——————
১ বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ।—গীতা, ১০।৪২
২ তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ ।—ঐ, ২।৫২
৩ ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন ।—ঐ, ২।৪৫
——————
আমরা জ্ঞানের নিম্নভূমিও জানি না, জ্ঞানাতীত ভূমিও জানি না; আমরা কেবল সাধারণ জ্ঞানভূমিই জানি। যদি কোন ব্যক্তি বলেন, আমি পাপী—সে নির্বোধমাত্র, কারণ সে নিজেকে জানে না। সে নিজের সম্বন্ধে অত্যন্ত অজ্ঞ। সে নিজের একটি অংশ মাত্র জানে, কারণ জ্ঞান তাঁহার মানসভূমির মাত্র একাংশব্যাপী। সমগ্র ব্রহ্মান্ড সম্বন্ধেও ঐরূপ;যুক্তিবিচার দ্বারা উহার একাংশমাত্র জানাই সম্ভব; কিন্তু প্রকৃতি বা জগৎপ্রপঞ্চ বলিতে জ্ঞানের নিম্নভূমি, সাধারণ জ্ঞানভূমি, জ্ঞানাতীত ভূমি, ব্যষ্টিমহৎ, সমষ্টিমহৎ এবং তাহাদের পরবর্তী সমুদয় বিকার—এই সবগুলি বুঝাইয়া থাকে, আর এইগুলি সাধারণ জ্ঞানের বা যুক্তির অতীত।
কিসের দ্বারা প্রকৃতি পরিণামপ্রাপ্ত হয়? এ পর্যন্ত আমরা দেখিয়াছি, প্রাকৃতিক সকল বস্তু, এমন কি প্রকৃতি নিজেও জড় বা অচেতন। উহারা নিয়মাধীন হইয়া কার্য করিতেছে—সমুদয়ই বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ এবং অচেতন। মন মহত্তত্ত্ব, নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি—এ সবই অচেতন। কিন্তু এগুলি এমন এক পুরুষের চিৎ বা চৈতন্যে প্রতিবিম্বিত হইতেছে, যিনি এই সবের অতীত, আর সাংখ্যমতাবলন্বিগন ইহাকে ‘পুরুষ’-নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই পুরুষ জগতের মধ্যে—প্রকৃতির মধ্যে যে-সকল পরিণাম হইতেছে, সেগুলির সাক্ষিস্বরূপ কারণ, অর্থাৎ এই পুরুষকে যদি বিশ্বজনীন অর্থে ধরা যায়, তবে ইনিই ব্রহ্মাণ্ডের ঈশ্বর।১ ইহা কথিত হইয়া থাকে যে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হইয়াছে। সাধারণ দৈনিক ব্যাবহার্য বাক্য হিসাবে ইহা অতি সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু ইহার আর অধিক মূল্য নাই। ইচ্ছা কিরূপে সৃষ্টির কারণ হইতে পারে? ইচ্ছা-প্রকৃতির তৃতীয় বা চতুর্থ বিকার। অনেক বস্তু উহার পূর্বেই সৃষ্ট হইয়াছে। সেগুলি কে সৃষ্টি করিল? ইচ্ছা একটি যৌগিক পদার্থ মাত্র, অর যাহা কিছু যৌগিক, সে সকলই প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন। ইচ্ছাও নিজে কখন প্রকৃতিকে সৃষ্টি করিতে পারে না। উহা একটি অমিশ্র বস্তু নয়। অতএব ঈশ্বরের ইচ্ছায় এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হইয়াছে—এরূপ বলা যুক্তিবিরুদ্ধ। মানুষের ভিতর ইচ্ছা অহংজ্ঞানের অল্পাংশমাত্র ব্যাপিয়া রহিয়াছে। কেহ কেহ বলেন, উহা আমাদের মস্তিষ্ককে সঞ্চালিত করে।