এখন কর্মকুশলতার কথাতেই ফিরিয়া আসা যাক। ভারতে বহু প্রাচীনকাল হইতেই মনস্তত্ত্বের ব্যাবহারিক প্রয়োগের কাজ আরম্ভ হইয়াছে। খ্রীষ্টজন্মের প্রায় চৌদ্দ-শ বছর পূর্বে ভারতে একজন বড় দার্শনিক জন্মিয়াছিলেন। তাঁহার নাম পতঞ্জলি। মনস্তত্ত্ব-বিষয়ক সমস্ত তথ্য, প্রমাণ ও গবেষণা তিনি সংগ্রহ করিয়াছিলেন, অতীতের ভাণ্ডারে সঞ্চিত সমস্ত অভিজ্ঞতার সুযোগটুকুও লইয়াছিলেন। মনে থাকে যেন, জগৎ অতি প্রাচীন; মাত্র দুই বা তিন হাজার বছর পূর্বে ইহার জন্ম হয় নাই। এখানে—পাশ্চাত্যদেশে শেখান হয় যে, ‘নিউ টেষ্টামেণ্ট’-এর সঙ্গে আঠারো-শ বছর আগে সমাজের জন্ম হইয়াছিল; তাহার পূর্বে সমাজ বলিয়া কিছু ছিল না। পাশ্চাত্য-জগতের বেলা এ-কথা সত্য হইতে পারে, কিন্তু সমগ্র জগতের বেলা নয়। লণ্ডনে যখন বক্তৃতা দিতাম, তখন আমার একজন সুপণ্ডিত মেধাবী বন্ধু প্রায়ই আমার সঙ্গে তর্ক করিতেন; তাঁহার তূণীরে যত শর ছিল, তাহার সবগুলি একদিন আমার উপর নিক্ষেপ করিবার পর হঠাৎ তারস্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘তাহা হইলে আপনাদের ঋষিরা ইংলণ্ডে আমাদের শিক্ষা দিতে আসেন নাই কেন?’ উত্তরে আমি বলিয়াছিলাম, ‘কারণ তখন ইংলণ্ড বলিয়া কিছু ছিলই না, যে সেখানে আসিবেন। তাঁহারা কি অরণ্যে গাছপালার কাছে প্রচার করিবেন?’
ইঙ্গারসোল আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘পঞ্চাশ বছর আগে এদেশে প্রচার করিতে আসিলে আপনাকে এখানে ফাঁসি দেওয়া হইত, আপনাকে জীবন্ত দগ্ধ করা হইত, অথবা ঢিল ছুঁড়িয়া গ্রাম হইতে তাড়াইয়া দেওয়া হইত।’
কাজেই খ্রীষ্টজন্মের চৌদ্দ-শ বছর পূর্বেও সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, ইহা মনে করা মোটেই অযৌক্তিক নয়। সভ্যতা সব সময়েই নিম্নতর অবস্থা হইতে উচ্চতর অবস্থায় আসিয়াছে কিনা—এ-কথার মীমাংসা এখনও হয় নাই। এই ধারণাটিকে প্রমাণ করিবার জন্য যে-সব যুক্তি-প্রমাণ দেখান হইয়াছে, ঠিক সেই-সব যুক্তি-প্রমাণ দিয়া ইহাও দেখান যায় যে, সভ্য মানুষই ক্রমে অসভ্য বর্বরে পরিণত হইয়াছে। দৃষ্টান্তরূপে বলা যায়, চীনারা কখনও বিশ্বাসই করিতে পারে না যে, আদিম বর্বর অবস্থা হইতে সভ্যতার উৎপত্তি হইয়াছে; কারণ তাহাদের অভিজ্ঞতা ইহার বিপরীত সত্যেরই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু তোমরা যখন আমেরিকার সভ্যতার উল্লেখ কর, তখন তোমাদের বলিবার প্রকৃত অভিপ্রায় এই যে, তোমাদের জাতি চিরকাল থাকিবে এবং উন্নতির পথেই চলিবে। যে হিন্দুরা সাত শত বৎসর ধরিয়া অবনতির পথে চলিতেছে, তাহারা প্রাচীনকালে সভ্যতায় অতি-উন্নত ছিল—এ-কথা বিশ্বাস করা খুবই সহজ। ইহা যে সত্য নয়—এ-কথা প্রমাণ করা যায় না।
