————–
১ নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ ।—মুণ্ডকোপনিষদ্, ৩।২।৪
————–
সাধন আরম্ভ করিবার পূর্বে মনে যত প্রকার সন্দেহ আসিতে পারে সব দূর করুন। যতদূর পারেন, যুক্তি-তর্ক-বিচার করুন। তারপর যখন মনের মধ্যে স্থির সিদ্ধান্ত করিবেন যে, ইহাই—কেবল ইহাই সত্য, আর কিছুই নয়, তখন আর তর্ক করিবেন না, তখন মুখ একেবারে বন্ধ করুন। তখন আর তর্কযুক্তি শুনিবেন না, নিজেও তর্ক করিবেন না। আর তর্কযুক্তির প্রয়োজন কি? আপনি তো বিচার লাভ করিয়া তৃপ্তিলাভ করিয়াছেন, আপনি তো সমস্যার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তবে আর এখন বাকি কি? এখন সত্যের সাক্ষাৎকার করিতে হইবে। অতএব বৃথা তর্কে এবং অমূল্যকাল-হরণে কি ফল? এখন ঐ সত্যকে ধ্যান করিতে হইবে, আর যে কোন চিন্তা আপনাকে তেজস্বী করে, তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে; এবং যাহা দুর্বল করে, তাহাই পরিত্যাগ করিতে হইবে। ভক্ত মূর্তি-প্রতিমাদি এবং ঈশ্বরের ধ্যান করেন। ইহাই স্বাভাবিক সাধনপ্রণালী, কিন্তু ইহাতে অতি মৃদু গতিতে অগ্রসর হইতে হয়। যোগীরা তাহাদের দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কেন্দ্র বা চক্রের উপর ধ্যান করেন এবং মনোমধ্যস্থ শক্তিসমূহ পরিচালনা করেন। জ্ঞানী বলেন, মনের অস্তিত্ব নাই, দেহেরও নাই। এই দেহ ও মনের চিন্তা দূর করিয়া দিতে হইবে, অতএব উহাদের চিন্তা করা অজ্ঞানোচিত কার্য। ঐরূপ করা যেন একটা রোগ আনিয়া আর একটা রোগ আরোগ্য করার মতো। জ্ঞানীর ধ্যানই সর্বাপেক্ষা কঠিন—নেতি নেতি; তিনি সব কিছুই অস্বীকার করেন, আর যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাই আত্মা। ইহাই সর্বাপেক্ষা অধিক বিশ্লেষণাত্মক (বিলোম) সাধন। জ্ঞানী কেবল বিশ্লেষণ বলে জগৎটা আত্মা হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে চান। ‘আমি জ্ঞানী’-এ কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু যথার্থ জ্ঞানী হওয়া বড়ই কঠিন। বেদ বলিতেছেনঃ
পথ অতি দীর্ঘ, এ যেন শাণিত ক্ষুরাধারের উপর দিয়া ভ্রমণ; কিন্তু নিরাশ হইও না। উঠ, জাগো, যতদিন না সেই চরম লক্ষে পৌঁছিতেছ, ততদিন ক্ষান্ত হইও না।১
অতএব জ্ঞানীর ধ্যান কি প্রকার? জ্ঞানী দেহমন বিষয়ক সর্বপ্রকার চিন্তা অতিক্রম করিতে চান। তিনি যে দেহ, এই ধারণা দূর করিয়া দিতে চান। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুন, যখনই আমি বলি, ‘আমি স্বামী অমুক’ তৎক্ষণাৎ দেহের ভাব আসিয়া থাকে। তবে কি করিতে হইবে? মনের উপর সবলে আঘাত করিয়া বলিতে হইবে, ‘আমি দেহ নই, আমি আত্মা।’ রোগই আসুক, অথবা অতি ভয়ানক আকারে মৃত্যুই আসিয়া উপস্থিত হউক, কে তাহা গ্রহ্য করে? আমি দেহ নই। দেহ সুন্দর রাখিবার চেষ্টা কেন? এই মায়া এই ভ্রান্তি—আর একবার উপভোগের জন্য? এই দাসত্ব বজায় রাখিবার জন্য? দেহ যাক, আমি দেহ নই। ইহাই জ্ঞানীর সাধনপ্রণালী। ভক্ত বলেন, ‘প্রভু আমাকে এই জীবনসমুদ্র সহজে উত্তীর্ণ হইবার জন্য এই দেহ দিয়াছেন, অতএব যতদিন না সেই যাত্রা শেষ হয়, ততদিন ইহাকে যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করিতে হইবে।’ যোগী বলেন, ‘আমাকে অবশ্যই দেহের যত্ন করিতে হইবে, যাহাতে আমি ধীরে ধীরে সাধনপথে অগ্রসর হইয়া পরিণামে মুক্তিলাভ করিতে পারি।’ জ্ঞানী মনে করেন, তিনি আর বিলম্ব করিতে পারেন না। তিনি এই মুহূর্তেই চরম লক্ষে পৌঁছিবেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিত্যমুক্ত, কোন কালেই বদ্ধ নই; অনন্তকাল ধরিয়া আমি এই জগতের ঈশ্বর। আমাকে আবার পূর্ণ করিবে কে? আমি নিত্য পূর্ণস্বরূপ।’ যখন কোন মানুষ স্বয়ং পূর্ণতা লাভ করে, সে অপরের মধ্যেও পূর্ণতা দেখিয়া থাকে। যখন অপরের মধ্যে অপূর্ণতা দেখে, তখন তাহার নিজ মনেরই ভাব বাহিরে প্রক্ষিপ্ত হইতেছে বুঝিতে হইবে। তাহার নিজের ভিতৱ যদি অপূর্ণতা না থাকে, তবে সে কিরূপে অপূর্ণতা দেখিবে? অতএব জ্ঞানী পূর্ণতা বা অপূর্ণতা কিছুই গ্রহ্য করেন না। তাহার পক্ষে উহাদের কোনটিরই অস্তিত্ব নাই। যখন তিনি মুক্ত হন, তখন হইতেই তিনি আর ভাল মন্দ দেখেন না। ভাল মন্দ কে দেখে?—যাহার নিজের ভিতর ভাল-মন্দ আছে। দেহ কে দেখে?—যে নিজেকে দেহ মনে করে। যে মুহূর্তে আপনি দেহভাব-রহিত হইবেন, সেই মুহূর্তেই আপনি আর জগৎ দেখিতে পাইবেন না। উহা চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। জ্ঞানী কেবল বিচার-জনিত সিদ্ধান্তবলে এই জড়বন্ধন হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিতে চেষ্টা করেন। ইহাই ‘নেতি, নেতি’ মার্গ।
——————
১ তুলনীয়ঃ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।—কঠ. উপ, ১।৩।১৪
——————
০৭. আত্মার একত্ব
পূর্ব বক্তৃতায় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গিয়াছে, তাহা দৃষ্টান্ত দ্বারা দৃঢ়তর করিবার জন্য আমি একখানি উপনিষদ্১ হইতে কিছু পাঠ করিয়া শুনাইব। তাহাতে দেখিবেন, অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতে কিরূপে এই সকল তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়া হইত।
যাজ্ঞবল্ক্য নামে একজন মহর্ষি ছিলেন। আপনারা অবশ্য জানেন, ভারতে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, বয়স হইলে সকলকেই সংসার ত্যাগ করিতে হইবে। সুতরাং সন্ন্যাস গ্রহণের সময় উপস্থিত হইলে যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহার স্ত্রীকে বলিলেন ‘প্রিয়ে মৈত্রেয়ী, আমি সংসার ত্যাগ করিয়া চলিলাম, এই আমার যাহা কিছু অর্থ, বিষয়সম্পত্তি বুঝিয়া লও।’
মৈত্রেয়ী বলিলেন, ‘ভগবান্, ধনরত্নে পূর্ণা সমুদয় পৃথিবী যদি আমার হয়, তাহা হইলে কি তাহার দ্বারা আমি অমৃতত্ব লাভ করিব?’
যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন, ‘না, তাহা হইতে পারে না। ধনী লোকেরা যেরূপে জীবনধারণ করে, তোমার জীবনও সেইরূপ হইবে; কারণ ধনের দ্বারা কখনও আমৃতত্ব লাভ করা যায় না।’
মৈত্রেয়ী কহিলেন, ‘যাহা দ্বারা আমি অমৃত লাভ করিতে পারি, তাহা লাভ করিবার জন্য আমাকে কি করিতে হইবে? যদি সে উপায় আপনার জানা থাকে, আমাকে তাহাই বলুন।’
যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন, ‘তুমি বরাবরই আমার প্রিয় ছিলে, এখন এই প্রশ্ন করাতে তুমি প্রিয়তরা হইলে। এস, আসন গ্রহণ কর, আমি তোমাকে তোমার জিজ্ঞাসিত তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিব। তুমি উহা শুনিয়া ধ্যান করিতে থাকো।’ যাজ্ঞবল্ক্য বলিতে লাগিলেনঃ
‘হে মৈত্রেয়ি, স্ত্রী যে স্বামীকে ভালবাসে, তাহা স্বামীর জন্য নয়, কিন্তু আত্মার জন্যই স্ত্রী স্বামীকে ভালবাসে; কারণ সে আত্মাকে ভালবাসিয়া থাকে। স্ত্রীর জন্যই কেহ স্ত্রীকে ভালবাসে না, কিন্তু যেহেতু সে আত্মাকে’ ভালবাসে, সেইহেতু স্ত্রীকে ভালবাসিয়া থাকে। সন্তানগণকে কেহ তাহাদের জন্যই ভালবাসে না, কিন্তু যেহেতু সে আত্মাকে ভালবাসে, সেই হেতুই সন্তানগণকে ভালবাসিয়া থাকে। অর্থকে কেহ অর্থের জন্য ভালবাসে না, কিন্তু যেহেতু সে আত্মাকে ভালবাসে, সেইহেতু অর্থ ভালবাসিয়া থাকে। ব্রাহ্মণকে যে লোকে ভালবাসে, তাহা সেই ব্রাহ্মণের জন্য নয়, কিন্তু আত্মাকে ভালবাসে বলিয়াই লোকে ব্রাহ্মণকে ভালবাসিয়া থাকে। ক্ষত্রিয়কেও লোকে ক্ষত্রিয়ের জন্য ভালবাসে না, আত্মাকে ভালবাসে বলিয়াই লোকে ক্ষত্রিয়কে ভালবাসিয়া থাকে। এজগৎকেও লোকে যে ভালবাসে, তাহা জগতের জন্য নয়, কিন্তু যেহেতু সে আত্মাকে ভালবাসে, সেইহেতু জগৎ তাহার প্রিয়। দেবগণকে যে লোকে ভালবাসে, তাহা সেই দেবগণের জন্য নয়, কিন্তু যেহেতু সে আত্মাকে ভালবাসে, সেইহেতু দেবগণ তাহার প্রিয়। অধিক কি, কোন বস্তুকে যে লোকে ভালবাসে, তাহা সেই বস্তুর জন্য নয়, কিন্তু তাহার যে আত্মা বিদ্যমান, তাহার জন্যই সে ঐ বস্তুকে ভলবাসে, অতএব এই আত্মার সম্বন্ধে শ্রবণ করিতে হইবে, তারপর নিদিধ্যাসন অর্থাৎ উহার ধ্যান করিতে হইবে। হে মৈত্রেয়ি, আত্মার শ্রবণ, আত্মার দর্শন, আত্মার সাক্ষাৎকার দ্বারা এই সবই জ্ঞাত হয়।’
এই উপদেশের তাৎপর্য কি? এরকম অদ্ভুত রকমের দর্শন। আমরা জগত বলিতে যাহা কিছু বুঝি, সকলের ভিতর দিয়াই, আত্মা প্রকাশ পাইতেছেন। লোকে বলিয়া থাকে, সর্বপ্রকার প্রেমই স্বার্থপরতা—স্বার্থপরতার যতদূর নিম্নতম অর্থ হইতে পারে, সেই অর্থে সকল প্রেমই স্বার্থপরতাপ্রসূত; যেহেতু আমি আমাকে ভালবাসি, সেইহেতু অপরকে ভালবাসিয়া থাকি। বর্তমান কালেও অনেক দার্শনিক আছেন, যাঁহাদের মত এই যে, ‘স্বার্থই জগতে সকল কার্যের একমাত্র প্রেরণাদায়িনী শক্তি।’ এ কথা এক হিসাবে সত্য, আবার অন্য হিসাবে ভুল। আমাদের এই ‘আমি’ সেই প্রকৃত ‘আমি’ বা আত্মার ছায়ামাত্র, যিনি আমাদের পশ্চাতে রহিয়াছেন। আর সসীম বলিয়াই এই ক্ষুদ্র ‘আমি’র উপর ভালবাসা অন্যায় ও মন্দ বলিয়া বোধ হয়। বিশ্ব আত্মার প্রতি যে ভালবাসা, তাহাই সসীমভাবে দৃষ্ট হইলে মন্দ বলিয়া বোধ হয়, স্বার্থপরতা বলিয়া বোধ হয়। এমনকি স্ত্রীও যখন স্বামীকে ভালবাসে, সে জানুক বা নাই জানুক, সে সেই আত্মার জন্যই স্বামীকে ভালবাসিতেছে। জগতে উহা স্বার্থপরতা-রূপে ব্যক্ত হইতেছে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উহা আত্মপরতা বা আত্মভাবেরই ক্ষুদ্র অংশ। যখনই কেহ কিছু ভালবাসে, তাহাকে সেই আত্মার মধ্য দিয়াই ভালবাসিতে হয়।
এই আত্মাকে জানিতে হইবে। যাহারা আত্মার স্বরূপ না জানিয়া উহাকে ভালবাসে, তাহাদের ভালবাসাই স্বার্থপরতা। যাঁহারা আত্মাকে জানিয়া উহাকে ভালবাসেন, তাহাদের ভালবাসায় কোনরূপ বন্ধন নাই, তাহারা পরম জ্ঞানী। কেহই ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণের জন্য ভালবাসে না, কিন্তু ব্রাহ্মণের মধ্য দিয়া যে আত্মা প্রকাশ পাইতেছেন, সেই আত্মাকে ভালবাসে বলিয়াই সে ব্রাহ্মণকে ভালবাসে।
‘ব্রাহ্মণ তাহাকে পরিত্যাগ করেন, যিনি ব্রাহ্মণকে আত্মা হইতে পৃথক দেখেন; ক্ষত্রিয় তাহাকে পরিত্যাগ করেন, যিনি ক্ষত্রিয়কে আত্মা হইতে পৃথক দেখেন; লোকসমূহ বা জগৎ তাহাকে ত্যাগ করে, যিনি জগৎকে আত্মা হইতে পৃথক দেখেন; দেবগণ তাহাকে পরিত্যাগ করেন, যিনি দেবগণকে আত্মা হইতে পৃথক বলিয়া বিশ্বাস করেন।…সকল বস্তুই তাঁহাকে পরিত্যাগ করে, যিনি তাহাদিগকে, আত্মা হইতে পৃথকরূপে দর্শন করেন। এই ব্রহ্মণ, এই ক্ষত্রিয়, এই লোকসমূহ, এই দেবগণ….এমনকি যাহা কিছু জগতে আছে, সবই আত্মা।’
এইরূপে যাজ্ঞবল্ক্য ভালবাসা বলিতে তিনি কি লক্ষ্য করিতেছেন, তাহা বুঝাইলেন। যখনই আমরা এই প্রেমকে কোন বিশেষ বস্তুতে সীমাবদ্ধ করি, তখনই যত গোলমাল। মনে করুন, আমি কোন নারীকে ভালবাসি, যদি আমি সেই নারীকে আত্মা হইতে পৃথকভাবে, বিশেষ ভাবে দেখি, তবে উহা আর শাশ্বত প্রেম হইল না। উহা স্বার্থপর ভালবাসা হইয়া পড়িল, আর দুঃখই উহার পরিণাম; কিন্তু যখনই আমি সেই নারীকে আত্মারূপে দেখি তখনই সেই ভালবাসা যথার্থ প্রেম হইল, তাহার কখন বিনাশ নাই। এইরূপ যখনই আপনারা সমগ্র হইতে বা আত্মা হইতে পৃথক্ করিয়া জগতের কোন এক বস্তুতে আসক্ত হন, তখনই তাহাতে প্রতিক্রিয়া আসিয়া থাকে। আত্মা ব্যতীত যাহা কিছু আমরা ভালবাসি, তাহারই ফল শোক ও দুঃখ। কিন্তু যদি আমরা সমুদয় বস্তুকে আত্মার অন্তর্গত ভাবিয়া ও আত্ম-রূপে, সম্ভোগ করি, তাহা হইতে কোন দুঃখ কষ্ট বা প্রতিক্তিয়া আসিবে না। ইহাই পূর্ণ আনন্দ।
এই আদর্শে উপনীত হইবার উপায় কি? যাজ্ঞবল্ক্য ঐ অবস্থা লাভ করিবার প্রণালী বলিতেছেন। এই ব্রহ্মাণ্ড অনন্ত; আত্মাকে না জানিয়া জগতের প্রত্যেক বিশেষ বিশেষ বস্তু লইয়া উহাতে আত্মদৃষ্টি করিব কিরূপে?
