যোগীরা বলেন, আমাদের দেহে তিনটি প্রধান স্নায়ুপ্রবাহ আছে; একটিকে তাঁহারা ইড়া বলেন, অপরটিকে পিঙ্গলা, আর এই দুইটির মধ্যবর্তীটিকে বলেন সুষুম্না; এগুলি সবই মেরু-নালীর মধ্যে অবস্থিত। বামদিকের ইড়া এবং দক্ষিণের পিঙ্গলা—এই দুইটির প্রত্যেকটিই স্নায়ু-গুচ্ছ; আর মধ্যবর্তী সুষুম্নাটি একটি শূন্য নালী, স্নায়ুগুচ্ছ নয়। এই সুষুম্না-পথ রুদ্ধাবস্থায় থাকে; সাধারণ মানুষ শুধু ইড়া ও পিঙ্গলার সাহায্যেই কাজ চালায় বলিয়া ঐ পথটি তাহাদের কোন প্রয়োজনেই লাগে না। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-সঞ্চারী অন্যান্য স্নায়ুগুলির মারফত শরীরের সর্বত্র মস্তিষ্কের আদেশ পৌঁছাইয়া দিবার জন্য ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর ভিতর দিয়া স্নায়ুপ্রবাহ সব সময়ে চলাফেরা করে। ইড়া ও পিঙ্গলাকে নিয়ন্ত্রিত ও ছন্দোবদ্ধ করাই প্রাণায়ামের মহান্ উদ্দেশ্য। কিন্তু শুধু শ্বাসক্রিয়াটুকুর ভিতর কিছুই নাই—ফুসফুসের ভিতর কিছুটা বাতাস ঢুকাইয়া লওয়া ছাড়া উহা আর কি? রক্তশোধন ছাড়া উহার আর কোন প্রয়োজনই নাই; বাহির হইতে আমরা যে বায়ুকে নিঃশ্বাসের সহিত টানিয়া লই এবং উহাকে রক্তশোধনের কার্যে নিয়োগ করি, সে বায়ুর মধ্যে কোন গোপন রহস্য নাই; ঐ ক্রিয়াটা তো একটা স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই গতিটিকে প্রাণ-নামক একটি মাত্র স্পন্দনে পরিণত করা যায়; আর সব জায়গায় সব গতিই এই প্রাণেরই বিভিন্ন বিকাশ মাত্র। এই প্রাণই বিদ্যুৎ, এই প্রাণই চৌম্বক-শক্তি; মস্তিষ্ক এই প্রাণকেই চিন্তারূপে বিকীর্ণ করে। সবই প্রাণ; প্রাণই চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রগণকে চালিত করিতেছে।
আমরা বলি—বিশ্বের যাহা কিছু আছে, তাহা সবই এই প্রাণের স্পন্দনের ফলে বিকাশলাভ করিয়াছে। স্পন্দনের সর্বোচ্চ ফল চিন্তা। ইহা অপেক্ষাও বড় যদি কিছু থাকে, তাহা ধারণা করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। ইড়া ও পিঙ্গলা নামক নাড়ীদ্বয় প্রাণের সাহায্যে কাজ করে। প্রাণই বিভিন্ন শক্তিরূপে পরিণত হইয়া শরীরের প্রতি অঙ্গকে পরিচালিত করে। ভগবান্ জগৎরূপে কার্যের স্রষ্টা এবং সিংহাসনের উপরে বসিয়া ন্যায়বিচার করিতেছেন—ভগবান্ সম্বন্ধে এই প্রাচীন ধারণা পরিত্যাগ কর। কাজ করিতে করিতে আমরা ক্লান্ত হইয়া পড়ি, কারণ ঐ কার্যে আমাদের কিছুটা প্রাণ-শক্তি ব্যয়িত হইয়া যায়।
নিয়মিত প্রাণায়ামের ফলে শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রাণের ক্রিয়া ছন্দোবদ্ধ হইয়া উঠে। প্রাণ যখন নিয়মিত ছন্দে চলে, তখন দেহের সব-কিছুই ঠিকমত কাজ করে। যোগীদের যখন নিজ শরীরের উপর আধিপত্য আসে, তখন শরীরের কোন অংশ অসুস্থ হইলে তাঁহারা টের পান যে, প্রাণ সেখানে ঠিকমত ছন্দে চলিতেছে না, এবং যতক্ষণ না সহজ ছন্দ ফিরিয়া আসে, ততক্ষণ তাঁহারা প্রাণকে সেদিকে সঞ্চালিত করেন।