তাই যদি করিত, তবে আপনারা ইচ্ছা করিলেই মস্তিষ্কের কার্য বন্ধ করিতে পারিতেন, কিন্তু তাহা তো পারেন না। সুতরাং ইচ্ছা মস্তিষ্ককে সঞ্চালিত করিতেছে না। হৃদয়কে গতিশীল করিতেছে কে? ইচ্ছা কখনই নয়; কারণ যদি তাই যদি হইত, তবে আপনারা ইচ্ছা করিলেই হৃদয়ের গতিরোধ করিতে পারিতেন। ইচ্ছা আপনাদের দেহকেও পরিচালিত করিতেছে না, ব্রহ্মাণ্ডকেও নিয়মিত করিতেছে না। অপর কোন বস্তু উহাদের নিয়ামক—ইচ্ছা যাহার একটি বিকাশমাত্র। এই দেহকে এমন একটি শক্তি পরিচালিত করিতেছে, ইচ্ছা যাহার বিকাশমাত্র। সমগ্র জগৎ ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হইতেছে না, সেজন্যই ‘ইচ্ছা’ বলিলে ইহার ঠিক ব্যাখ্যা হয় না। মনে করুন আমি মানিয়া লইলাম, ইচ্ছাই আমাদের দেহকে চালাইতেছে, তারপর ইচ্ছানুসারে আমি এই দেহ পরিচালিত করিতে পারিতেছি না বলিয়া বিরক্তি প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলাম। ইহা তো আমারই দোষ, কারণ ইচ্ছাই আমাদের দেহ-পরিচালক—ইহা মানিয়া লইবার আমার কোন অধিকার ছিল না। এইরূপ যদি আমরা মানিয়া লই যে, ইচ্ছাই জগৎ পরিচালন করিতেছে, তারপর দেখি প্রকৃত ঘটনার সহিত ইহা মিলিতেছে না, তবে ইহা আমারই দোষ। এই পুরুষ ইচ্ছা নন বা বুদ্ধি নন, কারণ বুদ্ধি একটি যৌগিক পদার্থমাত্র। কোনরূপ জড় পদার্থ না থকিলে কোনরূপ বুদ্ধিও থাকিতে পারে না। এই জড় মানুষে মস্তিষ্কের আকার ধারণ করিয়াছে। যেখানেই বুদ্ধি আছে, সেখানেই কোন-না-কোন আকারে জড় পদার্থ থাকিবেই থাকিবে। অতএব বুদ্ধি যখন যৌগিক পদার্থ হইল, তখন পুরুষ কি? উহা মহত্তত্ত্ব নয়, নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তিও নয়, কিন্তু উভয়েরই কারণ। তাঁহার সান্ন্যিধ্যই উহাদের সবগুলিকে ক্রিয়াশীল করে ও পরস্পরকে মিলিত করায়। পুরুষকে সেই সকল বস্তুর কয়েকটির সহিত তুলনা করা যাইতে পারে, যেগুলির শুধু সান্ন্যিধ্যই রাসায়নিক কার্য ত্বরান্বিত করে, যেমন সোনা গলাইতে গেলে তাহাতে পটাসিয়াম সায়ানাইড (Cyanide of Potassium) মিশাইতে হয়। পটাসিয়াম সায়ানাইড পৃথক্ থাকিয়া যায়, (শেষ পর্যন্ত) উহার উপর কোন রাসায়নিক কার্য হয় না, কিন্তু সোনা গলানো-রূপ কার্য সফল করিবার জন্য উহার সান্নিধ্য প্রয়োজন। পুরুষ সম্বন্ধেও এই কথা। উহা প্রকৃতির সহিত মিশ্রিত হয় না, উহা বুদ্ধি বা মহৎ বা উহার কোনরূপ বিকার নয়, উহা শুদ্ধ পূর্ণ আত্মা।
————-
১ ইতিপূর্বে মহত্তত্ত্বকে ‘ঈশ্বর’ বলা হইয়াছে, এখানে আবার পুরুষের সর্বজনীন ভাবকে ঈশ্বর বলা হইল। এই দুইটি কথা আপাতবিরোধী বলিয়া বোধ হয়। এখানে এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, পুরুষ মহত্তত্ত্বরূপ উপাধি গ্রহণ করিলেই তাহাকে ‘ঈশ্বর’ বলা যায়।
————–
‘আমি সাক্ষিস্বরূপ অবস্থিত থাকায় প্রকৃতি চেতন ও অচেতন সব কিছু সৃজন করিতেছে।’১
