ধ্যানই অধ্যাত্মজীবনের সর্বাপেক্ষা অধিক সহায়ক। ধ্যানকালে আমরা সর্ববিধ জাগতিক বন্ধন হইতে মুক্ত হই, এবং নিজ ভাগবত স্বরূপ উপলব্ধি করি। ধ্যানের সময় আমরা কোন বাহ্য সহায়তার উপর নির্ভর করি না। আত্মার স্পর্শে মলিনতম স্থানগুলিও উজ্জ্বলতম বর্ণের আভায় উদ্ভাসিত হইতে পারে, জঘন্যতম বস্তুও সুরভিমণ্ডিত হইতে পারে, পিশাচও দেবতায় পরিণত হইতে পারে, তখন সব শত্রুভাব—সব স্বার্থ শূন্যে লীন হয়। দেহবোধ যত কম আসে ততই ভাল। কারণ দেহই আমাদের নীচে টানিয়া আনে। দেহের প্রতি আসক্তির জন্য, দেহাত্মবোধের জন্য আমাদের জীবন দুর্বিষহ হইয়া ওঠে। রহস্যটি এইঃ চিন্তা করিতে হয়—আমি দেহ নই, আমি আত্মা, ভাবিতে হয়—সমগ্র বিশ্ব এবং তৎসংশ্লিষ্ট যাহা কিছু সবই, তাহার ভালমন্দ সব-কিছুই হইতেছে পরপর সাজান কতকগুলি ছবির মত, পটে অঙ্কিত দৃশ্যাবলীর মত, আমি তাহার সাক্ষিস্বরূপ দ্রষ্টা।
১০. রাজযোগ-প্রসঙ্গে
যোগের প্রথম সোপান যম।
যম আয়ত্ত করিতে পাঁচটি বিষয়ের প্রয়োজনঃ
- ১. কায়মনোবাক্যে কাহাকেও হিংসা না করা।
- ২. কায়মনোবাক্যে সত্য কথা বলা।
- ৩. কায়মনোবাক্যে লোভ না করা।
- ৪. কায়মনোবাক্যে পরম পবিত্রতা রক্ষা করা।
- ৫. কায়মনোবাক্যে অপাপবিদ্ধতা।
পবিত্রতা শ্রেষ্ঠ শক্তি। ইহার সম্মুখে সব-কিছু নিস্তেজ। তারপর ‘আসন’ বা সাধকের বসিবার ভঙ্গী। আসন দৃঢ় হওয়া চাই, এবং শির পঞ্জর এবং দেহ ঋজু ও সরলরেখায় অবস্থিত হইবে। মনে মনে চিন্তা কর—তোমার আসন দৃঢ়, কোন কিছু তোমাকে টলাইতে পারিবে না। অতঃপর চিন্তা কর—মাথা হইতে পা পর্যন্ত একটু একটু করিয়া তোমার সমগ্র দেহ বিশুদ্ধ হইতেছে। চিন্তা কর—শরীর স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ, জীবন-সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার জন্য ইহা একটি নিখুঁত শক্ত ভেলা।
ঈশ্বরের নিকট, জগতের সকল মহাপুরুষ, ত্রাণকর্তা এবং পবিত্রাত্মাদের নিকট প্রার্থনা কর, তাঁহারা যেন তোমায় সাহায্য করেন। তারপর আধ ঘণ্টা প্রাণায়াম অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক ও রেচক অভ্যাস কর ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সহিত মনে মনে ‘ওঁ’ শব্দ উচ্চারণ কর। এই আধ্যাত্মিক শব্দের অদ্ভুত শক্তি আছে।
যোগের অন্যান্য স্তরঃ (১) প্রত্যাহার অর্থাৎ সকল বাহ্য বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গুলি সংযত করিয়া সম্পূর্ণরূপে মানসিক ধারণার দিকে পরিচালিত করা; (২) ধারণা অর্থাৎ অবিচল একাগ্রতা; (৩) ধ্যান অর্থাৎ প্রগাঢ় চিন্তা; (৪) সমাধি অর্থাৎ (শুদ্ধ ধ্যান) রূপবিবর্জিত ধ্যান। ইহা যোগের সর্বোচ্চ এবং শেষ স্তর। পরমাত্মায় সকল চিন্তাভাবনার নিরোধের নাম ‘সমাধি’—যে অবস্থায় উপলব্ধি হয়, ‘আমি ও আমার পিতা এক।’
একবারে একটি কাজ কর, এবং উহা করিবার সময় অপর সকল কাজ পরিত্যাগ করিয়া উহাতেই সমগ্র মন অর্পণ কর।
১১. রাজযোগ-শিক্ষা
[ইংলণ্ডের শিক্ষার্থীদের নিকট প্রদত্ত বক্তৃতা হইতে সংগৃহীত]
প্রাণ