তোমার নিজের প্রাণকে যেমন তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পার, তেমনি যথেষ্ট শক্তিমান্ হইলে এখানে বসিয়াই ভারতে অবস্থিত অপর একজনের প্রাণকেও তুমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিবে। সব প্রাণই এক, মাঝখানে কোন ছেদ নাই; একত্বই সর্বত্র বিদ্যমান। দৈহিক দিক্ দিয়া, আত্মিক মানসিক ও নৈতিক দিক্ দিয়া, আধ্যাত্মিক দিক্ দিয়া সবই এক। জীবন একটি স্পন্দন মাত্র। যাহা এই (বিশ্বব্যাপী জড়) ‘আকাশ’-সমুদ্রকে স্পন্দিত করিতেছে, তাহাই তোমার ভিতরও স্পন্দন জাগাইতেছে। কোন হ্রদে যেমন কাঠিন্যের মাত্রার তারতম্য বিশিষ্ট অনেকগুলি বরফের স্তর গড়িয়া ওঠে, অথবা কোন বাষ্পের সাগরে বাষ্পস্তরের বিভিন্ন ঘনত্ব থাকে, এই বিশ্বটিও যেন সেই ধরনের জড় পদার্থের একটি সমুদ্র। ইহা একটি ‘আকাশের’ সমুদ্র; ইহার ভিতর ঘনত্বের তারতম্য অনুসারে আমরা চন্দ্র, সূর্য, তারা ও আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব দেখিতেছি; কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই নিরবচ্ছিন্নতা অব্যাহত রহিয়াছে, সব স্থান জুড়িয়া সেই একই পদার্থ বিদ্যমান।
অধ্যাত্মবিজ্ঞানের চর্চা করিলে আমরা বুঝিতে পারি যে, জগৎ বস্তুতঃ এক; অধ্যাত্মজগৎ, জড়জগৎ, মনোজগৎ এবং প্রাণ-জগৎ—এরূপ কোন ভেদ নাই। সবই এক জিনিষ, যদিও অনুভূতির বিভিন্ন স্তর হইতে দেখা হইতেছে। যখন তুমি নিজেকে দেহ বলিয়া ভাব, তখন তুমি যে মন, সে-কথা ভুলিয়া যাও; আবার নিজেকে যখন মন বলিয়া ভাব, তখন শরীরের কথা ভুলিয়া যাও। ‘তুমি’-নামধেয় একটি মাত্র সত্তাই আছে; সে বস্তুটিকে তুমি জড়পদার্থ বা শরীর বলিয়া মনে করিতে পার, অথবা সেটিকে মন বা আত্মারূপেও দেখিতে পার। জন্ম, জীবন ও মৃত্যু—এ-সব প্রাচীন কুসংস্কার মাত্র। কেহ কখনও জন্মায় নাই, কেহ কখনও মরিবেও না; আমরা শুধু স্থান পরিবর্তন করি—আর বেশী কিছু নয়। পাশ্চাত্যের লোকেরা যে মরণকে এত বড় করিয়া ভাবে, তাহাতে আমি দুঃখিত; সব সময় তাহারা একটু আয়ুলাভের জন্য লালায়িত। ‘মৃত্যুর পরেও যেন আমরা বাঁচিয়া থাকি; আমাদিগকে বাঁচিয়া থাকিতে দাও!’ যদি কেহ তাহাদের শোনায় যে, মৃত্যুর পরেও তাহারা বাঁচিয়া থাকিবে, তাহা হইলে তাহারা কী খুশীই না হয়! এ-বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আসে কি করিয়া! কি করিয়া আমরা কল্পনা করিতে পারি যে, আমরা মরিয়া গিয়াছি! নিজেকে মৃত বলিয়া ভাবিতে চেষ্টা কর দেখি, দেখিবে তোমার নিজের মৃতদেহ দেখিবার জন্য তুমি বাঁচিয়াই আছ। বাঁচিয়া থাকা এমন একটি অদ্ভুত সত্য যে, মুহূর্তের জন্যও তুমি তাহা ভুলিতে পার না। তোমার নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যেমন সন্দেহ হইতে পারে না, বাঁচিয়া থাকা সম্বন্ধেও ঠিক তাহাই। চেতনার প্রথম প্রমাণই হইল—‘আমি আছি’। যে অবস্থা কোন কালে ছিল না, তাহার কল্পনা করা চলে কি? সব সত্যের মধ্যে ইহা সব চেয়ে বেশী স্বতঃসিদ্ধ। কাজেই অমরত্বের ভাব মানুষের মজ্জাগত। যাহা কল্পনা করা যায় না, তাহা লইয়া কোন আলোচনা চলে কি? যাহা স্বতঃসিদ্ধ, তাহার সত্যাসত্য লইয়া আমরা আলোচনা করিতে চাহিব কেন?