‘যদি দুন্দুভি বাজিতে থাকে, আমরা উহা হইতে উৎপন্ন শব্দ-লহরীগুলি পৃথকভাবে গ্রহণ করিতে পারি না, কিন্তু দুন্দুভির সাধারণ ধ্বনি বা আঘাত হইতে ধ্বনিসমূহ গৃহীত হইলে ঐ বিভিন্ন শব্দলহরীও গৃহীত হইয়া থাকে।
‘শঙ্খ নিনাদিত হইলে উহার স্বরলহরী পৃথক্ পৃথক্ ভাবে গ্রহণ করিতে পারি না, কিন্তু শঙ্খের সাধারণ ধ্বনি অথবা বিভিন্নভাবে নিনাদিত শব্দরাশি গৃহীত হইলে শব্দলহরীগুলিও গৃহীত হয়।
‘বীণা বাজিতে থাকিলে উহার বিভিন্ন স্বরগ্রাম পৃথকভাবে গৃহীত হয় না, কিন্তু বীনার সাধারণ সুর অথবা বিভিন্নরূপে উত্থিত সুরসমূহ গৃহীত হইলে ঐ স্বরগ্রামগুলিও গৃহীত হয়।
‘যেমন কেহ ভিজা কাঠ জ্বালাইতে থাকিলে তাহা হইতে নানাপ্রকার ধুম ও স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, সেরূপ সেই মহান পুরুষ হইতে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্বাঙ্গিরস, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, উপনিষৎ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যা—এই সমস্ত নিঃশ্বাসের ন্যায় বহির্গত হয়। সমস্তই তাঁহার নিঃশ্বাস-স্বরূপ।
‘যেমন সমুদয় জলের একমাত্র আশ্রয় সমুদ্র, যেমন সমুদয় স্পর্শের একমাত্র আশ্রয় ত্বক, যেমন সমুদয় গন্ধের একমাত্র আশ্রয় নাসিকা, যেমন সমুদয় রসের একমাত্র আশ্রয় জিহ্বা, যেমন সমুদয় রূপের একমাত্র আশ্রয় চক্ষু, যেমন সমুদয় শব্দের একমাত্র আশ্রয় কর্ণ, যেমন সমুদয় চিন্তার একমাত্র আশ্রয় মন, যেমন সমুদয় জ্ঞানের একমাত্র আশ্রয় হৃদয়, যেমন সমুদয় কর্মের একমাত্র আশ্রয় হস্ত, যেমন সমুদয় বাক্যের একমাত্র আশ্রয় বাগিন্দ্রিয়, যেমন সমুদ্র—জলের সর্বাংশে লবণ ঘনীভূত রহিয়াছে অথচ উহা চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না, সেইরূপ হে মৈত্রেয়ি, এই আত্মাকে চক্ষু দ্বারা দেখা যায় না, কিন্তু তিনি এই জগৎ ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তিনি সব কিছু। তিনি বিজ্ঞানঘন। সমুদয় জগৎ তাঁহা হইতে উত্থিত হয় এবং পুনরায় তাঁহাতেই ডুবিয়া যায়। কারণ তাহার নিকট পৌঁছিলে আমরা জ্ঞানাতীত অবস্থায় চলিয়া যাই।’
এখানে আমরা এই ভাব পাইলাম যে, আমরা সকলেই স্ফুলিঙ্গাকারে তাঁহা হইতে বহির্গত হইয়াছি, আর তাঁহাকে জানিতে পারিলে তাঁহার নিকট ফিরিয়া গিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত এক হইয়া যাই।
এই উপদেশে মৈত্রেয়ী ভীত হইলেন, সর্বত্রই লোকে যেমন হইয়া থাকে। মৈত্রেয়ী বলিলেন, ‘ভগবান্, আপনি এইখানে আমাকে বিভ্রান্ত করিয়া দিলেন। দেবতা প্রভৃতি সে অবস্থায় থাকিবে না, ‘আমি’ জ্ঞানও নষ্ট হইয়া যাইবে—এ কথা বলিয়া আপনি আমার ভীতি উৎপাদন করিতেছেন। যখন আমি ঐ অবস্থা পৌঁছিব, তখন কি আমি কি আত্মাকে জানিতে পারিব? অহংজ্ঞান হারাইয়া তখন অজ্ঞান-অবস্থা প্রাপ্ত হইব, অথবা আমি তাহাকে জানিতেছি এই জ্ঞান থাকিবে? তখন কি কাহাকেও জানিবার, কিছু অনুভব করিবার, কাহাকেও ভালবাসিবার, কাহাকেও ঘৃণা করিবার থাকিবে না?’