কোন সভ্যতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত একটিও পাওয়া যায় না। অপর একটি সুসভ্য জাতি আসিয়া কোন জাতির সহিত মিশিয়া যাওয়া ছাড়াই সে জাতি সভ্য হইয়া উঠিয়াছে—এরূপ একটি জাতিও জগতে নাই। এক হিসাবে বলিতে পারা যায়, মূল সভ্যতার অধিকারী জাতি একটি বা দুটি ছিল, তাহারাই বাহিরে যাইয়া নিজেদের ভাব ছড়াইয়াছে এবং অন্যান্য জাতির সহিত মিশিয়া গিয়াছে; এইভাবেই সভ্যতার বিস্তার ঘটিয়াছে।
বাস্তব জীবনে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় কথা বলাই ভাল। কিন্তু একটি কথা তোমাদের স্মরণ রাখিতেই হইবে। ধর্মবিষয়ক কুসংস্কার যেমন আছে; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সেইরূপ কুসংস্কার আছে। এমন অনেক পুরোহিত আছেন, যাঁহারা ধর্মানুষ্ঠানকে নিজ জীবনের বৈশিষ্ট্যরূপে গ্রহণ করেন; তেমনি বৈজ্ঞানিক নামধেয় এমন অনেক আছেন, যাঁহারা প্রাকৃতিক নিয়মের পূজারী। ডারউইন বা হাক্সলির মত বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের নাম করা মাত্র আমরা অন্ধভাবে তাঁহাদের অনুসরণ করি। এইটি আজকালকার চলিত প্রথা। যাহাকে আমরা বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান বলি, তাহার ভিতর শতকরা নিরানব্বই ভাগই হইতেছে নিছক মতবাদ। ইহাদের অনেকগুলি আবার প্রাচীনকালের বহু-মস্তক ও বহু-হস্তবিশিষ্ট ভূতে অন্ধ বিশ্বাস অপেক্ষা কোন অংশে উৎকৃষ্ট নয়; তবে পার্থক্য এইটুকু যে, কুসংস্কার হইলেও উহাতে মানুষকে গাছপাথর প্রভৃতি অচেতন পদার্থ হইতে অন্ততঃ খানিকটা আলাদা বলিয়া ভাবা হইত। যথার্থ বিজ্ঞান আমাদের সাবধানে চলিতে বলে। পুরোহিতদের সঙ্গে ব্যবহারে যেমন সতর্ক হইয়া চলিতে হয়, বিজ্ঞানীদের বেলায়ও তেমনি সতর্কতা আবশ্যক। অবিশ্বাস লইয়া শুরু কর। বিশ্লেষণ করিয়া পরীক্ষা করিয়া, সব প্রমাণ পাইয়া তবে বিশ্বাস কর। আধুনিক বিজ্ঞানের অতিপ্রচলিত বিশ্বাস এখনও প্রমাণোত্তীর্ণ হয় নাই। অঙ্কশাস্ত্রের মত বিজ্ঞানের ভিতরেও অনেকগুলি মতবাদই শুধু কাজ চালাইয়া যাইবার উপযুক্ত সাময়িক সিদ্ধান্ত হিসাবে গৃহীত হইয়াছে। উচ্চতর জ্ঞানের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাতিল হইয়া যাইবে।
খ্রীষ্টজন্মের চৌদ্দ-শ বছর পূর্বে একজন বড় ঋষি কতকগুলি মনস্তাত্ত্বিক তথ্যের সুবিন্যাস, বিশ্লেষণ এবং সামান্যীকরণের চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া আরও অনেকে তাঁহার আবিষ্কৃত জ্ঞানের অংশবিশেষ লইয়া তাহার বিশেষ চর্চা করিয়া গিয়াছেন। প্রাচীন জাতিগুলির মধ্যে শুধু হিন্দুরাই জ্ঞানের এই বিশেষ শাখাটির চর্চায় যথার্থ আন্তরিকতার সহিত ব্রতী হইয়াছিলেন। আমি এখন বিষয়টি তোমাদের শিখাইতেছি—কিন্তু তোমরা কয়জনই বা ইহা অভ্যাস করিবে? অভ্যাস ছাড়িয়া দিতে কয়দিন বা কয়মাস আর লাগিবে তোমাদের? এ-বিষয়ের উপযুক্ত উদ্যম তোমাদের নাই। ভারতবাসীরা কিন্তু যুগের পর যুগ ইহার অনুশীলন চালাইয়া যাইবে। শুনিয়া আশ্চর্য হইবে, ভারতবাসীদের কোন সাধারণ প্রার্থনা-গৃহ, কোন সাধারণ সমবেত প্রার্থনা-মন্ত্র বা ঐ-জাতীয় কোন কিছু নাই; তাহা সত্ত্বেও তাহারা প্রতিদিন শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ অভ্যাস করে, মনকে একাগ্র করিতে চেষ্টা করে; এইটিই তাহাদের উপাসনার প্রধান অঙ্গ। এইগুলিই মূল কথা। প্রত্যেক হিন্দুকে ইহা করিতেই হয়। ইহাই সে-দেশের ধর্ম। তবে সকলে এক পদ্ধতি অবলম্বনে উহা না-ও করিতে পারে, শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ, মনঃসংযম প্রভৃতি অভ্যাস করিবার জন্য এক এক জনের এক একটি বিশেষ পদ্ধতি থাকিতে পারে। কিন্তু একজনের পদ্ধতি অপরের জানিবার প্রয়োজন হয় না, এমন কি তাহার স্ত্রীর-ও না; পিতাও হয়তো জানেন না, পুত্র কি পদ্ধতি অবলম্বনে চলিতেছে। কিন্তু সকলকেই এ-সব অভ্যাস করিতে হয়। আর এ-সবের মধ্যে কোন গোপন রহস্য নাই; গোপন রহস্যের কোন ভাবই ইহার মধ্যে নাই। হাজার হাজার লোক নিত্য গঙ্গাতীরে বসিয়া চোখ বুজিয়া প্রাণায়াম ও মনের একাগ্রতা-সাধনের অভ্যাস করিতেছে—এ-দৃশ্য নিত্যই চোখে পড়ে। মানব-সাধারণের পক্ষে কতকগুলি অভ্যাস-সাধনার পথে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে দুইটি অন্তরায় থাকিতে পারে। প্রথমতঃ ধর্মাচার্যেরা মনে করেন যে, সাধারণ লোক এ-সব সাধনার যোগ্য নয়। এই ধারণায় হয়তো কিছু সত্য থাকিতে পারে, কিন্তু গর্বের ভাবই ইহার জন্য বেশী দায়ী। দ্বিতীয় অন্তরায় নির্যাতনের ভয়। যেমন—এদেশে হাস্যাস্পদ হইবার ভয়ে প্রকাশ্য স্থানে কেহ প্রাণায়াম অভ্যাস করিতে চাহিবে না; এখানে এ-সবের চলন নাই। আবার ভারতে যদি কেহ, ‘ভগবান্, আজ আমাকে দিনের অন্ন যোগাড় করিয়া দাও’ বলিয়া প্রার্থনা করে, তবে লোকে উপহাস করিবে। হিন্দুদের দৃষ্টিতে ‘হে আমার স্বর্গবাসী পিতা’ ইত্যাদি বলার চেয়ে বড় আহাম্মকি থাকিতে পারে না। উপাসনাকালে হিন্দু ইহাই ভাবিয়া থাকে যে, ভগবান্ তাহার অন্তরেই রহিয়াছেন।