————-
১ বৃহদারণ্যক উপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়, ৪র্থ ব্রাহ্মণ ও ৪র্থ আধ্যায়, ৫ম ব্রাহ্মণ দ্রষ্টব্য। এই আধ্যায়ের প্রায় সমুদয়ই ঐ দুই অংশের ভাবানুবাদ ও ব্যাখ্যামাত্র।
————-
০৮. জ্ঞানাযোগের চরমাদর্শ
অদ্যকার বক্তৃতাতেই সাংখ্য ও বেদান্তবিষয়ক এই বক্তৃতাবলী সমাপ্ত হইবে; অতএব আমি এই কয়দিন ধরিয়া যাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম, অদ্য সংক্ষেপে তাহার পুনরাবৃত্তি করিব। বেদ ও উপনিষদে আমরা হিন্দুদের অতি প্রাচীন ধর্মভাবের কয়েকটির বিবরণ পাইয়া থাকি। মহর্ষি কপিল খুব প্রাচীন বটে, কিন্তু এই সলক ভাব তাঁহা অপেক্ষা প্রাচীনতর। সাংখ্যদর্শনে কপিলের উদ্ভাবিত নূতন কোন মতবাদ নয়। তাঁহার সময়ে ধর্মসম্বন্ধে যে সকল বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত ছিল, তিনি নিজের অপূর্ব প্রতিভাবলে তাহা হইতে একটি যুক্তিসঙ্গত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রণালী গঠন করিতে চেষ্টা করিয়াছেন মাত্র। তিনি ভারতবর্ষে এমন এক ‘মনোবিজ্ঞান’ প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, যাহা হিন্দুদের বিভিন্ন আপাতবিরোধি দার্শনিকসম্প্রদায়সমূহ এখনও মানিয়া থাকে। পরবর্তী কোন দার্শনিকই এ পর্যন্ত মানব মনের ঐ অপূর্ব বিশ্লেষণ এবং জ্ঞানলাভ প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত সিদ্ধান্তের উপর যাইতে পারেন নাই; কপিল নিঃসন্দেহে অদ্বৈতবাদের ভিত্তি স্থাপন করিয়া যান; তিনি যতদূর পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাহা গ্রহণ করিয়া অদ্বৈতবাদ আর এক পদ অগ্রসর হইল। এইরূপে সাংখ্যদর্শনের শেষ সিদ্ধান্ত দ্বৈতবাদ ছাড়াইয়া চরম একত্বে পৌঁছিল।
কপিলের সময়ের পূর্বে ভারতে যে সকল ধর্মাভাব প্রচলিত ছিল—আমি অবশ্য পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ধর্মভাবগুলির কথাই বলিতেছি, কিন্তু নিম্নগুলি তো ধর্মের নামে অযোগ্য—সেগুলির মধ্যে আমরা দেখিতে পাই, প্রথমগুলির ভিতর প্রত্যাদেশ, ঈশ্বরাদিষ্ট শাস্ত্র প্রভৃতির ধারণা ছিল। অতি প্রাচীন অবস্থায় সৃষ্টির ধারণা বড়ই বিচিত্র ছিল : সমগ্র জগৎ ঈশ্বরেচ্ছায় শূন্য হইতে সৃষ্ট হইয়াছে, আদিতে এই জগৎ একেবারে ছিল না, আর সেই অভাব বা শূন্য হইতেই এই সমুদয় আসিয়াছে। পরবর্তী সোপানে আমরা দেখিতে পাই, এই সিদ্ধান্তে সন্দেহ প্রকাশ করা হইতেছে। বেদান্তের প্রথম সোপানেই এই প্রশ্ন দেখিতে পাওয়া যায় : অসৎ(অনস্তিত্ব) হইতে সতের(অস্তিত্বের) উৎপত্তি কিরূপে হইতে পারে ? যদি এই জগৎ সৎ অর্থাৎ অস্তিত্বযুক্ত হয়, তবে ইহা অবশ্য কিছু হইতে আসিয়াছে। প্রাচীনেরা সহজেই দেখিতে পাইলেন, কোথাও এমন কিছুই নাই, যাহা শূন্য হইতে উৎপন্ন হইতেছে। মনুষ্য হস্তের দ্বারা যাহা কিছু কৃত হয়, তাহারই তো উপাদান কারণ প্রয়োজন। অতএব প্রাচীন হিন্দুরা স্বভাবতই এই জগৎ যে শূন্য হইতে সৃষ্ট হইয়াছে, এই প্রাথমিক ধারণা ত্যাগ করিলেন, আর এই জগৎসৃষ্টির কারণীভূত উপাদান কি, তাহার অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। বাস্তবিকপক্ষে সমগ্র জগতের ধর্মেতিহাস— ‘কোন্ পদার্থ হইতে এই সমুদয়ের উৎপত্তি হইল?’ —এই প্রশ্নের উত্তর দিবার চেষ্টায় উপাদান কারণের অন্বেষনমাত্র। নিমিত্ত-কারণ বা ঈশ্বরের বিষয় ব্যতীত, ঈশ্বর এই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন কিনা—এই প্রশ্ন ব্যতীত, চিরকালই এই মহাপ্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছে, ‘ঈশ্বর কী উপাদান লইয়া এই জগৎ সৃষ্টি করিলেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরের উপরেই বিভিন্ন দর্শন নির্ভর করিতেছে।
একটি সিদ্ধান্ত এই যে, এই উপাদান এবং ঈশ্বর ও আত্মা—তিনই নিত্য বস্তু, উহারা যেন তিনটি সমান্তরাল রেখার মতো অনন্তকাল পাশাপাশি চলিয়াছে; উহাদের মধ্যে প্রকৃতি ও আত্মাকে তাঁহারা অ-স্বতন্ত্র তত্ত্ব এবং ঈশ্বরকে স্বতন্ত্র তত্ত্ব বা পুরুষ বলেন। প্রত্যেক জড়পরমাণুর ন্যায় প্রত্যেক আত্মাই ঈশ্বরেচ্ছার সম্পূর্ণ অধীন। যখন কপিল সাংখ্য মনোবিজ্ঞান প্রচার করিলেন, তখন পূর্ব হইতেই এই সকল ও অন্যান্য অনেক প্রকার ধর্মসম্বন্ধীয় ধারণা বিদ্যমান ছিল। ঐ মনোবিজ্ঞানের মতে বিষয়ানুভূতির প্রণালী এইরূপ : প্রথমতঃ বাহিরের বস্তু হইতে ঘাত বা ইঙ্গিত প্রদত্ত হয়, তাহা ইন্দ্রিয়সমূহের শরীরিক দ্বারগুলি উত্তেজিত করে। যেমন প্রথমে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়দ্বারে বাহ্যবিষয়ে আঘাত লাগিল, চক্ষুরাদি দ্বারা বা যন্ত্র হইতে সেই সেই ইন্দ্রিয়ে (স্নায়ুকেন্দ্রে), ইন্দ্রিয় সমূহ হইতে মনে, মন হইতে বুদ্ধিতে, বুদ্ধি হইতে এমন এক পদার্থে গিয়া লাগিল, যাহা এক তত্ত্বস্বরূপ—উহাকে তাহারা ‘আত্মা’ বলেন। আধুনিক শরীরবিজ্ঞান আলোচনা করিলেও আমরা দেখিতে পাই, সর্বপ্রকার বিষয়ানুভূতির জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র আছে, ইহা তাঁহার আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রথমতঃ নিম্নশ্রেণীর কেন্দ্রসমূহ, দ্বিতীয়তঃ উচ্চশ্রেণীর কেন্দ্রসমূহ, আর এই দুইটির সঙ্গে মন ও বুদ্ধির কার্যের সহিত ঠিক মিলে, কিন্তু তাঁহারা এমন কোন কেন্দ্র পান নাই, যাহা অপর সব কেন্দ্রকে নিয়মিত করিতেছে, সুতরাং কে এই কেন্দ্রগুলির একত্ব বিধান করিতেছে, শরীরবিজ্ঞান তাহার উত্তর দিতে অক্ষম। কোথায় এবং কিরূপে এই কেন্দ্রগুলি মিলিত হয়? মস্তিষ্ককেন্দ্রসমূহ পৃথক্ পৃথক্, আর এমন কোন একটি কেন্দ্র নাই, যাহা অপর কেন্দ্রগুলিকে নিয়মিত করিতেছে। অতএব এ পর্যন্ত এ-বিষয়ে সাংখ্য-মনোবিজ্ঞানের প্রতিবাদী কেহ নাই। একটি সম্পূর্ণ ধারণা লাভের জন্য এই একীভাব, যাহার উপর বিষয়ানুভূতিগুলি প্রতিবিম্ব হইবে, এমন কিছু প্রয়োজন। সেই কিছু না থাকিলে আমি আপনার বা ঐ ছবিখানার বা অন্য কোন বস্তুরই কোন জ্ঞানলাভ করিতে পারি না। যদি আমাদের ভিতর এই একত্ব-বিধায়ক কিছু না থাকিত, তবে আমরা হয়তো কেবল দেখিতেই লাগিলাম, খানিক পরে শুনিতে লাগিলাম, খানিক পরে স্পর্শ অনুভব করিতে লাগিলাম, আর এমন হইত যে, একজন কথা কহিতেছে শুনিতেছি, কিন্তু তাহাকে মোটেই দেখিতে পাইতেছি না, কারণ কেন্দ্রসমূহ ভিন্ন ভিন্ন।
এই দেহ জড়পরমাণু গঠিত, আর ইহা জড় ও অচেতন। যাহাকে সূক্ষ্ম শরীর বলা হয়, তাহাও ঐরূপ। সাংখ্যের মতে সূক্ষ্ম শরীর অতি সূক্ষ্ম পরমাণুগঠিত একটি ক্ষুদ্র শরীর-উহার পরমাণুগুলি এত সূক্ষ্ম যে, কোনপ্রকার অনুবীক্ষণযন্ত্র দ্বারাও ঐগুলি দেখিতে পাওয়া যায় না। এই সূক্ষ্ম দেহের প্রয়োজন কি? আমরা যাহাকে ‘মন’ বলি, উহা তাহার আধার স্বরূপ। যেমন এই স্থূল শরীর স্থূলতর শক্তিসমূহের আধার, সেরূপ সূক্ষ্ম শরীর চিন্তা উহার নানাবিধ বিকারস্বরূপ সূক্ষ্মতর শক্তিসমূহের আধার। প্রথমতঃ এই স্থূল শরীর-ইহা স্থূল জড় ও স্থূল শক্তিময়। জড় ব্যতীত শক্তি থাকিতে পারে না, কারণ কেবল জড়ের মধ্য দিয়াই শক্তি নিজেকে প্রকাশ করিতে পারে। অতএব স্থূলতর শক্তিসমূহ এই স্থূল শরীরের মধ্য দিয়াই কার্য করিতে পারে এবং অবশেষে ঐগুলি সূক্ষ্মতর রূপ ধারণ করে। যে শক্তি স্থূলভাবে কার্য করিতেছে তাহাই সূক্ষ্মতররূপে কার্য করিতে থাকে এবং চিন্তারূপে পরিণত হয়। উহাদের মধ্যে কোনরূপ বাস্তব ভেদ নাই, একই বস্তুর একটি স্থূল অপরটি সূক্ষ্ম প্রকাশ মাত্র। সূক্ষ্ম শরীর ও স্থূল শরীরের মধ্যেও উপাদানগত কোন ভেদ নাই। সূক্ষ্ম শরীরও জড়, তবে উহা খুব সূক্ষ্ম জড়।
এই সকল শক্তি কোথা হইতে আসে? বেদান্তদর্শনের মতে—প্রকৃতি দুইটি বস্তুতে গঠিত। একটিকে তাহারা ‘অকাশ’ বলেন, উহা অতি সূক্ষ্ম জড়, আর অপরটিকে তাহারা ‘প্রাণ’ বলেন। আপনারা পৃথিবী, বায়ু বা অন্য যাহা কিছু দেখেন, শুনেন বা স্পর্শ দ্বারা অনুভব করেন, তাহাই জড়; এবং সবগুলিই এই আকাশের ভিন্ন ভিন্ন রূপমাত্র। উহা প্রাণ বা সর্বব্যাপী শক্তির প্রেরণায় কখন সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হয়, কখন স্থূল হইতে স্থূলতর হয়। আকাশের ন্যায় প্রাণও সর্বব্যাপী—সর্ববস্তুতে অনুস্যূত। আকাশ যেন জলের মতো এবং জগতে আর যাহা কিছু আছে, সবই বরফখণ্ডের মতো, ঐগুলি জল হইতে উৎপন্ন হইয়া জলেই ভাসিতেছে; আর প্রাণই সেই শক্তি, যাহা আকাশে এই বিভিন্নরূপে পরিণত করিতেছে।
পৈশকিগতি অর্থাৎ চলা-ফেরা, ওঠা-বসা, কথা বলা প্রভৃতি প্রণের স্থূলরূপ প্রকাশের জন্য এই দেহয়ন্ত্র আকাশ হইতে নির্মিত হইয়াছে। সূক্ষ্মশরীরও সেই প্রাণের চিন্তারূপ সূক্ষ্ম আকারে অভিব্যক্তির জন্য আকাশ হইতে—আকাশের সূক্ষ্মতর রূপ হইতে নির্মিত হইয়াছে। অতএব প্রথমে এই স্থূল শরীর, তারপর সূক্ষ্ম শরীর, তারপর জীব বা আত্মা—উহাই যথার্থ মানব। যেমন আমাদের নখ বৎসরে শতবার কাটিয়া ফেলা যাইতে পারে, কিন্তু উহা আমাদের শরীরেরই অংশ, উহা হইতে পৃথক নয়, তেমনি আমাদের শরীর দুইটি নয়। মানুষের একটি সূক্ষ্ম শরীরআর একটি স্থূল শরীর আছে, তাহা নয়; শরীর একই, তবে সূক্ষাকারে উহা অপেক্ষকৃত দীর্ঘকাল থাকে, আর স্থূলটি শীঘ্রই নষ্ট হইয়া যায়। যেমন আমি বৎসরে শতবার নখ কাটিয়া ফেলিতে পারি, সেরূপ একযুগে আমি লক্ষ লক্ষ স্থূল শরীর ত্যাগ করিতে পারি, কিন্তু সূক্ষ্ম শরীর থাকিয়া যাইবে। দ্বৈতবাদীদের মতে এই জীব অর্থাৎ যথার্থ ‘মানুষ’ সূক্ষ্ম-অতি সূক্ষ্ম।
এতদূর পর্যন্ত আমরা দেখিলাম, মানুষের আছে প্রথমতঃ এই স্থূল শরীর, যাহা অতি শীঘ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তারপর সূক্ষ্ম শরীর—উহা যুগ যুগ ধরিয়া বর্তমান থাকে, তারপর জীবাত্মা। বেদান্তদর্শনের মতে ঈশ্বর যেমন নিত্য, এই জীবও সেইরূপ নিত্য, আর প্রকৃতিও নিত্য, তবে উহা প্রবাহরূপে নিত্য। প্রকৃতির উপাদান আকাশ ও প্রাণ নিত্য, কিন্তু অনন্তকাল ধরিয়া উহারা বিভিন্ন আকারে পরিবর্তিত হইতেছে। জড় ও শক্তি নিত্য, কিন্তু উহাদের সমবায়সমূহ সর্বদা পরিবর্তনশীল। জীব—আকাশ বা প্রাণ কিছু হইতেই নির্মিত নয়, উহা অ-জড়, অতএব চিরকাল ধরিয়া উহা থাকিবে। উহা প্রাণ ও আকাশের কোনরূপ সংযোগের ফল নয়, আর যাহা সংযোগের ফল নয়, তাহা কখন নষ্ট হইবে না; কারণ বিনাশের অর্থ সংযোগের বিশ্লেষণ। যে কোন বস্তু যৌগিক নয়, তাহা কখনও নষ্ট হইতে পারে না। স্থূল শরীর আকাশ ও প্রণের নানারূপ সংযোগের ফল, সুতরাং উহা বিশ্লিষ্ট হইয়া যাইবে। সূক্ষ্ম শরীরও দীর্ঘকাল পরে বিশ্লিষ্ট হইয়া যাইবে, কিন্তু জীব অযৌগিক পদার্থ, সুতরাং উহা কখনও ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে না। ঐ একই কারণে আমরা বলিতে পারি না, জীবের কোনকাল জন্ম হইয়াছে। কোন অযৌগিক পদার্থের জন্ম হইতে পারে না; কেবল যাহা যৌগিক, তাহারই জন্ম হইতে পারে।
লক্ষ কোটি প্রকারে মিশ্রিত এই সমগ্র প্রকৃতি ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন। ঈশ্বর সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ ও নিরাকার এবং তিনি দিবারাত্র এই প্রকৃতিকে পরিচালিত করিতেছেন। সমগ্র প্রকৃতিই তাঁহার শাসনাধীনে রহিয়াছে। কোন প্রাণীর স্বাধীনতা নাই—থাকিতেই পারে না। তিনিই শাস্তা। ইহাই দ্বৈত বেদান্তের উপদেশ।
তারপর এই প্রশ্ন আসিতেছে : ঈশ্বর যদি এই জগতের শাস্তা হন, তবে তিনি কেন এমন কুৎসিত জগৎ সৃষ্টি করিলেন? কেন আমরা এত কষ্ট পাইব? ইহার উত্তর এইরূপে দেওয়া হইয়া থাকে : ইহাতে ঈশ্বরের কোন দোষ নাই। আমাদের নিজেদের দোষেই আমরা কষ্ট পাইয়া থাকি। আমরা যেরূপ বীজ বপন করি, সেইরূপ শস্যই পাইয়া থাকি। ঈশ্বর আমাদিগকে শাস্তি দিবার জন্য কিছু করেন না। যদি কোন ব্যক্তি দরিদ্র, অন্ধ বা খঞ্জ হইয়া জন্মগ্রহণ করে, বুঝিতে হইবে সে ঐভাবে জন্মিবার পূর্বে এমন কিছু করিয়াছিল, যাহা এইরূপ ফল প্রসব করিয়াছে। জীব চিরকাল বর্তমান আছে, কখন সৃষ্ট হয় নাই; চিরকাল ধরিয়া নানারূপ কার্য করিতেছে। আমরা যাহা কিছু করি, তাহারই ফলভোগ করিতে হয়। যদি শুভকর্ম করি, তবে আমরা সুখলাভ করিব, অশুভ কর্ম করিলে দুঃখভোগ করিতে হইবে। জীব স্বরূপতঃ শুদ্ধস্বভাব, তবে দ্বৈতবাদী বলেন, অজ্ঞান উহার স্বরূপকে আবৃত করিয়াছে। যেমন অসৎ কর্মের দ্বারা উহা নিজেকে অজ্ঞানে আবৃত করিয়াছে, তেমনি শুভকর্মের দ্বারা উহা নিজস্বরূপ পুনরায় জানিতে পারে। জীব যেমন নিত্য, তেমনই শুদ্ধ। প্রত্যেক জীব স্বরূপতঃ শুদ্ধ। যখন শুভকর্মের দ্বারা উহার পাপ ও অশুভ কর্ম ধৌত হইয়া যায়, তখন জীব আবার শুদ্ধ হয়, তখন সে মৃত্যুর পর দেবযান-পথে স্বর্গে বা দেবলোকে গমন করে। যদি সে সাধারণভাবে ভাল লোক হয়, সে পিতৃলোকে গমন করে।
স্থূলদেহের পতন হইলে বাগিন্দ্রিয় মনে প্রবেশ করে। বাক্য ব্যতীত চিন্তা করিতে পারা যায় না; যেখানেই বাক্য সেখানেই চিন্তা বিদ্যমান। মন আবার প্রাণে লীন হয়, প্রাণ জীবে লয়প্রাপ্ত হয়; তখন দেহত্যাগ করিয়া জীব তাঁহার অতীত জীবনের কর্ম দ্বারা অর্জিত পরস্কার বা শাস্তির যোগ্য এক অবস্থায় গমন করে। দেবলোক আর্থে দেবগণের বাসস্থান। ‘দেব’ শব্দের অর্থ উজ্জ্বল বা প্রকাশস্বভাব। খ্রীষ্টান বা মুসলমানেরা যাহাকে এঞ্জেল (Angel) বলেন, ‘দেব’ বলিতে তাহাই বুঝায়। ইহাদের মতে—দান্তে তাঁহার ‘ডিভাইন কমেডি’ (Divine Comedy) কাব্যগ্রন্থে যেরূপ নানাবিধ স্বর্গলোকের বর্ণনা করিয়াছেন, কতকটা তাহারই মতো নানা প্রকার স্বর্গলোক আছে। যথা পিতৃলোক, দেবলোক, চন্দ্রলোক, বিদ্যুল্লোক, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মলোক—ব্রহ্মার স্থান। ব্রহ্মলোক ব্যতীত অন্যান্য স্থান হইতে জীব ইহলোকে ফিরিয়া আসিয়া আবার নর-জন্ম গ্রহণ করে, কিন্তু যিনি ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়, তিনি সেখানে অনন্তকাল ধরিয়া বাস করেন। যে সকল শ্রেষ্ঠ মানব সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ও সম্পূর্ণ পবিত্র হইয়াছেন, যাহারা সমুদয় বাসনা ত্যাগ করিয়াছেন, যাঁহারা ঈশ্বরের উপাসনা ও তদীয় নিমগ্ন হওয়া ব্যতীত অর কিছু করিতে চান না, তাঁহাদেরই এইরূপ শ্রেষ্ঠ গতি হয়। ইঁহাদের অপেক্ষা কিঞ্চিৎ নিম্নস্তরের দ্বিতীয় আর এক শ্রেণীর লোক আছেন, যাহারা শুভ কর্ম করেন বটে, কিন্তু সেজন্য পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষা করেন, তাঁহারা ঐ শুভকর্মের বিনিময়ে স্বর্গে যাইতে চান। মৃত্যুর পর তাঁহাদের জীবাত্মা চন্দ্রলোকে গিয়া স্বর্গসুখ ভোগ করিতে থাকেন। জীবাত্মা দেবতা হন। দেবগণ অমর নন, তাঁহাদিগকেও মরিতে হয়। স্বর্গেও সকলেই মরিবে। মৃত্যুশূন্য স্থান কেবল ব্রহ্মলোক, সেখানেই কেবল জন্মও নাই মৃত্যুও নাই। আমাদের পুরাণে দৈতগনেরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহারা সময়ে সময়ে দেবগণকে আক্রমণ করেন। সর্বদেশের পুরাণেই এই দেব দৈত্যের সংগ্রাম দেখিতে পাওয়া যায়। সময়ে সময়ে দৈত্যেরা দেবগণের উপর জয়লাভ করিয়া থাকে। সকল দেশের পুরাণে ইহাও পাওয়া যায় যে, দেবগণ সুন্দরী মানব-দুহিতাদের ভালবাসে। দেবরূপে জীব কেবল তাহার অতীত কর্মের ফলভোগ করেন, কিন্তু কোন নূতন কর্ম করেন না। কর্ম-অর্থে যে-সকল কার্য ফলপ্রসব করিবে, সেইগুলি বুঝাইয়া থাকে, আবার ফল গুলিকেও বুঝাইয়া থাকে। মানুষের যখন মৃত্যু হয় এবং সে একটি দেব-দেহ লাভ করে, তখন সে কেবল সুখভোগ করে, নূতন কোন কর্ম করে না। সে তাহার অতীত শুভকর্মের পুরস্কার ভোগ করে মাত্র। কিন্তু যখন ঐ শুভকর্মের ফল শেষ হইয়া যায়, তখন তাঁহার অন্য কর্ম ফলোন্মুখ হয়।
বেদে নরকের কোন প্রসঙ্গ নাই। কিন্তু পরবর্তীকালে পুরাণকারগণ—আমাদের পরবর্তী কালের শাস্ত্রকারগণ—ভবিয়াছিলেন, নরক না থাকিলে কোন ধর্মই সম্পূর্ণ হইতে পারে না, সুতরাং তাহারা নানাবিধ নরক কল্পনা করিলেন।দান্তে তাহার ‘নরকে’ (Inferno) যত প্রকার শাস্তি কল্পনা করিয়াছেন, ইঁহারা ততপ্রকার, এমন কি তাহা অপেক্ষা অধিক প্রকার নরক যন্ত্রণার কল্পনা করিলেন। তবে আমাদের শাস্ত্র দয়া করিয়া বলেন, এই শাস্তি কিছুকালের জন্য মাত্র। ঐ অবস্থায় অশুভ কর্মের ফলভোগ হইয়া উহা ক্ষয় হইয়া যায়, তখন জীবাত্মাগণ পুনরায় পৃথিবীতে আসিয়া আর একবার উন্নতি করিবার সুযোগ পায়। এই মানবদেহেই উন্নতিসাধনের বিশেষ সুযোগ পাওয়া যায়। এই মানব দেহকে ‘কর্মদেহ’ বলে, এই মানব দেহেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ অদৃষ্ট স্থির করিয়া থাকি। আমরা একটি বৃহৎ বৃত্তপথে ভ্রমণ করিতেছি, আর মানবদেহই সেই বৃত্তের মধ্যে একটি বিন্দু, যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়। এই কারণেই আন্যান্য সর্বপ্রকার দেহ অপেক্ষা মানবদেহই শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। দেবগণ অপেক্ষাও মানুষ মহত্তর। দেবগণও মনুষ্যজন্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন। এই পর্যন্ত দ্বৈত-বেদান্তের আলোচনা।