যাজ্ঞবল্ক্য বলিলেন, ‘মৈত্রেয়ী, মনে করিও না যে আমি মোহজনক কথা বলিতেছি, তুমি ভয় পাইও না। এই আত্মা অবিনাশী, তিনি স্বরূপতঃ নিত্য। যে অবস্থায় দুই থাকে অর্থাৎ যাহা দ্বৈতাবস্থা, তাহা নিম্নতর অবস্থা। যেখনে দ্বৈতভাব থাকে, সেখানে একজন অপরকে ঘ্রাণ করে, সেখানে একজন অপরকে দর্শন করে, সেখানে একজন অপরকে শ্রবণ করে, সেখানে একজন অপরকে অভ্যর্থনা করে, একজন অপরের সম্বন্ধে চিন্তা করে, একজন অপরকে জানে। কিন্তু যখনই সব আত্মা হইয়া যায়, তখন কে কাহার ঘ্রাণ লইবে, কে কাহাকে দেখিবে, কি কাহাকে শুনিবে, কে কাহাকে অভ্যর্থনা করিবে, কে কাহাকে জানিবে? যাঁহা দ্বারা জানা যায়, তাঁহাকে কে জানিতে পারে? এই আত্মাকে কেবল ‘নেতি নেতি’ (ইহা নয়, ইহা নয়) এইরূপে বর্ণনা করা যাইতে পারে। তিনি অচিন্ত্য, তাঁহাকে বুদ্ধি দ্বারা ধারণা করিতে পারা যায় না। তিনি অপরিণামী, তাঁহার কখন ক্ষয় হয় না। তিনি অনাসক্ত, কখনই তিনি প্রকৃতির সহিত মিশ্রিত হন না। তিনি পূর্ণ, সমুদয় সুখ দুঃখের অতীত। বিজ্ঞাতাকে কে জানিতে পারে? কি উপায়ে আমরা তাঁহাকে জানিতে পারি? কোন উপায়েই নয়। হে মৈত্রেয়ি, ইহাই ঋষিদিগের চরম সিদ্ধান্ত। সমুদয় জ্ঞানের অতীত অবস্থায় যাইলেই তাহাকে লাভ করা হয়। তখনই অমৃতত্ব লাভ হয়।’
এতদূর পর্যন্ত এই ভাব পাওয়া গেল যে, এই সমুদয়ই এক অনন্ত পুরুষ আর তাঁহাতেই আমাদের যথার্থ আমিত্ব—সেখানে কোন ভাগ বা অংশ নাই, ভ্রমাত্মক নিম্নভাবগুলির কিছুই নাই। কিন্তু তথপি এই ক্ষুদ্র আমিত্বের ভিতর আগাগোড়া সেই অনন্ত যথার্থ আমিত্ব প্রতিভাত হইতেছে : সমুদয়ই আত্মার অভিব্যক্তিমাত্র। কি করিয়া আমরা এই আত্মাতে লাভ করিব? যাজ্ঞবল্ক্য প্রথমেই আমাদিগকে বলিয়াছেন, ‘প্রথমে এই আত্মার সম্বন্ধে শুনিতে হইবে, তারপর বিচার করিতে হইবে, তারপর উহার ধ্যান করিতে হইবে।’ ঐ পর্যন্ত তিনি আত্মাকে এই জগতের সর্ববস্তুর সাররূপে বর্ণনা করিয়াছেন। তারপর সেই আত্মার অনন্ত স্বরূপ আর মানবমনের শান্তভাব সম্বন্ধে বিচার করিয়া তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলেন যে, সকলের জ্ঞাতা আত্মাকে সীমাবদ্ধমনের দ্বারা জানা অসম্ভব। যদি আত্মাকে জানিতে না পারা যায়, তবে কি করিতে হইবে? যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে বলিলেন, যদিও আত্মাকে জানা যায় না, তথাপি উহাকে উপলব্ধি করা যাইতে পারে। সুতরাং তাহাকে কিরূপে ধ্যান করিতে হইবে, সেই বিষয়ে উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন। এই জগত সকল প্রাণীরই কল্যাণকারী এবং প্রত্যেক প্রাণীরই কল্যাণকারী এবং প্রত্যেক প্রাণীই জগতের কল্যাণকারী; কারণ উভয়েই পরস্পরের অংশী—একের উন্নতি অপরের উন্নতির সাহায্য করে। কিন্তু স্বপ্রকাশ আত্মার কল্যাণকারী বা সাহায্যকারী কেহ হইতে পারে না, কারণ তিনি পূর্ণ অনন্তস্বরূপ। জগতে যতকিছু আনন্দ আছে, এমনকি খুব নিম্নস্তরের আনন্দ পর্যন্ত, ইহারই প্রতিবিম্বমাত্র। যাহা কিছু ভাল, সবই সেই আত্মার প্রতিবিম্বমাত্র, আর ঐ প্রতিবিম্ব যখন অপেক্ষকৃত অস্পষ্ট হয়, তাহাকেই মন্দ বলা যায়। যখন এই আত্মা কম অভিব্যক্ত, তখন তাহাকে তমঃ বা মন্দ বলে; যখন অধিকতর অভিব্যক্ত, তখন উহাকে প্রকাশ বা ভাল বলে। এই মাত্র প্রভেদ। ভালমন্দ কেবল মাত্রার