একটি ভাব আশ্রয় কর, উহার জন্য জীবন উৎসর্গ কর এবং ধৈর্যের সহিত সংগ্রাম করিয়া যাও; তোমার জীবনে সূর্যোদয় হইবেই।
কল্পনার প্রসঙ্গে পুনরায় ফিরিয়া আসা যাক।
কুণ্ডলিনীকে এমনভাবে কল্পনা করিতে হইবে যেন তাহা বাস্তব। ত্রিকোণ-অস্থিখণ্ডে কুণ্ডলী-আকারে সর্পটি অবস্থান করিতেছে, ইহাই প্রতীক।
তারপর পূর্বে যেরূপ বর্ণিত হইয়াছে, সেইভাবে প্রাণায়াম অভ্যাস কর এবং নিঃশ্বাস ধারণ করিয়া বা শ্বাসবন্ধ করিয়া উহাতে ৪ সংখ্যা আকৃতির নিম্নে প্রবহমান স্রোতের মত কল্পনা কর। স্রোত যখন নিম্নতম অংশে উপনীত হয়, তখন উহা ত্রিকোণাবস্থিত সর্পটিকে আঘাত করে এবং ফলে সর্পটি মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়া ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়—এইরূপ চিন্তা কর। চিন্তা দ্বারা প্রাণপ্রবাহকে ত্রিকোণাভিমুখে পরিচালনা কর।
দৈহিক প্রণালী আমরা এখন শেষ করিলাম এবং এই অংশ হইতে মানসিক প্রণালীর আরম্ভ।
প্রথম প্রক্রিয়ার নাম—‘প্রত্যাহার’। মনকে বাহ্য বিষয় হইতে গুটাইয়া অন্তর্মুখী করিতে হইবে। দৈহিক প্রণালী শেষ হইলে মনকে ইচ্ছামত দৌড়াইতে দাও, বাধা দিও না। কিন্তু সাক্ষীর ন্যায় উহার গতিবিধির উপর দৃষ্টি রাখ। এইরূপে এই মন তখন দুই অংশে বিভক্ত হইবে—অভিনেতা ও দ্রষ্টা। তারপর মনের যে-অংশ দ্রষ্টা বা সাক্ষী, তাহাকে শক্তিশালী কর এবং মনের গতিবিধি দমন করিবার চেষ্টায় সময় নষ্ট করিও না। মন অবশ্যই চিন্তা করিবে; কিন্তু ধীরে ধীরে এবং ক্রমশঃ সাক্ষী যখন তাহার কার্য করিয়া যাইবে, অভিনেতা—মন অধিকতর আয়ত্ত হইবে, যে-পর্যন্ত না তোমার অভিনয় বন্ধ হইয়া যায়।
দ্বিতীয় প্রক্রিয়াঃ ধ্যান। ইহাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। আমরা স্থূলদেহধারী এবং আমাদের মনও রূপ চিন্তা করিতে বাধ্য। ধর্ম এই প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং বাহ্যরূপও অনুধ্যানের সাহায্য করে। কোন রূপ ব্যতিরেকে তুমি ঈশ্বরের চিন্তা (ধ্যান) করিতে পার না। চিন্তা করিতে গেলে কোন না কোন ‘রূপ’ আসিবেই, কারণ চিন্তা ও প্রতীক অবিচ্ছেদ্য। সেই রূপের উপর মন স্থির করিতে চেষ্টা কর।
তৃতীয় প্রক্রিয়াঃ ধ্যানাভ্যাস দ্বারা এই অবস্থা লাভ করা যায় এবং ইহা যথার্থ ‘একাগ্রতা’ (একমুখীনতা)। মন সাধারণতঃ বৃত্তাকারে ক্রিয়া করে। কোন একটি বিন্দুতে মন নিবদ্ধ করিতে চেষ্টা কর। অবশেষে ফললাভ। মন এই অবস্থায় উপনীত হইলে আরোগ্যকরণ, ‘জ্যোতিঃ’ দর্শন ও সর্বপ্রকার যৌগিক শক্তি লাভ হয়। মুহূর্তমধ্যে তুমি এই চিন্তা-প্রবাহ কাহারও প্রতি প্রয়োগ করিতে পার, যেমন যীশুখ্রীষ্ট করিয়াছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে ফল লাভ করিবে।
পূর্বে যথাযথ শিক্ষা না থাকায় এই-সকল শক্তিদ্বারা অনেকের পতন ঘটিয়াছে, কিন্তু আমি তোমাদিগকে ধৈর্য ধরিয়া যোগের এই স্তরগুলি খুব ধীরে ধীরে অভ্যাস করিতে বলি, তারপর সমস্তই তোমাদের আয়ত্তে আসিবে। প্রেম যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে কিছু পরিমাণে আরোগ্যকরণ অভ্যাস করিতে পার, কারণ প্রেম কোন অনিষ্ট সাধন করে না।
মানুষমাত্রেই অল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ও ধৈর্যহীন। সকলেই শক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু সেই শক্তি অর্জন করিবার জন্য অতি অল্প লোকই ধৈর্য ধারণ করে। সে বিতরণ করিতেই উৎসুক, কিছু সঞ্চয় করিবে না। অর্জন করিতেই দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, কিন্তু খরচ করিতে অল্প সময় লাগে। সুতরাং শক্তি অর্জন করিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহা অপচয় না করিয়া সঞ্চয় কর।
রিপুর প্রত্যেকটি তরঙ্গ দমন করিলে তাহা তোমার অনুকূলে সমতা রক্ষা করে। অতএব ক্রোধের পরিবর্তে ক্রোধ প্রদর্শন না করাই উত্তম কৌশল। সকল নৈতিক বিষয়েই এই নিয়ম প্রযোজ্য। যীশুখ্রীষ্ট বলিয়াছিলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিরোধ করিও না।’ এই উপদেশ যে কেবল নীতিসঙ্গত, তাহা নয়; সত্যই ইহা উত্তম পন্থা। ইহা আবিষ্কার না করা পর্যন্ত আমরা উহার মর্ম হৃদয়ঙ্গম করি না, কারণ যে-ব্যক্তি ক্রোধ প্রদর্শন করে, সে শক্তির অপচয় করিয়া থাকে। মস্তিষ্কে ঐ-সকল ক্রোধ ও ঘৃণার সমাবেশ হইতে পারে, এরূপ সুযোগ মনকে দেওয়া সঙ্গত নয়। রসায়ন-বিজ্ঞানে মৌলিক উপাদান আবিষ্কৃত হইবার সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিকের কার্য সমাপ্ত হইবে। একত্ব আবিষ্কৃত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মবিজ্ঞান পূর্ণত্ব লাভ করে, এবং বহু সহস্র বৎসর পূর্বে এই একত্ব লব্ধ হইয়াছে। মানুষ পূর্ণ ঐক্যে উপনীত হয় তখনই, যখন সে বোঝে, ‘আমি ও আমার পিতা এক।’