তারপর বেদান্ত দর্শনের আর ঐক উচ্চতর ধারণা আছে—সেদিক হইতে দেখিলে এগুলি অপরিণত ভাব। যদি বলেন ঈশ্বর অনন্ত, জীবাত্মাও অনন্ত, এবং প্রকৃতিও অনন্ত, তবে এইরূপ অনন্তের সংখ্যা আপনি যত ইচ্ছা বাড়াইতে পারেন, কিন্তু এইরূপ করা অযৌক্তিক; কারণ এই অনন্তগুলি পরস্পরকে সসীম করিয়া ফেলিবে এবং প্রকৃত অনন্ত বলিয়া কিছু থাকিবে না। ঈশ্বরই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ; তিনি নিজের ভিতর হইতে এই জগৎ বাহিরে প্রক্ষেপ করিয়াছেন। এ-কথার অর্থ কি এই যে, ঈশ্বরই এই দেওয়াল, এই টেবিল, এই পশু, এই হত্যাকারী এবং জগতের যা কিছু সব মন্দ হইয়াছেন? ঈশ্বর শুদ্ধস্বরূপ; তিনি কিরূপে এ-সকল মন্দ জিনিস হইতে পারেন?—না, তিনি এ-সব হন নাই। ঈশ্বর অপরিণামী, এসকল পরিণাম প্রকৃতিতে; যেমন আমি অপরিণামী আত্মা, অথছ আমার দেহ আছে। এক অর্থে—এই দেহ আমা হইতে পৃথক নয়, কিন্তু আমি—যথার্থ আমি কখনই দেহ নই। আমি কখন বালক, কখন যুবা, কখন বা বৃদ্ধ হইতেছি, কিন্তু উহাতে আমার আত্মার কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই। উহা যে আত্মা, সেই আত্মাই থাকে। এইরূপে প্রকৃতি এবং অন্ন্ত-আত্মা-সমন্বিত এই জগৎ যেন ঈশ্বরের অনন্ত শরীর। তিনি ইহার সর্বত্র ওতপ্রোত রহিয়াছেন। তিনি একমাত্র অপরিণামী। কিন্তু প্রকৃতি পরিণামী এবং আত্মাগুলিও পরিণামী। প্রকৃতির কিরূপ পরিণাম হয়? প্রকৃতির রূপ বা আকার ক্রমাগত পরিবর্তিত হইতেছে, উহা নূতন নূতন আকার ধারণ করিতেছে। কিন্তু আত্মাতো এইরূপে পরিণাম প্রাপ্ত হইতে পারে না। উহাদের কেবল জ্ঞানের সঙ্কোচ ও বিকাশ হয়। প্রত্যেক আত্মাই অশুভ কর্ম দ্বারা সঙ্কোচ প্রাপ্ত হয়। যে-সকল কার্যের দ্বারা আত্মার স্বাভাবিক জ্ঞান ও পবিত্রতা সঙ্কুচিত হয়, সেগুলিকেই ‘অশুভ কর্ম’ বলে। যে সকল কর্ম আবার আত্মার স্বাভাবিক মহিমা প্রকাশ করে, সেগুলিকে ‘অশুভ কর্ম’ বলে। সকল আত্মাই শুদ্ধস্বভাব ছিল, কিন্তু নিজ নিজ কর্ম দ্বারা সঙ্কোচ প্রাপ্ত হইয়াছে। তথাপি ঈশ্বরের কৃপায় ও শুভকর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা তাহারা আবার বিকাশপ্রাপ্ত হইবে ও পুনরায় শুদ্ধস্বরূপ হইবে। প্রত্যেক জীবাত্মার মুক্তিলাভের সমান সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে এবং কালে সকলেই শুদ্ধস্বরূপ হইয়া প্রকৃতির বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে। কিন্তু তাহা হইলেও এই জগৎ শেষ হইয়া যাইবে না, কারণ উহা অনন্ত। ইহাই বেদান্তের দ্বিতীয় প্রকার সিদ্ধান্ত। প্রথমোক্তটিকে ‘দ্বৈত বেদান্ত’ বলে; আর দ্বিতীয়টি—যাহার মতে ঈশ্বর, আত্মা ও প্রকৃতি আছেন, আত্মা ও প্রকৃতি ঈশ্বরের দেহস্বরূপ আর ঐ তিনে মিলিয়া এক-ইহাকে ‘বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত’ বলে। আর এই মতাবলম্বিগণকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বলে।
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মত অদ্বৈতবাদ। এই মতেও ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ দুই-ই। সুতরাং ঈশ্বর এই সমগ্র জগৎ হইয়াছেন।
‘ঈশ্বর আত্মা স্বরূপ আর জগৎ যেন তাঁহার দেহ স্বরূপ আর সেই দেহের পরিণাম হইতেছে’ —বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর এই সিদ্ধান্ত অদ্বৈতবাদী স্বীকার করেন না। তাহারা বলেন, তবে আর ঈশ্বরকে এই জগতের উপাদান-কারণ বলিবার কি প্রয়োজন? উপাদানকারণ অর্থে যে কারণটি কার্যরূপ ধারণ করিয়াছে। কার্য কারণের রূপান্তর বই আর কিছুই নয়। যেখানেই কার্য দেখা যায়, সেখানেই বুঝিতে হইবে, কারণই রূপান্তরিত হইয়া অবস্থান করিতেছে। যদি জগৎ কার্য হয়, আর ঈশ্বর কারণ হন, তবে এই জগৎ অবশ্যই ঈশ্বরের রূপান্তর মাত্র। যদি বলা হয়, জগৎ ঈশ্বরের শরীর, আর ঐ দেহ সঙ্কোচপ্রাপ্ত হইয়া সূক্ষাকার ধারণ করিয়া কারণ হয় এবং পরে আবার সেই কারণ হইতে জগতের বিকাশ হয়, তাহাতে অদ্বৈতবাদী বলেন, ঈশ্বর স্বয়ংই এই জগৎ হইয়াছেন। এখন একটি অতি সূক্ষ্ম প্রশ্ন আসিতেছে। যদি ঈশ্বর এই জগৎ হইয়া থাকেন, তবে সবই ঈশ্বর। অবশ্য সবই ঈশ্বর। আমার দেহও ঈশ্বর, আমার মনও ঈশ্বর, আমার আত্মাও ঈশ্বর। তবে এত জীব কোথা হইতে অসিল? ঈশ্বর কি লক্ষ লক্ষ জীবরূপে বিভক্ত হইয়াছেন? সেই অনন্ত শক্তি, সেই অনন্ত পদার্থ, জগতের সেই এক সত্তা কিরূপে বিভক্ত হইতে পারেন? অনন্তকে বিভাগ করা অসম্ভব। তবে কিভাবে সেই শুদ্ধসত্তা (সৎস্বরূপ) এই জগৎ হইলেন? যদি তিনি জগৎ হইয়া থাকেন, তবে তিনি পরিণামী, পরিণামী হইলেই তিনি প্রকৃতির অন্তর্গত, যাহা কিছু প্রকৃতির অন্তর্গত তাহারই জন্ম মৃত্যু আছে, যদি ঈশ্বর পরিণামী হন, তবে তাঁহারও একদিন মৃত্যু হইবে। এইটি মনে রাখিবেন। আর একটি প্রশ্ন : ঈশ্বরের কতখানি এই জগৎ হইয়াছে? যদি বলেন ঈশ্বরের ‘ক’ অংশ জগৎ হইয়াছে, তবে ঈশ্বর=‘ঈশ্বর’-ক; অতএব সৃষ্টির পূর্বে তিনি যে ঈশ্বর ছিলেন, এখন আর সে ঈশ্বর নাই; কারণ তাঁহার কিছুটা অংশ জগৎ হইয়াছে। ইহাতে অদ্বৈতবাদীর উত্তর এই যে, এই জগতের বাস্তবিক সত্তা নাই, ইহার অস্তিত্ব প্রতীয়মান হইতেছে মাত্র। এই দেবতা, স্বর্গ, জন্মমৃত্যু, অনন্ত সংখ্যক আত্মা আসিতেছে, যাইতেছে—এই সবই কেবল স্বপ্নমাত্র। সমুদয়ই সেই এক অনন্তস্বরূপ। একই সূর্য বিবিধ জলবিন্দুতে প্রতিবিম্বিত হইয়া নানারূপ দেখাইতেছে। লক্ষ লক্ষ জলকণাতে লক্ষ লক্ষ সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে, আর প্রত্যেক জলকণাতেই সূর্যের সম্পূর্ণ প্রতিমূর্তি রহিয়াছে; কিন্তু সূর্য প্রকৃতপক্ষে একটি। এই সকল জীব সম্বন্ধেও সেই কথা—তাহারা সেই এক অনন্ত পুরুষের প্রতিবিম্বমাত্র। স্বপ্ন কখন সত্য ব্যতীত থাকিতে পারে না, আর সেই সত্য—সেই এক অনন্ত সত্তা। শরীর, মন বা জীবাত্মাভাবে ধরিলে আপনি স্বপ্নমাত্র, কিন্তু আপনার যথার্থ স্বরূপ অখণ্ড সচ্চিদানন্দ। অদ্বৈতবাদী ইহাই বলেন। এই সব জন্ম, পূনর্জন্ম, এই আসা-যাওয়া—এ-সব সেই স্বপ্নের অংশমাত্র। আপনি অনন্তস্বরূপ। আপনি আবার কোথায় যাইবেন? সূর্য, চন্দ্র ও সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড আপনার যথার্থ স্বরূপের নিকট একটি বিন্দুমাত্র। আপনার আবার জন্মমরণ কিরূপে হইবে? আত্মা কখন জন্মান নাই, কখন মরিবেনও না; আত্মার কোনকালে পিতামাতা, শত্রুমিত্র কিছুই নাই; কারণ আত্মা অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ।
অদ্বৈত বেদান্তের মতে মানুষের চরম লক্ষ্য কি?- এই জ্ঞানলাভ করা ও জগতের সহিত এক হইয়া যাওয়া। যাঁহারা এই অবস্থা লাভ করেন, তাঁহাদের পক্ষে সমুদয় স্বর্গ, এমনকি ব্রহ্মলোক পর্যন্ত নষ্ট হইয়া যায়, এই সমুদয় স্বপ্ন ভাঙিয়া যায়, আর তাহারা নিজদিগকে জগতের নিত্য ঈশ্বর বলিয়া দেখিতে পান। তাঁহারা তাঁহাদের যথার্থ ‘আমিত্ব’ লাভ করেন—আমরা এখন যে ক্ষুদ্র অহংকে এত বড় একটা জিনিস বলিয়া মনে করিতেছি, উহা তাহা হইতে অনেক দূরে। আমিত্ব নষ্ট হইবে না-অনন্ত ও সনাতন আমিত্ব লাভ হইবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুতে সুখবোধ আর থাকিবে না। আমরা এখন এই ক্ষুদ্র দেহে এই ক্ষুদ্র আমিকে লইয়া সুখ পাইতেছি। যখন সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড আমাদের নিজেদের দেহ বলিয়া বোধ হইবে, তখন আমরা কত অধিক সুখ পাইব? এই পৃথক্ পৃথক্ দেহে যদি এত সুখ থকে, তবে যখন সকল দেহ এক হইয়া যাইবে, তখন আরও কত অধিক সুখ! যে ব্যক্তি ইহা অনুভব করিয়াছে, সে-ই মুক্তিলাভ করিয়াছে, সে এই স্বপ্ন কাটাইয়া তাহার পারে চলিয়া গিয়াছে, নিজের যথার্থ স্বরূপ জানিয়াছে। ইহাই অদ্বৈত-বেদান্তের উপদেশ।
বেদান্তদর্শন একটির পর একটি সোপানত্রয় অবলম্বন করিয়া অগ্রসর হইয়াছে, আর আমরা ঐ তৃতীয় সোপান অতিক্রম করিয়া আর অগ্রসর হইতে পারি না, কারণ আমরা একত্বের পর আর যাইতে পারি না।
যাহা হইতে জগতের সবকিছু উৎপন্ন হইয়াছে, সেই পূর্ণ একস্বরূপের ধারণার বেশী আমরা আর যাইতে পারি না। এই অদ্বৈতবাদ সকলে গ্রহণ করিতে পারে না; সকলের দ্বারা গৃহীত হইবার পক্ষে ইহা বিশেষ কঠিন। প্রথমতঃ বুদ্ধিবিচারের দ্বারা এই তত্ত্ব বুঝা অতিশয় কঠিন। ইহা বুঝিতে তীক্ষ্ণতম বুদ্ধির প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ উহা অধিকাংশ ব্যক্তিরই উপযোগী নয়।
এই তিনটি সোপানের মধ্যে প্রথমটি হইতে আরম্ভ করা ভাল। ঐ প্রথম সোপানটির সম্বন্ধে চিন্তাপূর্বক ভাল করিয়া বুঝিলে দ্বিতীয়টি আপনিই খুলিয়া যাইবে। যেমন একটি জাতি ধীরে ধীরে উন্নতি-সোপানে অগ্রসর হয়, ব্যক্তিকেও সেইরূপ করিতে হয়। ধর্মজ্ঞানের উচ্চতম চূড়ায় আরোহণ করিতে মানবজাতিকে যে সকল সোপান অবলম্বন করিতে হইয়াছে, প্রত্যেক ব্যক্তিকেও তাহাই অবলম্বন করিতে হইবে। কেবল প্রভেদ এই যে, সমগ্র মানবজাতির এক সোপান হইতে সোপানান্তরে আরোহণ করিতে লক্ষ লক্ষ বর্ষ লাগিয়াছে, কিন্তু ব্যক্তি মানব কয়েক বর্ষের মধ্যেই মানবজাতির সমগ্র জীবন যাপন করিয়া ফেলিতে পারেন, অথবা আরও শীঘ্র—হয়তো ছয় মাসের মধ্যেই পারেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেককেই এই সোপানগুলির মধ্য দিয়া যাইতে হইবে। আপনাদের মধ্যে যাহারা অদ্বৈতবাদী, তাঁহারা যখন ঘোর দ্বৈতবাদী ছিলেন, নিজেদের জীবনের সেই সময়ের কথা অবশ্যই মনে করিতে পারেন। যখনই আপনারা নিজদিগকে দেহ ও মন বলিয়া ভাবেন, তখন আপনাদিগকে এই স্বপ্নের সমগ্রটাই লইতে হইবে। একটি ভাব লইলেই সমুদয়টি লিতে হইবে। যে ব্যক্তি বলে জগৎ রহিয়াছে, কিন্তু ঈশ্বর নাই, সে নির্বোধ; কারণ যদি জগৎ থাকে, তবে জগতের একটা কারণও থাকিবে, আর সেই কারণের নামই ঈশ্বর। কার্য থাকিলেই তাহার কারণ আছে, অবশ্য জানিতে হইবে। যখন জগৎ অন্তর্হিত হইবে, তখন ঈশ্বরও অন্তর্হিত হইবেন। যখন আপনি ঈশ্বরের সহিত নিজ একত্ব অনুভব করিবেন, তখন আপনার পক্ষে আর এই জগৎ থাকিবে না। কিন্তু যতদিন এই স্বপ্ন আছে, ততদিন আমরা আমাদিগকে জন্মমৃত্যুশীল বলিয়া মনে করিতে বাধ্য, কিন্তু যখনই ‘আমার দেহ’-এই স্বপ্ন অন্তর্হিত হয়, অমনি সঙ্গে সঙ্গে ‘আমরা জন্মাইতেছি ও মরিতেছি’—এ স্বপ্নও অন্তর্হিত হইবে, এবং ‘একটা জগৎ আছে’—এই স্বপ্নও চলিয়া যাইবে।
যাহাকে আমরা এখন এই জগৎ বলিয়া দেখিতেছি, তাহাই আমাদের নিকট ঈশ্বর বলিয়া প্রতিভাত হইবে এবং যে-ঈশ্বরকে এতদিন আমরা বাহিরে অবস্থিত বলিয়া জানিতেছিলাম, তিনিই আমাদের আত্মার অন্তরাত্মারূপে প্রতীত হইবেন। অদ্বৈতবাদের শেষ কথা ‘তত্ত্বমসি’—তাহাই তুমি।
০১. সূচনা
আমাদের এই জগৎ-এই পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ-যাহার তত্ত্ব আমারা যুক্তি ও বুদ্ধি-বলে বুঝিতে পারি, তাহার উভয় দিকেই অনন্ত, উভয় দিকেই অজ্ঞেয়-‘চির-অজ্ঞাত’ বিরাজমান। যে জ্ঞানালোক জগতে ‘ধর্ম’ নামে পরিচিত, তাহার তত্ত্ব এই জগতেই অনুসন্ধান করিতে হয়; যে-সকল বিষয়ের আলোচনায় ধর্মলাভ হয়, সেগুলি এই জগতেরই ঘটনা। স্বরূপতঃ কিন্তু ধর্ম অতীন্দ্রিয় ভূমির অধিকারভুক্ত, ইন্দ্রিয় রাজ্যের নয়।উহা সর্বপ্রকার যুক্তির অতীত, সুতরাৎ উহা বুদ্ধির রজ্যের অধিকার নয়। । উহা দিব্যদর্শন-স্বরূপ-মানব মনে ঈশ্বরীয় অলৌকিক প্রভাবস্বরূপ, উহা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ের সমুদ্রে ঝম্পপ্রদান, উহাতে অজ্ঞেয়কে জ্ঞাত অপেক্ষা আমাদের অধিক পরিচিতি করিয়া দেয়, কারণ জ্ঞান কখনও ‘জ্ঞাত’ হইতে পারে না। আমার বিশ্বাস, মানব সমাজের প্রারম্ভ হইতেই মানব-মনে এই ধর্মতত্ত্বের অনুসন্ধান চলিয়াছে। জগতের ইতিহাসে এমন সময় কখনই হয় নাই, যখন মানব-যুক্তি ও মানব-বুদ্ধি এক জগদতীত বস্ত্তর জন্য এই অনুসন্ধান-এই প্রাণপণ চেষ্টা না করিয়াছে।
আমাদের ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডে-এই মানব মানে-আমরা দেখিতে পাই, একটি চিন্তার উদয় হইল; কোথা হইতে উহার উদয় হইল তাহা আমরা জানি না; আর যখন উহা তিরোহিত হইল, তখন উহা যে কোথায় গেল, তাহাও আমরা জানি না। বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ যেন একই পথে চলিয়াছে, এক প্রকার অবস্থার ভিতর দিয়া যেন উভয়কেই চলিতে হইতেছে, উভয়েই যেন এক সুরে বাজিতেছে।
এই বক্তৃতাসমূহে আমি আপনাদের নিকট হিন্দুদের এই মত ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিব যে, ধর্ম মানুষের ভিতর হইতেই উৎপন্ন, উহা বাহিরের কিছু হইতে হয় নাই। আমার বিশ্বাস, ধর্মচিন্তা মানবের প্রকৃতিগত; উহা মানুষের স্বভাবের সহিত এমন অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত যে, যতদিন না সে নিজ দেহমনকে অস্বীকার করিতে পারে, যতদিন না সে চিন্তা ও জীবন-ভাব ত্যাগ করিতে পারে, ততদিন তাহার পক্ষে ধর্ম ত্যাগ করা অসম্ভব। যতদিন মানবের চিন্তাশক্তি থাকিবে, ততদিন এই চেষ্টাও চলিবে এব ততদিন কোন্-না-কোন আকারে তাহার ধর্ম থাকিবেই থাকিবে।এই জন্যই আমরা জগতে নানাপ্রকারের ধর্ম দেখিতে পাই। অবশ্য এই আলোচনা আমাদের হতবুদ্ধি করিতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকে যে এরূপ চর্চাকে বৃথা কল্পনা মনে করেন, তাহা ঠিক নয়। নানা আপাতবিরোধী বিশৃঙ্খলার ভিতর সামঞ্জস্য আছে, এই-সব বেসুরা-বেতালার মধ্যেও ঐক্যতান আছে; যিনি উহা শুনিতে প্রস্তুত, তিনিই সেই সুর শুনিতে পাইবেন।
বর্তমান কালে সকল প্রশ্নের মধ্যে প্রধান প্রশ্ন এইঃ মানিলাম, জ্ঞাত ও জ্ঞেয়ের উভয় দিকেই অজ্ঞেয় ও অনন্ত অজ্ঞাত রহিয়াছে, কিন্তু ঐ অনন্ত অজ্ঞাতকে জানিবার চেষ্টা কেন? কেন আমরা জ্ঞাতকে লইয়াই সন্তুষ্ট না হই? কেন আমরা ভোজন, পান ও সমাজের কিছু কল্যাণ করিয়াই সন্তুষ্ট না থাকি? এই ভাবের কথাই চারিদিকে শুনিতে পাওয়া যায়। খুব বড় বড় বিদ্বান্ অধ্যাপক হইতে অনর্গল কথা-বলা শিশুর মুখেও আমরা আজকাল শুনিয়া থাকি-জগতের উপকার কর, ইহাই একমাত্র ধর্ম, জগদতীত সত্তার সমস্যা লইয়া নাড়াচাড়া করার কোন ফল নাই। এই ভবটি এখন এতদূর প্রবল হইয়াছে যে, ইহা একটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই জগদতীত সত্তার তত্ত্বানুসন্ধান না করিয়া থাকিবার জো আমাদের নাই। এই বর্তমান ব্যক্ত জগৎ সেই অব্যক্তের এক অংশমাত্র। এই পঞ্চেন্দ্রিয়-গ্রাহ্য জগৎ যেন সেই অনন্ত আধ্যাত্মিক জগতের একটি ক্ষুদ্র অংশ-আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তরে আসিয়া পড়িয়াছে। সুতরাং জগদতীতকে না জানিলে কিরূপে উহার এই ক্ষুদ্র প্রকাশের বাখ্যা হইতে পারে, উহাকে বুঝা যাইতে পারে? কথিত আছে, সক্রেটিস্ একদিন এথেন্সে বক্তৃতা দিতেছিলেন, এমন সময় তাঁহার সহিত এক ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ হয়-ইনি ভারত হইতে গ্রীসদেশে গিয়াছিলেন। সক্রেটিস্ সেই ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন, ‘মানুষকে জানাই মানবজাতির সর্বোচ্চ কর্তব্য-মানবই মানবের সর্বোচ্চ আলোচনার বস্তু।’ ব্রাহ্মণ তৎক্ষাণাৎ প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘যতক্ষণ ঈশ্বরকে না জানিতেছেন, ততক্ষণ মানুষকে কিরূপে জানিবেন?’ এই ঈশ্বর, এই চির অজ্ঞেয় বা নিরপেক্ষ সত্তা, বা অনন্ত, বা নামের অতীত বস্তু-তাঁহাকে যে নামে ইচ্ছা তাহাতেই ডাকা যায়-এই বর্তমান জীবনের যাহা কিছু জ্ঞাত ও যাহা কিছু জ্ঞেয়, সকলেরই একমাত্র যুক্তিযুক্ত বাখ্যাস্বরূপ। যে-কোন বস্তুর কথা-নিছক জড় বস্তুর কথা ধরুন। কেবল জড়-সম্বন্ধীয় বিজ্ঞানের মধ্যে যে-কোন একটি, যথা-রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত-জ্যোতিষ বা প্রাণীতত্ত্ববিদ্যার কথা ধরুন, উহা বিশেষ করিয়া অলোচনা করুন, ঐ তত্ত্বানুসন্ধান ক্রমশঃ অগ্রসর হউক, দেখিবেন স্থূল ক্রমে সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর পদার্থ লয় পাইতেছে, শেষে ঐগুলি এমন স্থানে আসিবে, যেখানে এই সমূদয় জড়বস্তু ছাড়িয়া একেবারে অজড়ে বা চৈতন্যে যাইতেই হইবে। জ্ঞানের সকল বিভাগেই স্থূল ক্রমশঃ সূক্ষ্মে মিলাইয়া যায়, পদার্থবিদ্যা দর্শনে পর্যবসিত হয়।
এইরূপ মানুষকে বাধ্য হইয়া জগদতীত সত্তার আলোচনা করিতে হয়। যদি আমরা ঐ তত্ত্ব জানিতে না পারি, তবে জীবন মরুভূমি হইবে, মানবজীবন বৃথা হইবে। এ-কথাবলিতে ভাল যে বর্তমানে যাহা দেখিতেছ, তাহা লইয়াই তৃপ্ত থাকো; গোরু, কুকুর ও অন্যান্য পশুগণ এইরূপ বর্তমান লইয়াই সন্তুষ্ট, আর ঐ ভাবেই তাহাদিগকে পশু করিয়াছে। অতএব যদি মানুষ বর্তমান লইয়া সন্তুষ্ট থাকে এবং জগদতীত সত্তার অনুসন্ধান একাবারে পরিত্যাগ করে, তবে মানবজাতিকে পশুর স্তরে ফিরিয়া যাইতে হইবে। ধর্মই-জগদতীত সত্তার অনুসন্ধানই মানুষ ও পশুতে প্রভেদ করিয়া থাকে। এটি অতি সুন্দর কথা, সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষই স্বভাবতঃ উপরের দিকে চাহিয়া দেখে; অন্যান্য সকল জন্তুই স্বভাবতঃ নীচের দিকে ঝুঁকিয়া থাকে। এই উর্ধ্বদৃষ্টি, উর্ধ্বদিকে গমন ও পূর্ণত্বের অনুসন্ধানকেই ‘পরিত্রাণ’ বা ‘উদ্ধার’ বলে; আর যখনই মানুষ উচ্চতর দিকে গমন করিতে আরম্ভ করে, তখনই সে এই পরিত্রাণ-রূপ সত্যের ধারণার দিকে নিজেকে উন্নীত করে। পরিত্রাণ-অর্থ, বেশভূষা বা গৃহের উপর নির্ভর করে না, উহা মানুষের মস্তিষ্কস্থ আধ্যাত্মিক ভাব-সম্পদের তারতম্যের উপর নির্ভর করে। উহাতেই মানবজাতির উন্নতি, উহাই ভৌতিক ই মানসিক সর্ববিধ উন্নতির মূল; ঐ প্রেরণাশক্তিবলে-ঐ উৎসাহ-বলেই মানবজাতি সন্মুখে অগ্রসর হইয়া থাকে।
ধর্ম-প্রচুর অন্ন ও পানে নাই, অথবা সুরম্য হর্ম্যেও নাই। বারংবার ধর্মের বিরুদ্ধে আপনারা এই আপত্তি শনিতে পাইবেনঃ ধর্মের দ্বারা কি উপকার হইতে পারে? উহা কি দরিদ্রের দারিদ্র দূর করিতে পারে? মনে করূন, উহা যেন পারে না, তাহা হইলেই কি ধর্ম অসত্য বলিয়া প্রমাণিত হইল? মনে করূন আপনি একটি জ্যোতিষের সিদ্ধান্ত প্রমান করিতে চেষ্টা করিতেছেন-একটি শিশু দাঁড়াইয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ইহাতে কি মনোমত খাবার পাওয়া যায়?’ আপনি উত্তর দিলেন-‘না, পাওয়া যায় না।’ তখন শিশুটি বলিয়া উঠিল, ‘তবে ইহা কোন কাজের নয়।’ শিশুরা তাহাদের নিজেদের দৃষ্টি হইতে অর্থাৎ কোন জিনিসে কত ভাল খাবার পাওয়া যায়, এই হিসাবে সমগ্র জগতের বিচার করিয়া থাকে। যাহারা অজ্ঞানাচ্ছন্ন বলিয়া শিশুসদৃশ, সংসারের সেই শিশুদের বিচারও ঐরূপ। নিম্নভূমির দৃষ্টি হইতে উচ্চতর বস্তুর বিচার করা কখনই কর্তব্য নয়। প্রত্যেক বিষয়ই তাহার নিজস্ব মনের দ্বারা বিচার করিতে হইবে। অনন্তের দ্বারা অনন্তকে বিচার করিতে হইবে। ধর্ম সমগ্র মানবজীবনে অনুস্যূত, শুধু বর্তমানে নয়-ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান সর্বকালে। অতএব ইহা অনন্ত আত্মা ও অনন্ত ঈশ্বরের মধ্যে অনন্ত সম্বন্ধ। অতএব ক্ষনিক মানবজীবনের উপর উহার কার্য দেখিয়া উহার মূল্য বিচার করা কি ন্যায়সঙ্গত?- কখনই নয়। এগুলি সব নেতিমূলক যুক্তি।
এখন প্রশ্ন উঠিতেছে, ধর্মের দ্বারা কি প্রকৃতপক্ষে কোন ফল হয়? হাঁ হয় ; উহাতে মানুষ অনন্ত জীবন লাভ করে। মানুষ বর্তমানে যাহা, তাহা এই ধর্মের শক্তিতেই হইয়াছে, আর উহাই এই মনুষ্য-নামক প্রাণীকে দেবতা করিবে। ধর্মই ইহা করিতে সমর্থ। মানবসমাজ হইতে ধর্মকে বাদ দাও-কি অবশিষ্ট থাকিবে? তাহা হইলে এই সংসার শ্বাপদসমাকীর্ণ অরন্য হইয়া যাইবে। ইন্দ্রিয় সুখ মানব জীবনের লক্ষ্য নয়, জ্ঞানই সমুদয় প্রাণীর লক্ষ্য। আমরা দেখিতে পাই, পশুগন ইন্দ্রিয়সুখে যতটা প্রীতি অনুভব করে, মানুষ বুদ্ধিশক্তির পরিচালনা করিয়া তদপেক্ষা অধিক সুখ অনুভব করিয়া থাকে ; আর ইহাও আমরা দেখিতে পাই, বুদ্ধি ও বিচারশক্তির পরিচালনা অপেক্ষা আধ্যাত্মিক সুখে মানুষ অধিকতর সুখবোধ করিয়া থাকে। অতএব আধ্যাত্মিকজ্ঞানকে নিশ্চয়ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান বলিতে হইবে। এই জ্ঞানলাভ হইলে সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ আসিবে। জাগতিক সকল বস্তুই সেই প্রকৃত জ্ঞান ও আনন্দের ছায়ামাত্র-শুধু তিন চারি ধাপ নিম্নের প্রকাশ।
আর একটি প্রশ্ন আছে : আমাদের চরম লক্ষ্য কি? আজকাল প্রায়ই বলা হইয়া থাকে যে, মানুষ অনন্ত উন্নতির পথে চলিয়াছে-ক্রমাগত সম্মুখে অগ্রসর হইতেছে, কিন্তু তাহার লাভ করিবার কোন চরম লক্ষ্য নাই। এই ‘ক্রমাগত নিকটবর্তী হওয়া অথচ কখনও লক্ষ্যস্থলে না পৌঁছানো’-ইহার অর্থ যাহাই হউক, আর এ তত্ত্ব যতই অদ্ভূত হউক, ইহা যে অসম্ভব তাহা অতি সহজেই বোধগম্য হইতে পারে। সরল রেখায় কি কখনও কোন প্রকার গতি হইতে পারে? একটি সরল রেখাকে অনন্ত প্রসারিত করিলে উহা একটি বৃত্তরুপে পরিণত হয়; উহা যেখান হইতে আরম্ভ হইয়া ছিল সেখানেই আবার ফিরিয়া যায়। যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছি সেখানেই অবশ্য শেষ করিতে হইবে; আর যখন ঈশ্বর হইতে আপনাদের গতি আরম্ভ হইয়াছে, তখন অবশ্য ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে। তবে ইতি মধ্যে আর করিবার কি থাকে? ঐ অবস্থায় পৌঁছিবার উপযোগী বিশেস বিশেস খুঁটিনাটি কার্যগুলি করিতে হয়-অনন্ত কাল ধরিয়া ইহা করিতে হয়।
আর একটি প্রশ্ন এইঃ আমরা উন্নতিপথে আগ্রসর হইতে হইতে কি ধর্মের নূতন নূতন সত্য আবিষ্কার করিব না? হাঁও বটে, নাও বটে। প্রথমতঃ এইটি বুঝিতে হইবে যে, ধর্ম-সম্বন্ধে অধিক আর কিছু জানিবার নাই, সবই জানা হইয়া গিয়াছে। আপনারা দেখিবেন, জগতের সকল ধর্মাবলম্বীই বলিয়া থাকেন, আমাদের ধর্মে একটি একত্ব আছে। সুতরাং ঈশ্বরের সহিত আত্মার একত্ব-জ্ঞান অপেক্ষা আর অধিক উন্নতি হইতে পারে না। জ্ঞান-অর্থে এই একত্ব-আবিষ্কার। আমি আপনাদিগকে নরনারীরূপে পৃথক দেখিতেছি-ইহাই বহুত্ব। যখন আমি ঐ দুইটি ভাবকে একত্র করিয়া দেখি এবং আপনাদিগকে কেবল ‘মানবজাতি’ বলিয়া অভিহিত করি, তখন উহা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হইল। উদাহরনস্বরূপ রসায়নশাস্ত্রের কথা ধরূন। রসায়নিকেরা সর্বপ্রকার জ্ঞাত বস্তুকে ঐগুলির মূল উপাদানে পরিনত করিবার চেষ্টা করিতেছেন, আর যদি সম্ভব হয়, তবে যে এক ধাতু হইতে ঐগুলি সব উৎপন্ন হইয়াছে, তাহাও বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এমন সময় আসিতে পারে, যখন তাঁহারা সকল ধাতুর মূল এক মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করিবেন। যদি ঐ অবস্হায় তাঁহারা কখন উপস্হিত হন, তখন তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারিবেন না ; তখন রসায়নবিদ্যা সম্পূর্ন হইবে।
আর একটি প্রশ্ন আছে : আমাদের চরম লক্ষ্য কি? আজকাল প্রায়ই বলা হইয়া থাকে যে, মানুষ অনন্ত উন্নতির পথে চলিয়াছে-ক্রমাগত সম্মুখে অগ্রসর হইতেছে, কিন্তু তাহার লাভ করিবার কোন চরম লক্ষ্য নাই। এই ‘ক্রমাগত নিকটবর্তী হওয়া অথচ কখনও লক্ষ্যস্থলে না পৌঁছানো’-ইহার অর্থ যাহাই হউক, আর এ তত্ত্ব যতই অদ্ভূত হউক, ইহা যে অসম্ভব তাহা অতি সহজেই বোধগম্য হইতে পারে। সরল রেখায় কি কখনও কোন প্রকার গতি হইতে পারে? একটি সরল রেখাকে অনন্ত প্রসারিত করিলে উহা একটি বৃত্তরুপে পরিণত হয়; উহা যেখান হইতে আরম্ভ হইয়া ছিল সেখানেই আবার ফিরিয়া যায়। যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছি সেখানেই অবশ্য শেষ করিতে হইবে; আর যখন ঈশ্বর হইতে আপনাদের গতি আরম্ভ হইয়াছে, তখন অবশ্য ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে। তবে ইতি মধ্যে আর করিবার কি থাকে? ঐ অবস্থায় পৌঁছিবার উপযোগী বিশেস বিশেস খুঁটিনাটি কার্যগুলি করিতে হয়-অনন্ত কাল ধরিয়া ইহা করিতে হয়।
আর একটি প্রশ্ন এইঃ আমরা উন্নতিপথে আগ্রসর হইতে হইতে কি ধর্মের নূতন নূতন সত্য আবিষ্কার করিব না? হাঁও বটে, নাও বটে। প্রথমতঃ এইটি বুঝিতে হইবে যে, ধর্ম-সম্বন্ধে অধিক আর কিছু জানিবার নাই, সবই জানা হইয়া গিয়াছে। আপনারা দেখিবেন, জগতের সকল ধর্মাবলম্বীই বলিয়া থাকেন, আমাদের ধর্মে একটি একত্ব আছে। সুতরাং ঈশ্বরের সহিত আত্মার একত্ব-জ্ঞান অপেক্ষা আর অধিক উন্নতি হইতে পারে না। জ্ঞান-অর্থে এই একত্ব-আবিষ্কার। আমি আপনাদিগকে নরনারীরূপে পৃথক দেখিতেছি-ইহাই বহুত্ব। যখন আমি ঐ দুইটি ভাবকে একত্র করিয়া দেখি এবং আপনাদিগকে কেবল ‘মানবজাতি’ বলিয়া অভিহিত করি, তখন উহা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান হইল। উদাহরনস্বরূপ রসায়নশাস্ত্রের কথা ধরূন। রসায়নিকেরা সর্বপ্রকার জ্ঞাত বস্তুকে ঐগুলির মূল উপাদানে পরিনত করিবার চেষ্টা করিতেছেন, আর যদি সম্ভব হয়, তবে যে এক ধাতু হইতে ঐগুলি সব উৎপন্ন হইয়াছে, তাহাও বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এমন সময় আসিতে পারে, যখন তাঁহারা সকল ধাতুর মূল এক মৌলিক পদার্থ আবিষ্কার করিবেন। যদি ঐ অবস্হায় তাঁহারা কখন উপস্হিত হন, তখন তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারিবেন না ; তখন রসায়নবিদ্যা সম্পূর্ন হইবে।
০২. সাংখ্যীয় ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব
দুইটি শব্দ রহিয়াছে-ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড ও বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড ; অন্তঃ ও বহিঃ। আমরা অনুভূতি দ্বারা এই উভয় হইতেই সত্য লাভ করিয়া থাকি- আভ্যান্তর অনুভূতি ও বাহ্য অনুভূতি। আভ্যান্তর অনুভূতি দ্বারা সংগৃহীত সত্যসমূহ-মনোবিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্ম নামে পরিচিত ; আর বাহ্য অনুভূতি হইতে জড়বিজ্ঞানের উৎপত্তি। এখন কথা এই, যাহা পূর্ন সত্য, তাহার সহিত এই উভয় জগতের অনুভূতিরই সামঞ্জস্য থাকিবে। ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের সত্যসমূহে সাক্ষ্য প্রদান করিবে, সেইরূপ বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডও ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডের সত্যে সাক্ষ্য দিবে। বর্হিজগতের সত্যের অবিকল প্রতিকৃতি অন্তর্জগতে থাকা চাই, আবার অন্তর্জগতের সত্যের প্রমানও বর্হিজগতে পাওয়া চাই। তথাপি আমরা কার্যতঃ দেখিতে পাই, এই-সকল সত্যের অধিকাংশই সর্বদা পরস্পর বিরোধী। পৃথিবীর ইতিহাসের একযুগে দেখা যায়, ‘অন্তর্বাদী’র প্রধান্য হইল’; অমনি তাঁহারা ‘বহির্বাদী’র সহিত বিবাদ আরাম্ভ করিলেন। বর্তমান কালে ‘বহির্বাদী’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকেরা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, আর তাঁহারা মনস্তত্ত্ববিৎ ও দার্শনিকগনের অনেক সিদ্ধান্ত উড়াইয়া দিয়াছেন। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি যতটুকু বুঝিয়াছি, তাহাতে দেখতে পাই, মনোবিজ্ঞানের প্রকৃত সারভাগের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে।
প্রকৃতি প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সকল বিষয়ে বড় হইবার শক্তি দেন নাই; এজন্য একই জাতি সর্বপ্রকার বিদ্যার অনুসন্ধানে সমান শক্তি সম্পন্ন হইয়া উঠে নাই। আধুনিক ইউরোপীয় জাতিগুলি জড়বিজ্ঞানের অনুসন্ধানে সুদক্ষ, কিন্তু প্রাচীন ইউরোপীয়গন মানুষের অন্তর্জগতের অনুসন্ধানে তত পটু ছিলেন না। অপর দিকে আবার প্রাচ্যেরা বাহ্য জগতের তত্ত্বানুসন্ধানে তত দক্ষ ছিলেন না, কিন্তু অন্তর্জগতের গবেষনায় তাঁহারা খুব দক্ষ দেখাইয়াছেন। এজন্যই আমরা দেখিতে পাই, জড়জগৎ-সম্বন্ধীয় কতগুলি প্রাচ্য মতবাদের সহিত পাশ্চাত্য পদার্থ বিজ্ঞানের মিলে না, আবার পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান প্রাচ্যজাতির ঐ-বিষয়ক উপদেশের সহিত মিলে না। পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিকগণ প্রাচ্য জড়বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করিয়াছেন। তাহা হইলেও উভয়ই সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, আর আমরা যেমন পূর্বেই বলিয়াছি, যে-কোন বিদ্যাতেই হউক না, প্রকৃত সত্যের মধ্যে কখন পরস্পর বিরোধ থাকিতে পারে না, আভ্যন্তর সত্যসমূহের সহিত বাহ্য সত্যের সমন্বয় আছে।
ব্রহ্মাণ্ড সম্বন্ধে আধুনিক জ্যোতির্বিদ ও বৈজ্ঞানিকদের মতবাদ কি, তাহা আমরা জানি; আর ইহাও জানি যে, উহা প্রাচীন ধর্মতত্ত্ববাদিগণের কিরুপ ভয়ানক ক্ষতি করিয়াছে; যেমন যেমন এক একটি নতূন নতূন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হইতেছে, অমনি যেন তাঁহাদের গৃহে একটি করিয়া বোমা পড়িতেছে, আর সেইজন্যই তাঁহারা সকল যুগেই এই-সকল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রথমতঃ আমরা ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব ও তদানুষঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে প্রাচ্যজাতির মনস্তত্ত্ব ও বিজ্ঞানদৃষ্টিতে কি ধারণা ছিল, তাহা আলোচনা করিব; তাহা হইলে আপনারা দেখিবেন যে, কিরূপ আশ্চর্যভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের সমুদয় আধুনিকতম আবিষ্ক্রিয়ার সহিত উহাদের সামঞ্জস্য রহিয়াছে; আর যদি কোথাও কিছু অপূর্ণতা থাকে, তাহা আধুনিক বিজ্ঞানের দিকেই। ইংরেজীতে আমারা সকলে Nature (নেচার) শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকি। প্রাচীন হিন্দুদার্শনিকগণ উহাকে দুইটি বিভিন্ন নামে অভিহিত করিতেন; প্রথমটি ‘প্রকৃতি’-ইংরাজী Nature শব্দের সহিত উহা প্রায় সমার্থক; আর দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত বৈজ্ঞানিক নাম-‘অব্যক্ত’, যাহা ব্যক্ত বা প্রকাশিত বা ভেদাত্মক নয়, উহা হইতেই সকল পদার্থ উৎপন্ন হইয়াছে, উহা হইতে অণু-পরমাণু সমুদয় আসিয়াছে, উহা হইতেই জড়বস্তু ও শক্তি, মন ও বুদ্ধি-সব আসিয়াছে। ইহা অতি বিস্ময়কর যে, ভারতীয় দার্শনিকগণ অনেক পূর্বেই বলিয়া গিয়াছেন, মন সুক্ষ্ম জড়মাত্র। ‘দেহ যেমন প্রকৃতি হইতে প্রসূত, মনও সেরূপ’- ইহা ব্যতীত আমাদের আধুনিক জড়বাদীরা-আর অধিক কি দেখাইবার চেষ্টা করিতেছেন? চিন্তা সম্বন্ধেও তাই; ক্রমশঃ আমরা দেখিব, বুদ্ধিও সেই একই অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে প্রসূত।
প্রচীন আচার্যগণ এই অব্যক্তের লক্ষণ নির্দেশ করিয়াছেনঃ তিনটি শক্তির সাম্যাবস্থা। তন্মধ্যে একটির নাম সত্ত্ব, দ্বিতীয়টি রজঃ এবং তৃতীয়টি তমঃ। তমঃ-সর্বনিম্নতম শক্তি, আকর্ষণস্বরূপ; রজঃ তদপেক্ষা কিঞ্চিত উচ্চতর-উহা বিকর্ষণস্বরূপ; আর সর্বোচ্চ শক্তি এই উভয়ের সংযমস্বরূপ-উহাই সত্ত্ব।
অতএব যখনই এই আকর্ষণ ও বিকর্ষন শক্তিদ্বয় সত্ত্বের দ্বারা সম্পূর্ণ সংযত হয় বা সম্পূর্ণ সাম্যাবস্হায় থাকে, তখন আর সৃষ্টি বা বিকার থাকে না ; কিন্তু যখনই এই সাম্যাবস্হা নষ্ট হয়, তখনই উহাদের সামঞ্জস্য নষ্ট হয়, এবং উহাদের মধ্যে একটি শক্তি অপরগুলি অপেক্ষা প্রবলতর হইয়া উঠে; তখনই পরিবর্তন ও গতি আরম্ভ হয় এবং এই সমুদয়ের পরিনাম চলিতে থাকে। এইরূপ ব্যাপার চক্রের গতিতে চলিতেছে। অর্থাৎ এক সময় আসে, যখন সাম্যাবস্হা ভঙ্গ হয়, তখন এই বিভিন্ন শক্তিসমূদয় বিভিন্নরূপে সম্মিলিত হইতে থাকে, এবং তখনই এই ব্রহ্মাণ্ড বাহির হয়। আবার এক সময় আসে, যখন সকল বস্তুই সেই আদিম সাম্যাবস্হায় প্রত্যাবৃত্ত হইতে চায়, আবার এমন সময় আসে, যখন সকল অভিব্যাক্তির সম্পূর্ণ অভাব ঘটে। আবার কিছুকাল পরে এই অবস্হা নষ্ট হইয়া যায় এবং শক্তিগুলি বহির্দিকে প্রসৃত হইবার উপক্রম করে, আর ব্রহ্মাণ্ড ধীরে ধীরে তরঙ্গাকারে বহির্গত হইতে থাকে। জগতের সকল গতিই তরঙ্গাকারে হয়-একবার উত্থান, আবার পতন।
প্রাচীন দার্শনিকগণের মধ্যে কাহারও কাহারও মত এই যে, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই কিছুদিনের জন্য একেবারে লয়প্রাপ্ত হয় ; আবার অপর কাহারও মত এই যে, ব্রহ্মাণ্ডের অংশবিশেষেই এই প্রলয় ব্যাপার সংঘটিত হয়। অর্থৎ মনে করূন, আমাদের এই সৌরজগৎ লয়প্রাপ্ত হইয়া অব্যাক্ত অবস্হায় ফিরিয়া গেল, কিন্তু সেই সময়েই অন্যান্য সহস্র সহস্র জগতে তাহার ঠিক বিপরীত কাণ্ড চলিতেছে। আমি দ্বিতীয় মতটির অর্থাৎ প্রলয় যুগপথ সমগ্র জগতে সংঘটিত হয় না, বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ব্যাপার চলিতে থাকে-এই মতটিরই অধিকপক্ষপাতী। যাহাই হউক, মূল কথাটা উভয়ত্রই এক, অর্থাৎ যাহা কিছু আমরা দেখেতেছি, এই সমগ্র প্রকৃতিই ক্রমান্বয়ে উত্থান-পতনের নিয়মে অগ্রসর হইতেছে। এই সম্পূর্ণ সাম্যাবস্হায় গমনকে ‘কল্পান্ত’ বলে। সমগ্র কল্পটিকে এই ক্রমবিকাশ ও ক্রমসংকোচকে-ভারতের ঈশ্বরবাদিগন ঈশ্বরেরে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সহিত তুলনা করিয়াছেন। ঈশ্বর নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলে তাহা হইতে যেন জগৎ বাহির হয়, আবার উহা তাহাতে প্রত্যাবর্তন করে। যখন প্রলয় হয়, তখন জগতের কি অবস্হা হয়? তখনও উহা বর্তমান থাকে, তবে সূক্ষতররূপে বা কারণাবস্হায় থাকে। দেশ-কাল-নিমিত্ত সেখানেও বর্তমান, তবে উহারা অব্যাক্ত ভাব প্রাপ্ত হইয়াছে মাত্র। এই অব্যাক্তাবস্হায় প্রত্যাবর্তনকে ক্রমসঙ্কোচ বা প্রলয়’ বলে। প্রলয় ও সৃষ্টি বা ক্রমসংকোচ ও ক্রমাভিব্যাক্তি অনন্তকাল ধরিয়া চলিয়াছে, অতএব আমরা যখন আদি বা আরম্ভের কথা বলি, তখনআমরা এক কল্পের আরম্ভকেই লক্ষ্য করিয়া থাকি।
ব্রহ্মাণ্ডের সম্পূর্ণ বহির্ভাগকে-আজকাল আমরা যাহাকে স্থূল জড় বলি, প্রাচীন হিন্দু মনস্তত্ত্ববিদগণ(পঞ্চ)’ভূত’ বলিতেন। তাঁহাদের মতে ঐগুলিরই একটি অবশিষ্টগুলির কারণ, যেহেতু অন্যান্য সকল ভূত এই এক ভূত হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে। এই ভূত ‘আকাশ’ নামে অভিহিত। আজকাল ‘ইথার’ বলিতে যাহা বুঝায়, ইহা কতকটা তাহারই মতো, যদিও সম্পূর্ণ এক নয়। আকাশই আদিভূত- উহা হইতেই সমুদয় স্থূল বস্তু উৎপন্ন হইয়াছে আর উহার সঙ্গে ‘প্রাণ’ নামে আর একটি বস্তু থাকে-ক্রমশ আমরা দেখিব, উহা কি। যতদিন সৃষ্টি থাকে, ততদিন এই প্রাণ ও আকাশ থাকে। তাহারা নানা রূপে মিলিত হইয়া এই-সমুদয় স্থূল প্রপঞ্চ গঠন করিয়াছে, অবশেষে কল্পান্তে ঐগুলি লয়প্রাপ্ত হইয়া আকাশ ও প্রাণের অব্যক্তরূপে প্রত্যাবর্তন করে। জগতের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে সৃষ্টিবর্ণনাত্মক একটি সূক্ত ১ আছে, সেটি অতিশয় কবিত্বপূর্ণঃ ‘যখন সৎ ও ছিল না, অসৎ ও ছিল না, অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিল, তখন কি ছিল?’