তারতম্য, আত্মার কম বেশী অভিব্যক্তি লইয়া। আমাদের নিজেদের জীবনের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করুন। ছেলেবেলা কত জিনিসকে আমরা ভাল বলিয়া মনে করি, বাস্তবিক সেগুলি মন্দ। আবার কত জিনিসকে মন্দ বলিয়া দেখি, বাস্তবিক সেগুলি ভাল। আমাদের ধারণার কেমন পরিবর্তন হয়! একটা ভাব কেমন উচ্চ হইতে উচ্চতর হইতে থাকে! আমরা এক সময় যাহা খুব ভাল বলিয়া ভাবিতাম, এখন আর তাহা সেরূপ ভাল ভাবি না। এইরূপে ভালমন্দ আমাদের মনের বিকাশের উপর নির্ভর করে, বাহিরে উহাদের অস্তিত্ব নাই। প্রভেদ কেবল মাত্রার তারতম্যে। সবই সেই আত্মার প্রকাশমাত্র। আত্মা সব কিছুতে প্রকাশ পাইতেছেন; কেবল তাহার প্রকাশ অল্প হইলে আমরা মন্দ বলি এবং স্পষ্টতর হইলে ভাল বলি। কিন্তু আত্মা স্বয়ং শুভাশুভের অতীত। অতএব জগতে যাহা কিছু আছে সবকেই প্রথমে ভাল বলিয়া ধ্যান করিতে হইবে, কারণ সবই সেই পূর্ণস্বরূপের অভিব্যক্তি। তিনি ভালও নন, মন্দও নন; তিনি পূর্ণ, আর পূর্ণ বস্তু কেবল একটিই হইতে পারে। ভাল জিনিস অনেক প্রকার হইতে পারে, মন্দও অনেক থাকিতে পারে, ভাল মন্দের মধ্যে প্রভেদের নানাবিধ মাত্রা থাকিতে পারে, কিন্তু পূর্ণ বস্তু কেবল একটিই; ঐ পূর্ণ বস্তু বিশেষ বিশেষ প্রকার আবরণের মধ্য দিয়া দৃষ্ট হইলে বিভিন্ন মাত্রায় ভাল বলিয়া আমরা অভিহিত করি, অন্য প্রকার আবরণের মধ্য দিয়া প্রকাশিত হইলে উহাকে আমরা মন্দ বলিয়া অভিহিত করি। এই বস্তু সম্পূর্ণ ভাল, ঐ বস্তু সম্পূর্ণ মন্দ-এরূপ ধারণা কুসংস্কার মাত্র। প্রকৃতপক্ষে এই পর্যন্ত বলা যায় যে, এই জিনিস বেশী ভাল, ঐ জিনিস কম ভাল, আর কম ভালকেই আমরা মন্দ বলি। ভাল-মন্দ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা হইতেই সর্বপ্রকার দ্বৈত ভ্রম প্রসূত হইয়াছে। উহারা সকল যুগের নরনারীর বিভীষিকাপ্রদ ভাবরূপে মানবজাতির হৃদয়ে দৃঢ়-নিবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। আমরা যে অপরকে ঘৃনা করি, তাহার কারণ শৈশবকাল হইতে অভ্যস্ত এই সব মূর্খজনোচিত ধারণা। মানজাতি সম্বন্ধে আমাদের বিচার একেবারে ভ্রান্তিপূর্ণ হইয়াছে, আমরা এই সুন্দর পৃথিবীকে নরকে পরিণত করিয়াছি, কিন্তু যখনই আমরা ভাল মন্দের এই ভ্রান্ত ধারণাগুলি ছাড়িয়া দিব, তখনই ইহা স্বর্গে পরিণত হইবে।
এখন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহার স্ত্রীকে কি উপদেশ দিতেছেন, শোনা যাকঃ
‘এই পৃথিবী সকল প্রাণীর পক্ষে মধু অর্থাৎ মিষ্ট বা আনন্দ জনক, সকল প্রাণীই আবার এই পৃথিবীর পক্ষে মধু উভয়েই পরস্পরের সাহায্য করিয়া থাকে। আর ইহাদের সেই মধুরত্ব সেই তেজোময় অমৃতময় আত্মা হইতে আসিতেছে।’
সেই এক মধু বা মধুরত্ব বিভিন্নভাবে অভিব্যক্ত হইতেছে। যেখানেই মানবজাতির ভিতর কোনরূপ প্রেম বা মধুরত্ব দেখা যায়, সাধুতেই হউক, পাপীতেই হউক, মহাপুরুষেই হউক বা হত্যাকারীতেই হউক, দেহেই হউক, মনেই হউক বা ইন্দ্রিয়েই হউক,সেখানেই তিনি আছেন সেই এক পুরুষ ব্যতীত উহা আর কি হইতে পারে? অতি নিম্নতম ইন্দ্রিয়সুখও তিনি, আবার উচ্চতম আধ্যাত্মিক আনন্দও তিনি। তিনি ব্যতীত মধুরত্ব থাকিতে পারে না। যাজ্ঞবল্ক্য ইহাই বলিতেছেন। যখন আপনি ঐ অবস্থায় উপনীত হইবেন, যখন সকল বস্তু সমদৃষ্টিতে দেখিবেন; যখন মাতালের