পদার্থ (জড়প্রকৃতি) পাঁচ প্রকার অবস্থার অধীনঃ আকাশ, আলোক, বায়বীয়, তরল ও কঠিন—ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, বোম্—ইহাই সৃষ্টিতত্ত্ব। অতি সূক্ষ্ম বায়ুর মত আদি পদার্থ হইতে ইহাদের উদ্ভব। বিশ্বের অন্তর্গত তেজ (বা শক্তি) ‘প্রাণ’ নামে অভিহিত—উহাই এই উপাদানগুলির (পঞ্চভূতের) মধ্যে শক্তিরূপে বিদ্যমান। প্রাণশক্তির ব্যবহারের নিমিত্ত মনই মহা যন্ত্রস্বরূপ। মন জড়াত্মক। মনের পশ্চাতে অবস্থিত আত্মাই প্রাণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। প্রাণ জগতের পরিচালক-শক্তি; জীবনের প্রত্যেকটি বিকাশের মধ্যে প্রাণশক্তি দৃষ্ট হয়। দেহ নশ্বর, মনও নশ্বর; উভয়ই যৌগিক পদার্থ বলিয়া বিনাশপ্রাপ্ত হইবেই। এই-সকলের পশ্চাতে আছে অবিনাশী আত্মা। শুদ্ধ বোধস্বরূপ আত্মা প্রাণের নিয়ামক ও পরিচালক। কিন্তু যে বুদ্ধি আমাদের চতুর্দিকে দেখি, তাহা সর্বদাই অপূর্ণ। এই বোধ পূর্ণতা লাভ করিলে যীশুখ্রীষ্টাদি অবতারের আবির্ভাব ঘটে। বুদ্ধি সর্বদা নিজেকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে এবং এজন্য উন্নতির বিভিন্ন স্তরের মন ও দেহ সৃষ্টি করিতেছে। সকল বস্তুর পশ্চাতে—যথার্থ সত্তায় সকল প্রাণীই সমান।
মন অতি সূক্ষ্ম পদার্থ; উহা প্রাণশক্তি প্রকাশের যন্ত্রস্বরূপ। শক্তির বহিঃপ্রকাশের নিমিত্ত পদার্থের প্রয়োজন। পরবর্তী প্রশ্ন হইল—প্রাণকে কিরূপে ব্যবহার করা যায়। আমরা সকলেই প্রাণের ব্যবহার করিয়া থাকি, কিন্তু কি শোচনীয় ভাবেই না উহার অপচয় ঘটে! প্রস্তুতির স্তরে প্রথম নীতি হইল সমুদয় জ্ঞানই অভিজ্ঞতা-প্রসূত। পঞ্চেন্দ্রিয়ের বাহিরে যাহা কিছু বিদ্যমান, আমাদের নিকট সত্য বলিয়া প্রতিপন্ন হইবার জন্য উহা উপলব্ধি করিতে হইবে। অবচেতন, চেতন ও অতিচেতন—এই তিনটি স্তরে আমাদের মন ক্রিয়া করিয়া থাকে। যোগীই কেবল অতিচেতন মনের অধিকারী। যোগের মূলতত্ত্ব হইল, মনের ঊর্ধ্বে গমন। আলোক অথবা শব্দের স্পন্দনমাত্রা অনুযায়ী এই তিনটি স্তরের বিষয় অবগত হওয়া যায়। আলোর কতগুলি স্পন্দন এত মন্থর যে, সহজে উহা দৃষ্টিগোচর হয় না—স্পন্দনমাত্রা দ্রুত হইয়া আমাদের নিকট আলোকরূপে প্রতিভাত হয়; তারপর স্পন্দনের বেগ এত দ্রুত হয় যে, আর উহা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, শব্দ সম্বন্ধেও অনুরূপ ঘটিয়া থাকে।
স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি না করিয়া কিরূপে ইন্দ্রিয়াতীত হইতে পারা যায়, তাহাই শিখিতে হইবে। কতকগুলি যৌগিক ক্ষমতা আয়ত্ত করিতে গিয়া পাশ্চাত্য মন বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছে। ফলে ঐ শক্তিগুলি তাঁহাদের মধ্যে অস্বাভাবিকরূপে প্রকাশ পায় এবং প্রায়ই ব্যাধির আকার ধারণ করে। হিন্দুগণ বিজ্ঞানের এই বিষয়টি অনুশীলনপূর্বক নির্দোষ করিয়াছেন। এখন সকলেই কোন ভয় বা বিপদের আশঙ্কা না করিয়া উহা চর্চা করিতে পারে। অতিচেতন অবস্থার একটি সুন্দর প্রমাণ হইল মনের আরোগ্য-বিধান; কারণ—যে চিন্তা আরোগ্য সম্পাদন করে, তাহা প্রাণেরই একপ্রকার স্পন্দন এবং উহাকে ঠিক চিন্তা বলা যায় না, কিন্তু চিন্তা অপেক্ষা উচ্চস্তরের এমন কিছু—যাহার নাম আমাদের জানা নাই।