আর ইহার উত্তর দেওয়া হইয়াছেঃ ‘ইনি-সেই অনাদি অনন্ত পুরুষ-গতিশূন্য বা নিশ্চেষ্টভাবে ছিলেন।’
প্রাণ ও আকাশ তখন সেই অনন্ত পুরূষে সুপ্তভাবে ছিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যক্ত প্রপঞ্চ ছিল না । এই অবস্থাকে ‘অবক্ত্য’ বলে-উহার ঠিক শব্দার্থ স্পন্দন-রহিত বা অপ্রকাশিত। একটি নূতন কল্পের আদিতে এই অব্যক্ত স্পন্দিত হইতে থাকে, আর প্রাণ আকাশের উপর ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত করে, আকাশ ঘনীভূত হইতে থাকে, আর ক্রমে আকর্ষণ-বিকর্ষণ-শক্তিদ্বয়ের বলে পরমাণু গঠিত হয়। এইগুলি পরে আরও ঘনীভূত হইয়া দ্ব্যণুকাদিতে পরিণত হয় এবং সর্বশেষে প্রাকৃতিক প্রত্যেক পদার্থ যে যে উপাদানে নির্মিত, সেই-সকল বিভিন্ন স্থূল ভূতে পরিণত হয়।
আমরা সাধারণতঃ দেখিতে পাই, লোকে এইগুলির অতি অদ্ভুত ইংরেজী অনুবাদ করিয়া থাকে। অনুবাদকগণ অনুবাদের জন্য প্রাচীন দার্শনিকগণের ও তাঁহাদের টীকাকারগণের সহায়তা গ্রহণ করেন না, আর নিজেদেরও এত বেশী বিদ্য নাই যে, নিজে-নিজেই ঐগুলি বুঝিতে পারেন। তাঁহারা ‘পঞ্চভূতে’র অনুবাদ করিযা থাকেন বায়ু, অগ্নি ইত্যাদি। যদি তাঁহারা ভাষ্যকারগণের ভাষ্য আলোচনা করিতেন, তবে দেখিতে পাইতেন যে, ভাষ্যকারগণ ঐগুলি লক্ষ্য করেন নাই। প্রাণের বারংবার আঘাতে আকাশ হইতে বায়ু বা আকাশের স্পন্দনশীল অবস্থা উপস্থিত হয়, উহা হইতেই বায়বীয় বা বাষ্পীয় পদার্থের উৎপত্তি হয়। স্পন্দন ক্রমশঃ দ্রূত হইতে দ্রূততর হইতে থাকিলে উত্তাপ বা তেজের উৎপত্তি হয়। উত্তাপ ক্রমশঃ কমিয়া শীতল হইতে থাকে, তখন ঐ বাষ্পীয় পদার্থ তরল ভাব ধারন করে, উহাকে ‘অপ্’ বলে ; অবশেষে উহা কঠিনাকার প্রাপ্ত হয়, তাহার নাম ‘ক্ষিতি’ বা পৃথিবী। সর্ব প্রথমে আকাশে স্পন্দনশীল অবস্থা, তারপর উত্তাপ, তারপর উহা তরল হইয়া যাইবে, আর যখন আরও ঘনীভূত হইবে, তখন উহা কঠিন জড়পদার্থের আকার ধারন করিবে। ঠিক ইহার বিপরীতক্রমে সব কিছু অব্যাক্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়। কঠিন বস্তুসকল তরল পদার্থে পরিনত হইবে, তরল পদার্থ কেবল উত্তাপ বা তেজোরাশিতে পরিণত হইবে, তাহা আবার ধীরে ধীরে বাষ্পীয় ভাব ধারন করিবে, পরে পরমাণুসমূহ বিশ্লিষ্ট হইতে আরম্ভ হয় এবং সর্বশেষে সমূদয় শক্তির সামঞ্জস্য-অবস্হা উপস্হিত হয়। তখন স্পন্দন বন্ধ হয়- এইরূপে কল্পান্ত হয়। আমরা আধুনিক জ্যোতিষ হইতে জানিতে পারি যে, আমাদের এই পৃথিবী ও সূর্যের সেই অবস্হা-পরিবর্তন চলিয়াছে, শেষে এই কঠিনাকার পৃথিবী গলিয়া গিয়া তরলাকার এবং অবশেষে বাষ্পাকার ধারন করিবে।
আকাশের সাহায্য ব্যতীত প্রাণ একা কোন কার্য করিতে পারে না। প্রান সম্বন্ধে আমরা এইটুকু জানি যে, উহা গতি বা স্পন্দন। আমরা যা কিছু গতি দেখিতে পাই, তাহা এই প্রাণের বিকার, এবং জড় বা ভূত-পদার্থ যা কিছু আমরা জানি, যা কিছু আকৃতিযুক্ত বা বাধাদান করে, তাহাই এই আকাশের বিকার। এই প্রাণ এককভাবে থাকিতে পারে না বা কোন মাধ্যম ব্যাতীত কার্য করিতে পারে না, আর উহার কোন অবস্হায়-উহা কেবল প্রাণরূপেই বর্তমান থাকুক অথবা মহাকর্ষ বা কেন্দ্রাতিগা শক্তিরূপ প্রাকৃতিক অন্যান্য শক্তিতেই পরিণত হউক-উহা কখন আকাশ হইতে পৃথক থাকিতে পারে না। আপনারা কখন জড় ব্যাতীত শক্তি বা শক্তি ব্যাতীত জড় দেখেন নাই। আমরা যাহাদিগকে জড় ও শক্তি বলি, সেগুলি কেবল এই দুইটির স্থুল প্রকাশমাত্র, এবং ইহাদের অতি সূক্ষ অবস্থাকেই প্রচীন দার্শনিকগণ ‘প্রান’ ও ‘আকাশ’ নামে অভিহিত করিয়াছে। প্রাণকে আপনারা জীবন শক্তি বলিতে পারেন, কিন্তু উহাকে শুধু মানুষের জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করিলে অথবা আত্মার সহিত অভিন্ন ভাবে বুঝিলেও চলিবে না। অতএব সৃষ্টি প্রাণ ও আকাশের সংযোগে উৎপন্ন, এবং উহার আদিও নাই, অন্তও নাই ; উহার আদি-অন্ত কিছুই থাকিতে পারে না, কারন অনন্ত কাল ধরিয়া সৃষ্টি চলিয়াছে।
তারপর আর একটি অতি দুরহ ও জটিল প্রশ্ন আসিতেছে। কয়েকজন ইউরোপীয় দার্শনিক বলিয়াছেন, ‘আমি’ আছি বলিয়াই এই জগৎ আছে, এবং ‘আমি’ যদি না থাকি তবে এই জগৎও থাকিবে না। কখন কখন ঐ কথা এইভাবে প্রকাশ করা হইয়া থাকে-যদি জগতের সকল লোক মরিয়া যায়, মনুষ্যজাতি আর না থাকে, অনুভূতি ও বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন কোন প্রাণী যদি না থাকে, তবে এই জগৎপ্রপঞ্চও আর থাকিবে না। এ কথা অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতে পারে, কিন্তু ক্রমে আমরা স্পষ্ট দেখিব যে, ইহা প্রমান করা যাইতে পারে। কিন্তু ঐ ইউরোপীয় দার্শনিকগণ এই তত্ত্ব জানিলেও মনোবিজ্ঞানঅনুসারে ইহা বাখ্যা করিতে পারেন না। তাঁহারা এই তত্ত্বের আভাসমাত্র পাইয়াছেন।
প্রথমতঃ আমরা এই প্রাচীন মনস্তত্ত্ববিদগণের আর একটি সিন্ধান্ত লইয়া আলোচনা করিব-উহাও একটু অদ্ভুত রকমের-তাহা এই যে, স্থূল ভূতগুলি সুক্ষ্ম ভূত হইতে উৎপন্ন। যাহা কিছু স্থূল, তাহাই কতকগুলি সুক্ষ্ম বস্তুর সমবায়। অতএব স্থূল ভূতগুলিও কতকগুলি সুক্ষ্মবস্তুগঠিত-ঐগুলিকে সংস্কৃত ভাষায় ‘তন্মাত্রা’ বলে। আমি একটি পুষ্প আঘ্রাণ করিতেছি; উহার গন্ধ পাইতে গেলে কিছু অবশ্য আমার নাসিকার সংস্পর্শে আসিতেছে। ঐ পুষ্প রহিয়াছে-উহা যে আমার দিকে আসিতেছে, এমন তো দেখিতেছি না; কিন্তু কিছু যদি আমার নাসিকার সংস্পর্শে না আসিয়া থাকে, তবে আমি গন্ধ পাইতেছি কিরূপে?
ঐ পুষ্প হইতে যাহা আসিয়া আমার নাসিকার সংস্পর্শে আসিতেছে, তাহাই তন্মাত্রা, ঐ পুষ্পেরই অতি সূক্ষ্ম পরমাণু; উহা এত সূক্ষ্ম যে, যদি আমরা সারাদিন সকলে মিলিয়া উহার গন্ধ আঘ্রাণ করি, তথাপি ঐ পুষ্পের পরিমাণের কিছুমাত্র হ্রাস হইবে না। তাপ, আলোক এবং অন্যান্য সকল বস্তু সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। এই তন্মাত্রাগুলি আবার পরমাণুরূপে পুনর্বিভক্ত হইতে পারে। এই পরমাণুর পরিমাণ লইয়া বিভিন্ন দার্শনিকগণের বিভিন্ন মত আছে; কিন্তু আমরা জানি-ঐগুলি মতবাদ-মাত্র, সুতরাং বিচারস্থলে আমরা ঐগুলিকে পরিত্যাগ করিলাম। এইটুকু জানিলেই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট-যাহা কিছু স্থূল তাহা অতি সূক্ষ্ম পদার্থদ্বারা নির্মিত। প্রথম আমরা পাইতেছি স্থূল ভূত-আমরা উহা বাহিরে অনুভব করিতেছি; তার পর সূক্ষ্ম ভূত-এই সূক্ষ্ম ভূতের দ্বারাই স্থূল ভূত গঠিত, উহারই সহিত আমাদের ইন্দ্রিয়গণের অর্থাৎ নাসিকা, চক্ষু ও কর্ণাদির স্নায়ুর সংযোগ হইতেছে। যে ইথার-তরঙ্গ আমার চক্ষুকে স্পর্শ করিতেছে, তাহা আমি দেখিতে পাইতেছি না, তথাপি জানি-আলোক দেখিতে পাইবার পূর্বে চাক্ষুষ স্নায়ুর সহিত উহার সংযোগ প্রয়োজন। শ্রবণ-সম্বন্ধেও তদ্রূপ। আমাদের কর্ণের সংস্পর্শে যে তন্মাত্রাগুলি আসিতেছে, তাহা আমরা দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু আমরা জানি-সেগুলি অবশ্যই আছে। এই তন্মাত্রাগুলির আবার কারণ কি? আমাদের মনস্তত্ত্ববিদগণ ইহার এক অতি অদ্ভূত ও বিস্ময়জনক উত্তর দিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, তন্মাত্রাগুলির কারণ ‘অহংকার’-অহং-তত্ত্ব বা ‘অহং-জ্ঞান’। ইহাই এই সূক্ষ্ম ভূতগুলির এবং ইন্দ্রিয়গুলিরও কারণ। ইন্দ্রিয় কোনগুলি? এই চক্ষু রহিয়াছে, কিন্তু চক্ষু দেখে না। চক্ষু যদি দেখিতে, তবে মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তো চক্ষু অবিকৃত থাকে, তবে তখনও তাহারা দেখিতে পাইত। কোনখানে কিছুর পরিবর্তন হইয়াছে। কোন-কিছু মানুষের ভিতর হইতে চলিয়া গিয়াছে, আর সেই কিছু, যাহা প্রকৃতপক্ষে দেখে, চক্ষু যাহার যন্ত্রস্বরূপ মাত্র, তাহাই যথার্থ ইন্দ্রিয়। এইরূপ এই নাসিকাও একটি যন্ত্রমাত্র, উহার সহিত সম্বন্ধযুক্ত একটি ইন্দ্রিয় আছে। আধুনিক শারীর-বিজ্ঞান আপনাদিগকে বলিয়া দিবে, উহা কি। উহা মস্তিষ্কস্থ একটি স্নায়ুকেন্দ্র মাত্র। চক্ষুকর্ণাদি কেবল বাহ্যযন্ত্র। অতএব এই স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয়গণই অনুভূতির যথার্থ স্থান।
নাসিকার জন্য একটি, চক্ষুর জন্য একটি, এইরূপ প্রত্যকের জন্য এক-একটি পৃথক স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয় থাকিবার প্রয়োজন কি? একটিতেই কার্য সিদ্ধ হয় না কেন? এইটি স্পষ্ট করিয়া বুঝানো যাইতেছে। আমি কথা কহিতেছি, আপনারা শুনিতেছেন ; আপনাদের চতুর্দিকে কি হইতেছে, তাহা আপনারা দেখিতে পাইতেছেন না, কারন মন কেবল শ্রবনেন্দ্রিয়েই সংযুক্ত রহিয়াছে, চক্ষুরিন্দ্রিয় হইতে নিজেকে পৃথক করিয়াছে। যদি একটি মাত্র স্নায়ুকেন্দ্র বা ইন্দ্রিয় থাকিত, তবে মনকে একই সময়ে দেখিতে, শুনিতে ও আঘ্রান করিতে হইত। অতএব প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথক স্নায়ুকেন্দ্রের প্রয়োজন। আধুনিক শরীর-বিজ্ঞানও এ বিষয়ে সাক্ষ দিয়া থাকে। অবশ্য আমাদের পক্ষে একই সময়ে দেখা ও শুনা সম্ভব, কিন্তু তাহার কারন-মন উভয় কেন্দ্রেই আংশিকভাবে যুক্ত হয়। তবে যন্ত্র কোনগুলি? আমরা দেখিতেছি, উহারা বাহিরের বস্তু এবং স্হুলভূতে নির্মিত-এই আমাদের চক্ষু কর্ন নাসা প্রভৃতি। আর এই স্নায়ুকেন্দ্রগুলি কিসে নির্মিত? উহারা সুক্ষতর ভূতে নির্মিত ; যেহেতু উহারা অনুভূতির কেন্দ্রস্বরূপ, সে জন্য উহারা ভিতরের জিনিস। যেমন প্রাণকে বিভিন্ন স্হুল শক্তিতে পরিনত করিবার জন্য এই দেহ স্হুলভূতে গঠিত হইয়াছে, তেমনি এই শরীরের পশ্চাতে যে স্নায়ুকেন্দ্রসমূহ রহিয়াছে, তাহারাও প্রাণকে সুক্ষ অনুভূতির শক্তিতে পরিনত করিবার জন্য সূক্ষতর উপাদানে নির্মিত। এই সমুদয় ইন্দ্রিয় এবং অন্তঃকরনের সমষ্টিকে একত্রে লিঙ্গ(বা সূক্ষ) শরীর বলে।
এই সূক্ষ শরীরের প্রকৃতপক্ষে একটি আকার আছে, কারন যাহা কিছু জড় তাহারই একটি আকার অবশ্যই থাকিবে। ইন্দ্রিয়গনের পশ্চাতে মন অর্থাৎ বৃত্তিযুক্ত চিত্ত আছে, উহাকে চিত্তের স্পন্দনশীল বা অস্থির অবস্থা বলা যাইতে পারে। যদি স্থির হ্রদে একটি প্রস্তর নিক্ষেপ করা যায়, তাহা হইলে প্রথমে উহাতে স্পন্দন বা কম্পন উপস্থিত হইবে, তারপর উহা হইতে বাধা বা প্রতিক্রিয়া উত্থিত হইবে। মুহূর্তের জন্য ঐ জল স্পন্দিত হইবে, তারপর উহা ঐ প্রস্তরের উপর প্রতিক্রিয়া করিবে। এইরূপ চিত্তের উপর যখনই কোন বাহ্যবিষয়ে আঘাত আসে, তখন উহা একটু স্পন্দিত হয়। চিত্তের এই অবস্থাকে মন বলে। তারপর উহা হইতর প্রতিক্রিয়া হয়, উহার নাম ‘বুদ্ধি’। এই বুদ্ধির পশ্চাতে আর একটি জিনিস আছে, উহা মনের সকল ক্রিয়ার সহিতই বর্তমান, উহাকে ‘অহঙ্কার’ বলে; এই অহঙ্কার অর্থে অহংজ্ঞান, যাহাতে সর্বদা ‘আমি আছি’ এই জ্ঞান হয়। তাহার পশ্চাতে মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, উহা প্রাকৃতিক সকল বস্তুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইহার পশ্চাতে পুরুষ, ইনিই মানবের যথার্থ স্বরূপ—শুদ্ধ, পূর্ণ; ইনিই একমাত্র দ্রষ্টা এবং ইহার জন্যই এই সমুদয় পরিণাম। পুরুষ এই সকল পরিণাম-পরম্পরা দেখিতেছেন। তিনি স্বয়ং কখনই অশুদ্ধ নন, কিন্তু অধ্যাস বা প্রতিবিম্বের দ্বারা তাঁহাকে ঐরূপ দেখাইতেছে, যেমন একখণ্ড স্ফটিকের সমক্ষে একটি লাল ফুল রাখিলে স্ফটিকটি লাল দেখাইবে, আবার নীল ফুল রাখিলে নীল দেখাইবে। প্রকতপক্ষে স্ফটিকটির কোন বর্ণই নাই। পুরুষ বা আত্মা অনেক, প্রত্যেকেই শুদ্ধ ও পূর্ণ। আর এই স্থূল, সূক্ষ্ম নানাপ্রকারে বিভক্ত পঞ্চভূত তাঁহাদের উপর প্রতিবিম্বিত হওয়ায় তাঁহাদিগকে নানাবর্ণে রঞ্জিত দেখাইতেছে। প্রকৃতি কেন এ-সকল করিতেছেন? প্রকৃতির এই-সকল পরিণাম পুরুষ নিজের মুক্ত স্বভাব জানিতে পারেন। মানুষের সমক্ষে এই জগৎপ্রপঞ্চরূপ সুবৃহৎ গ্রন্থ বিস্তৃত রহিয়াছে, যাহাতে মানুষ ঐ গ্রন্থ পাঠ করিয়া পরিণামে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ পুরুষরূপে জগতের বাহিরে আসিতে পারেন। আমাকে এখানে আবশ্যই বলিতে হইবে যে, আপনারা যে অর্থে সগুণ বা ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, আমাদের অনেক বড় বড় মনস্তত্ত্ববিদ্ সেই অর্থে তাঁহাতে বিশ্বাস করেন না। মনস্তত্ত্ববিদগনের পিতাস্বরূপ কপিল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁহার ধারণা এই যে, সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করিবার কোন প্রয়োজন নাই; যাহা কিছু ভাল, প্রকৃতিই তাহা করিতে সমর্থ। তিনি তথা-কথিত ‘কৌশলবাদ’(Design Theory) খণ্ডন করিয়াছেন। এই মতবাদের ন্যায় ছেলে মানুষী মত জগতে আর কিছুই প্রচারিত হয় নাই। তবে তিনি এক বিশেষ প্রকার ঈশ্বর স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা সকলে মুক্ত হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছি, এরূপ চেষ্টা করিতে করিতে যখন মানবাত্মা মুক্ত হন, তখন তিনি যেন কিছুদিনের জন্য প্রকৃতিতে লীন হইয়া থাকিতে পারেন। আগামী কল্পের প্রারম্ভে তিনিই একজন সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান্ পুরুষরূপে আবির্ভূত হইয়া সেই কল্পের শাসনকর্তা হইতে পারেন। এই অর্থে তাঁহাকে ‘ঈশ্বর’ বলা যাইতে পারে। এইরূপে আপনি, আমি এবং অতি সামান্য ব্যক্তি পর্যন্ত বিভিন্ন কল্পে ঈশ্বর হইতে পারিব। কপিল বলেন, এইরূপ ‘জন্য ঈশ্বর’ হইতে পারা যায়, কিন্তু ‘নিত্য ঈশ্বর’ অর্থাৎ নিত্য সর্বশক্তিমান্-জগতের শাসনকর্তা কখনই হইতে পারা যায় না। এইরূপ ঈশ্বর-স্বীকারে এই আপত্তি উঠিবে : ঈশ্বর হয় বদ্ধ, না হয় মুক্ত—এই দুই-এর একতর ভাব স্বীকার করিতে হইবে ঈশ্বর যদি মুক্ত হন, তবে তিনি সৃষ্টি করিবেন না, কারণ তাঁহার সৃষ্টি করিবার কোন প্রয়োজন নাই। আর যদি তিনি বদ্ধ হন, তাহা হইলে তাহাতে সৃষ্টিকর্তৃত্ব অসম্ভব; কারণ বদ্ধ বলিয়া তাঁহার শক্তির অভাব, সুতরাং তাঁহার সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা থাকিবে না। সুতরাং উভয় পক্ষেই দেখা গেল, নিত্য সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ ঈশ্বর থাকিতে পারেন না। এই হেতু কপিল বলেন, আমাদের শাস্ত্রে-বেদে যেখানেই ঈশ্বর-শব্দের প্রয়োগ আছে, তাহাতে যে সকল আত্মা পূর্ণতা বা মুক্তি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে বুঝাইতেছে। সাংখ্যদর্শন সকল আত্মার একত্বে বিশ্বাসী নন। বেদান্তের মতে সকল জীবাত্মা ও ব্রহ্ম-নামধেয় এক বিশ্বাত্মা অভিন্ন, কিন্তু সাংখ্যদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কপিল দ্বৈতবাদী ছিলেন। তিনি অবশ্য জগতের বিশ্লেষণ যতদূর করিয়াছেন, তাহা অতি অদ্ভুত। তিনি হিন্দু পরিণামবাদীগণের জনক স্বরূপ, পরবর্তী দর্শন-শাস্ত্রগুলি তাঁহারই চিন্তাপ্রণালীর পরিণাম মাত্র।
সাংখ্যদর্শন-মতে সকল আত্মাই তাহাদের স্বাধীনতা বা মুক্তি এবং সর্বশক্তিমত্তা ও সর্বজ্ঞতা-রূপ স্বাভাবিক অধিকারে পুনঃপ্রাপ্ত হইবে। এখানে প্রশ্ন হইতে পারে, আত্মার এই বন্ধন কোথা হইতে আসিল? সাংখ্য বলেন ইহা অনাদি। কিন্তু তাহাতে এই আপত্তি উপস্থিত হয় যে, যদি এই বন্ধন অনাদি হয়, তবে উহা অনন্তও হইবে, আর তাহা হইলে আমরা কখনই মুক্তিলাভ করিতে পারিব না। কপিল ইহার উত্তরে বলেন, এখানে এই ‘অনাদি’ বলিতে নিত্য অনাদি বুঝিতে হইবে না। প্রকৃতি অনাদি ও অনন্ত, কিন্তু আত্মা বা পুরুষ যে অর্থে আনাদি অনন্ত, সে অর্থে নয়; কারণ প্রকৃতিতে ব্যক্তিত্ব নাই। যেমন আমাদের সম্মুখ দিয়া একটি নদী প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, প্রতি মুহূর্তেই উহাতে নূতন নূতন জলরাশি আসিতেছে, এই সমুদয় জলরাশির নাম নদী, কিন্তু নদী কোন ধ্রুব বস্তু নয়। এইরূপ প্রকৃতির অন্তর্গত যাহা কিছু, সর্বদা তাহার পরিবর্তন হইতেছে, কিন্তু আত্মার কখনই পরিবর্তন হয় না। অতএব প্রকৃতি যখন সর্বদাই পরিণাম প্রাপ্ত হইতেছে, তখন আত্মার পক্ষে প্রকৃতির বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
সাংখ্যদিগের একটি মত তাহাদের নিজস্ব, যথাঃ একটি মনুষ্য বা কোন প্রাণী যে নিয়মে গঠিত, সমগ্র জগদব্রহ্মাণ্ডও ঠিক সেই নিয়মে বিরচিত। সুতরাং আমার যেমন একটি মন আছে, সেইরূপ একটি বিশ্ব-মনও আছে। যখন এই বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের ক্রমবিকাশ হয়, তখন প্রথমে মহৎ বা বুদ্ধিতত্ত্ব, পরে অহঙ্কার, পরে তন্মাত্রা, ইন্দ্রিয় ও শেষে স্থূলভূতের উৎপত্তি হয়। কপিলের মতে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই একটি শরীর। যাহা কিছু দেখিতেছি, সেগুলি সব স্থূল শরীর, উহাদের পশ্চাতে আছে সূক্ষ্ম শরীর এবং তাহাদের পশ্চাতে সমষ্টি অহংতত্ত্ব, তাহারও পশ্চাতে সমষ্টি-বুদ্ধি। কিন্তু এ-সকলই প্রকৃতির অন্তর্গত, প্রকৃতির বিকাশ, এগুলির কিছুই উহার বাহিরে নাই। আমাদের মধ্যে সকলেই এই মহত্বের অংশ। সমষ্টি বুদ্ধিতত্ত্ব রহিয়াছে, তাহা হইতে আমাদের যাহা প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিতেছি; এইরূপ জগতের ভিতরে সমষ্টি মনস্তত্ত্ব রহিয়াছে, তাহা হইতেও আমরা চিরকালই প্রয়োজনমত লইতেছি। কিন্তু দেহের বীজ পিতামাতার নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া চাই। ইহাতে বংশানুক্রমিকতা (Heredity) ও পুনর্জন্মবাদ উভয় তত্ত্বই স্বীকৃত হইয়া থাকে। আত্মাকে দেহনির্মাণ করিবার জন্য উপাদান দিতে হয়, কিন্তু সে উপাদান বংশানুক্রমিক সঞ্চারের দ্বারা পিতামাতা হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়।
আমরা এক্ষণে এই প্রস্তাব উপস্থিত করিতেছি যে, সাংখ্যমতানুযায়ী সৃষ্টিপ্রণালীতে সৃষ্টি বা ক্রমবিকাশ এবং প্রলয় বা ক্রমসঙ্কোচ—এই উভয়টিই স্বীকৃত হইয়াছে। সমুদয় সেই অব্যক্ত প্রকৃতির ক্রমবিকাশে উৎপন্ন, আবার ঐ সমুদয় ক্রমসঙ্কুচিত হইয়া অব্যক্তভাব ধারণ করে। সাংখ্যমতে এমন কোন জড় বা ভৌতিক বস্তু থাকিতে পারে না, মহতত্ত্বের অংশবিশেষ যাহার উপাদান নয়। উহাই সেই উপাদান, যাহা হইতে এই সমুদয় প্রপঞ্চ নির্মিত হইয়াছে। আগামী বক্তৃতায় ইহার বিশদ ব্যাখ্যা করা যাইবে। তবে আমি এইটুকু দেখাইব, কিরূপে ইহা প্রমাণ করা যাইতে পারে। এই টেবিলের স্বরূপ কি, তাহা আমি জানি না, উহা কেবল আমার উপর একপ্রকার সংস্কার জন্মাইতেছে মাত্র। উহা প্রথমে চক্ষুতে আসে, তারপর দর্শনেন্দ্রিয়ে গমন করে, তারপর উহা মনের নিকটে যায়। তখন মন আবার উহার উপর প্রতিক্রিয়া করে, সেই প্রতিক্রিয়াকেই আমরা ‘টেবিল’ আখ্যা দিয়া থাকি। ইহা ঠিক একটি হ্রদে একখণ্ড প্রস্তর নিক্ষেপের ন্যায়। ঐ হ্রদ প্রস্তরখণ্ডের অভিমুখে একটি তরঙ্গ নিক্ষেপ করে; আর ঐ তরঙ্গটিকেই আমরা জানিয়া থাকি। মনের তরঙ্গসমূহ-যেগুলি বহির্দিকে আসে, সেগুলিই আমরা জানি। এইরূপে এই দেয়ালের আকৃতি আমার মনে রহিয়াছে; বাহিরে যথার্থ কি আছে, তাহা কেহই জানে না; যখন আমি কোন বর্হিবস্তুকে জানিতে চেষ্টা করি, তখন উহাকে আমার প্রদত্ত উপাদানে পরিণত হইতে হয়। আমি আমার নিজমনের দ্বারা আমার চক্ষুকে প্রয়োজনীয় উপাদান দিয়াছি, আর বাহিরের যাহা আছে, তাহা উদ্দীপক বা উত্তেজক কারণ মাত্র। সেই উত্তেজক কারণ আসিলে আমি আমার মনকে উহার দিকে প্রক্ষেপ করি এবং উহা আমার দ্রষ্টব্য বস্তুর আকার ধারণ করিয়া থাকে। এক্ষণে প্রশ্ন এই-আমরা সকলকেই একই বস্তু কিরূপে দেখিয়া থাকি। ইহার কারণ—আমাদের সকলের ভিতর এই বিশ্ব-মনের এক এক অংশ আছে। যাহাদের মন আছে তাহারাই ঐ বস্তু দেখিবে; যাহাদের নাই তাহারা উহা দেখিবে না। ইহাতেই প্রমাণ হয়, যতদিন ধরিয়া জগৎ আছে, ততদিন মনের অভাব—সেই এক বিশ্ব-মনের অভাব কখন হয় নাই। প্রত্যেক মানুষ, প্রত্যেক প্রাণী সেই বিশ্ব-মন হইতেই নির্মিত হইতেছে, কারণ বিশ্বমন সর্বদাই বর্তমান থাকিয়া উহাদের নির্মাণের জন্য উপাদান যোগাইতেছে।