পানাশক্তি ও সাধুর ধ্যানে সেই এক মধুরত্ব—এক আনন্দের প্রকাশ দেখিবেন, তখনই বুঝিতে হইবে, আপনি সত্য লাভ করিয়াছেন। তখনই কেবল আপনি বুঝিবেন-সুখ কাহাকে বলে, শান্তি কাহাকে বলে, প্রেম কাহাকে বলে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আপনি এই বৃথা ভেদজ্ঞান রাখিবেন, মূর্খের মতো ছেলেমানুষী কুসংস্কারগুলি রাখিবেন, ততদিন আপনার সর্বপ্রকার দুঃখ আসিবে। সেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষই সমগ্র জগতের ভিত্তিস্বরূপ উহার পশ্চাতে রহিয়াছেন—সবই তাহার মধুরত্বের অভিব্যক্তিমাত্র। এই দেহটিও ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ—আর সেই দেহের সমুদয় শক্তির ভিতর দিয়া, মনের সর্বপ্রকার উপভোগের মধ্য দিয়া সেই তেজোময় পুরুষ প্রকাশ পাইতেছেন। দেহের মধ্যে সেই তেজোময় স্বপ্রকাশ পুরুষ রহিয়াছেন, তিনিই আত্মা। ‘এই জগত সকল প্রাণীর পক্ষে এমন মধুময় এবং সকল প্রাণীই উহার নিকট মধুময়’, কারণ সেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ এই সমগ্র জগতের আনন্দস্বরূপ। আমাদের মধ্যেও তিনি আনন্দস্বরূপ। তিনিই ব্রহ্ম।
‘এই বায়ু সকল প্রাণীর পক্ষে মধুস্বরূপ, আর এই বায়ুর নিকটও সকল প্রাণী মধুস্বরূপ, কারণ সেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ ৰায়ুতেও রহিয়াছেন এবং দেহেও রহিয়াছেন। তিনি সকল প্রাণীর প্রাণরূপে প্রকাশ পাইতেছেন।’
‘এই সূর্য সকল প্রাণীর পক্ষে মধুস্বরূপ এবং এই সূর্যের পক্ষেও সকল প্রাণী মধুস্বরূপ, কারণ সেই তেজোময় পুরুষ সূর্যে রহিয়াছেন এবং তাহারই প্রতিবিম্ব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্যোতিরূপে প্রকাশ পাইতেছে। সমুদয়ই তাঁহার প্রতিবিম্ব ব্যতীত আর কি হইতে পারে? তিনি আমাদের দেহেও রহিয়াছেন এবং তাহারই ঐ প্রতিবিম্ব-বলে আমরা আলোক দর্শনে সমর্থ হইতেছি।’
‘এই চন্দ্র সকল প্রাণীর পক্ষে মধুস্বরূপ, এই চন্দ্রের পক্ষে আবার সকল প্রাণী মধুস্বরূপ, কারণ সেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ, যিনি চন্দ্রের অন্তরাত্মা-স্বরূপ, তিনিই আমাদের ভিতর মন-রূপে প্রকাশ পাইতেছেন।’
‘এই বিদ্যুৎ সকল প্রাণীর পক্ষে মধুস্বরূপ, সকল প্রাণীই বিদ্যুতের পক্ষে মধুস্বরূপ, কারণ সেই তেজোময় অমৃতময় পুরুষ বিদ্যুতের আত্মাস্বরূপ আর তিনি আমাদের মধ্যেও রহিয়াছেন, কারণ সবই সেই ব্রহ্ম।’
‘সেই ব্রহ্ম, সেই আত্মা সকল প্রাণীর রাজা।’
এই ভাবগুলি মানবের পক্ষে বড়ই উপকারী; ঐগুলি ধ্যানের জন্য উপদিষ্ট। দৃষ্টান্তস্বরূপ : পৃথিবীকে ধ্যান করিতে থাকুন। পৃথিবীকে চিন্তা করুন, সঙ্গে সঙ্গে ইহাও ভাবুন যে, পৃথিবীতে যাহা আছে, আমাদের দেহেও তাহাই আছে। চিন্তাবলে পৃথিবী ও দেহ এক করিয়া ফেলুন, আর দেহস্থ আত্মার সহিত পৃথিবীর অন্তর্বতী আত্মার অভিন্নভাব সাধন করুন। বায়ুকে বায়ুর ও আপনার অভ্যন্তরবর্তী আত্মার সহিত অভিন্নভাবে চিন্তা করুন। এইরূপে সকল ধ্যান করিতে হয়। এ-সবই এক, শুধু বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পাইতেছে। সকল ধ্যানেরই চরম লক্ষ্য—এই একত্ব উপলব্ধি করা, আর যাজ্ঞবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে ইহাই বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছিলেন।