেক্ষ ও পূর্ণ, তাহা অবশ্যই এক হইবে। নিরপেক্ষ পূর্ণ বস্তু দুইটি হিতে পারে না। সেখানে কোন গুণ নাই, সেখানেই কেবল এক বস্তু থাকিতে পারে। ‘ক’ও‘খ’ উভয়ই নির্গুণ, কারণ উহারা মন হইতেই গুণ পাইতেছে। অতএব এই ‘ক’ও‘খ’ এক।
সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড এক অখণ্ড সত্তামাত্র। জগতে কেবল এক আত্মা, এক সত্তা আছে; আর এক সত্তা যখন দেশ কাল নিমিত্তের ছাঁচের মধ্যে পড়ে, তখনই তাহাকে বুদ্ধি, অহংজ্ঞান, সূক্ষ্ম-ভূত, স্থূল-ভূত প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়। সমুদয় ভৌতিক ও মানসিক আকার বা রূপ, যাহা কিছু এই জগদ্ব্রহ্মাণ্ডে আছে, তাহা সেই এক বস্তু—কেবল বিভিন্নরূপে প্রতিভাত হইতেছে মাত্র। যখন উহার একটি অংশ এই দেশ-কাল-নিমিত্তের জালে পড়ে, তখন উহা আকার গ্রহণ করে বলিয়া বোধ হয়; ঐ জাল সরাইয়া দেখুন—সবই এক। এই সমগ্র জগৎ এক অখণ্ডস্বরূপ. আর উহাকেই অদ্বৈত-বেদান্তদর্শনে ‘ব্রহ্ম’ বলে। ব্রহ্ম যখন ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতে আছেন বলিয়া প্রতীত হয়, তখন তাহাকে ঈশ্বর বলে, আর যখন তিনি এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডের পশ্চাতে বিদ্যমান বলিয়া প্রতীত হন, তখন তাঁহাকে ‘আত্মা’ বলে। অতএব এই আত্মাই মানুষের অভ্যন্তরস্থ ঈশ্বর। একটি মাত্র পুরুষ আছেন—তাহাকে ঈশ্বর বলে, আর যখন ঈশ্বর ও মানবের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়, তখন বুঝা যায়—উভয়ই এক। এই ব্রহ্মাণ্ড আপনি স্বয়ং, অবিভক্ত আপনি। আপনি এই সমগ্র জগতের মধ্যে রহিয়াছেন। ‘সকল হস্তে আপনি কাজ করিতেছেন, সকল মুখে আপনি খাইতেছেন, সকল নাসিকায় আপনি শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলিতেছেন, সকল মনে আপনি চিন্তা করিতেছেন।’১ সমগ্র জগৎই আপনি। এই ব্রহ্মাণ্ড আপনার শরীর। আপনি ব্যক্ত ও অব্যক্ত উভয় জগৎ; আপনি জগতের আত্মা, আবার আপনিই উহার শরীর বটে। আপনিই ঈশ্বর, আপনিই দেবতা, আপনিই মানুষ, আপনিই পশু, আপনিই উদ্ভিদ, আপনিই খনিজ, আপনিই সব—সমুদয় ব্যক্ত জগৎ আপনিই। যাহা কিছু আছে সবই ‘আপনি’; যথার্থ ‘আপনি’ যাহা—সেই এক অবিভক্ত আত্মা; যে ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ ব্যক্তি বিশেষকে আপনি আমি বলিয়া মনে করেন, তাহা নয়।
এখন এই প্রশ্ন উঠিতেছে, আপনি অনন্ত পুরুষ হইয়া কিবাবে এইরূপ খণ্ড খণ্ড হইলেন?—কিভাবে শ্রী অমুক, পশুপক্ষী বা অন্যান্য বস্তু হইলেন? ইহার উত্তরঃ এই সমুদয় বিভাগই আপাতপ্রতীয়মান। আমরা জানি অনন্তের কখন বিভাগ হইতে পারে না। অতএব আপনি একটা অংশমাত্র—এ কথা মিথ্যা, উহা কখনই সত্য হইতে পারে না। আর আপনি যে শ্রী অমুক—এ-কথাও কোনকালে সত্য নয়, উহা কেবল সপ্নমাত্র। এটি জানিয়া মুক্ত হউন। ইহাই অদ্বৈতবাদীর সিদ্ধান্ত।
‘আমি মনও নই, দেহও নই, ইন্দ্রিয়ও নই—আমি অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ। আমি সেই, আমিই সেই।’২
ইহাই জ্ঞান এবং ইহা ব্যতীত আর যাহা কিছু সবই অজ্ঞান। যাহা কিছু আছে, সবই অজ্ঞান—অজ্ঞানের ফলস্বরূপ। আমি আবার কি জ্ঞান লাভ করিব? আমি স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ। আমি আবার জীবন লাভ করিব কি? আমি স্বয়ং প্রাণস্বরূপ। জীবন আমার স্বরূপের গৌণ বিকাশমাত্র। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, আমি জীবিত, তাহার কারণ আমিই জীবনস্বরূপ সেই এক পুরুষ। এমন কোন বস্তু নাই, যাহা আমার মধ্য দিয়া প্রকাশিত নয়, যাহা আমাতে নাই এবং যাহা আমার স্বরূপে অবস্থিত নয়। আমিই পঞ্চভূত-রূপে প্রকাশিত; কিন্তু আমি এক ও মুক্তস্বরূপ। কে মুক্তি চায়? কেহই মুক্তি চায় না। যদি আপনি নিজেকে বদ্ধ বলিয়া ভাবেন তো বদ্ধই থাকিবেন, আপনি নিজেই নিজের বন্ধনের কারণ হইবেন। আর যদি আপনি উপলব্ধি করেন যে আপনি মুক্ত, তবে এই মুহূর্তেই আপনি মুক্ত। ইহাই জ্ঞান—মুক্তির জ্ঞান, এবং মুক্তিই সমুদয় প্রকৃতির চরম লক্ষ্য।