তাহা হইলে প্রকৃতিতে এই চেতনা কোথা হইতে আসিল? পুরুষেই এই চেতনার ভিত্তি, আর ঐ চেতনাই পুরুষের স্বরূপ। উহা এমন এক বস্তু, যাহা বাক্যে ব্যক্ত করা যায় না, বুদ্ধি দ্বারা বুঝা যায় না, কিন্তু আমরা যাহাকে ‘জ্ঞান’ বলি, উহা তাহার উপাদান স্বরূপ। এই পুরুষ আমাদের সাধারণ জ্ঞান নয়, কারণ জ্ঞান একটি যৌগিক পদার্থ, তবে এই জ্ঞানে যাহা কিছু উজ্জ্বল ও উত্তম, তাহা ঐ পুরুষেরই। পুরুষে চৈতন্য আছে, কিন্তু পুরুষকে বুদ্ধিমান্ বা জ্ঞানবান্ বলা যাইতে পারে না, কিন্তু উহা এমন এক বস্তু, যিনি থাকাতেই জ্ঞান সম্ভব হয়। পুরুষের মধ্যে যে চিৎ, তাহা প্রকৃতির সহিত যুক্ত হইয়া আমাদের নিকট ‘বুদ্ধি’ বা ‘জ্ঞান’ নামে পরিচিত হয়। জগতে যে কিছু সুখ আনন্দ শান্তি আছে, সমুদয়ই পুরুষের, কিন্তু ঐগুলি মিশ্র, কেন না উহাতে পুরুষ ও প্রকৃতি সংযুক্ত আছে।
‘যেখানে কোনপ্রকার সুখ, যেখানে কোনরূপ আনন্দ, সেখানে সেই অমৃতস্বরূপ পুরুষের এক কণা আছে, বুঝিতে হইবে’।২
এই পুরুষই সমগ্র জগতের মহা আকর্ষণস্বরূপ, তিনি যদিও উহা দ্বারা অস্পৃষ্ট ও উহার সহিত অসংসৃষ্ট, তথাপি তিনি সমগ্র জগতকে আকর্ষণ করিতেছেন। মানুষকে যে কাঞ্চনের অন্বেষণে ধাবমান দেখিতে পান, তাহার কারণ সে না জানিলেও প্রকৃতপক্ষে সেই কাঞ্চনের মধ্যে পুরুষের এক স্ফুলিঙ্গ বিদ্যমান। যখন মানুষ সন্তান প্রার্থনা করে, অথবা নারী যখন স্বামীকে চায়, তখন কোন্ শক্তি তাহাদিগকে আকর্ষণ করে? সেই সন্তান ও সেই স্বামীর ভিতর যে সেই পুরুষের অংশ আছে, তাহাই সেই আকর্ষণী শক্তি। তিনি সকলের পশ্চাতে রহিয়াছেন, কেবল উহাতে জড়ের আবরণ পড়িয়াছে। অন্য কিছুই কাহাকেও আকর্ষণ করিতে পারে না। এই আচেনাত্মক জগতের মধ্যে সেই পুরুষই একমাত্র চেতন। ইনিই সাংখ্যের পুরুষ। অতএব ইহা হইতে নিশ্চয়ই বুঝা যাইতেছে যে, এই পুরুষ অবশ্যই সর্বব্যাপী, কারণ যাহা সর্বব্যাপী নয় তাহা অবশ্যই সসীম। সমুদয় সীমাবদ্ধ ভাবই কোন কারণের কার্যস্বরূপ, আর যাহা কার্যস্বরূপ, তাহার অবশ্য আদি অন্ত থাকিবে। যদি পুরুষ সীমাবদ্ধ হন, তবে তিনি অবশ্য বিনাশপ্রাপ্ত হইবেন, তিনি তাহা হইলে আর চরম তত্ত্ব হইলেন না, তিনি মুক্তস্বরূপ হইলেন না, তিনি কোন কারণের কার্যস্বরূপ—উৎপন্ন হইলেন। অতএব তিনি যদি সীমাবদ্ধ না হন, তবে তিনি সর্বব্যাপী। কপিলের মতে পুরুষের সংখ্যা এক নয়, বহু। অনন্ত সংখ্যক পুরুষ রহিয়াছেন, আপনিও একজন পুরুষ, প্রত্যেকেই এক একজন পুরুষ—উহারা যেন অনন্তসংখ্যক বৃত্তস্বরূপ। তাহার প্রত্যেকটি আবার অনন্ত বিস্তৃত। পুরুষ জন্মানও না, মরেনও না। তিনি মনও নন, জড়ও নন। আর আমরা যাহা কিছু জানি, সকলই তাহার প্রতিবিম্ব-স্বরূপ। আমরা নিশ্চয়ই জানি যে, যদি তিনি সর্বব্যাপী হন, তবে তাঁহার জন্মমৃত্যু কখনই হইতে পারে না। প্রকৃতি তাঁহার উপর নিজ ছায়া—জন্ম ও মৃত্যুর ছায়া প্রক্ষেপ করিতেছে, কিন্তু তিনি স্বরূপতঃ নিত্য। এতদূর পর্যন্ত আমরা দেখিলাম, কপিলের মত অতি অপূর্ব।