—————–
১ বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’ আছে—ঈশ্বর যদি নর আদম ও আদি নারী ইভকে সৃজন করিয়া তাহাদিগকে ইডেন নামক সুরম্য উদ্দানে স্থাপন করেন এবং তাহাদিগকে ঐ উদ্যানস্থ জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ করিতে নিষেধ করেন। কিন্তু শয়তান সর্পরূপধারী হইয়া প্রথমে ইভকে প্রলোভিত করিয়া তৎপর তাহার দ্বারা আদমকে ঐ বৃক্ষের ফলভক্ষণে প্রলোভিত করে। উহাতেই তাহাদের ভালমন্দ-জ্ঞান উপস্থিত হইয়া পাপ প্রথম পৃথিবীতে প্রবেশ করিল।
——————
প্রত্যেক ব্যক্তিই চিন্তায় মনে কার্যে একখণ্ড প্রস্তর বা এই টেবিলটার মতো বদ্ধ। আমি আপনাদের নিকট বক্তৃতা দিতেছি, আর আপনারা আমার কথা শুনিতেছেন—এই উভয়ই কঠোর কার্য কারণ নিয়মের অধীন। মায়া হইতে যতদিন না বাহিরে যাইতেছেন, ততদিন স্বাধীনতা বা মুক্তি নাই। ঐ মায়াতীত অবস্থাই আত্মার যথার্থ স্বাধীনতা। কিন্তু মানুষ যতই তীক্ষ্ণবুদ্ধি হউক না কেন, এখানকার কোন বস্তুই যে স্বাধীন বা মুক্ত হইতে পারে না—এই যুক্তির বল মানুষ যতই স্পষ্টরূপে দেখুক না কেন, সকলেই বাধ্য হইয়া নিজেদের স্বাধীন বলিয়া চিন্তা করিতে হয়, তাহা না করিয়া কেহ থাকিতে পারে না। যতক্ষণ না আমরা বলি যে আমরা স্বাধীন, ততক্ষণ কোন কাজ করা সম্ভব নয়। ইহার তাৎপর্য এই যে, আমরা যে স্বাধীনতার কথা বলিয়া থাকি, তাহা অজ্ঞানরূপ মেঘরাশির মধ্য দিয়া নির্মল নীলাকাশরূপ সেই শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মার চকিতদর্শন-মাত্র, আর নীলাকাশরূপ প্রকৃত স্বাধীনতা বা মুক্তস্বভাব আত্মা উহার বাহিরে রহিয়াছেন। যথার্থ স্বাধীনতা এই ভ্রমের মধ্যে, এই মিথ্যার মধ্যে, এই অর্থহীন সংসারে, ইন্দ্রিয়-মন-দেহ-সমন্বিত এই বিশ্বজগতে থাকিতে পারে না। এই-সকল অনাদি অনন্ত স্বপ্ন—যেগুলি আমাদের বশে নাই, যেগুলিকে বশে আনাও যায় না, যেগুলি অযথা সন্নিবেশিত, ভগ্ন ও আসামঞ্জস্যময়—সেই-সব স্বপ্নকে লইয়া আমাদের এই জগৎ। আপনি যখন স্বপ্নে দেখেন যে, বিশ-মুণ্ড একটি দৈত্য আপনাকে ধরিবার জন্য আসিতেছে, আর আপনি তাহার নিকট হইতে পলাইতেছেন, আপনি উহাকে অসংলগ্ন মনে করেন না। আপনি মনে করেন, এ তো ঠিকই হইতেছে। আমরা যাহাকে নিয়ম বলি তাহাও এইরূপ। যাহা কিছু আপনি নিয়ম বলিয়া নির্দিষ্ট করেন, তাহা আকস্মিক ঘটনামাত্র, উহার কোন অর্থ নাই। এই স্বপ্নাবস্থায় আপনি উহাকে নিয়ম বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। মায়ার ভিতর যতদূর পর্যন্ত দেশ কাল নিমিত্তের নিয়ম বিদ্যমান, ততদূর পর্যন্ত স্বাধীনতা বা মুক্তি নাই, আর এই বিভিন্ন উপাসনা প্রণালী এই মায়ার অন্তর্গত। ঈশ্বরের ধারণা এবং পশু ও মানবের ধারণা—সবই এই মায়ার মধ্যে, সুতরাং সবই সমভাবে ভ্রমাত্মক, সবই স্বপ্নমাত্র। তবে আজকাল আমরা কতকগুলি অতিবুদ্ধি দিগ্গজ দেখিতে পাই। আপনারা যেন তাঁহাদের মতো তর্ক বা সিদ্ধান্ত না করিয়া বসেন, সেই বিষয়ে সাবধান হইবেন। তাঁহারা বলেন, ঈশ্বর ধারণা ভ্রমাত্মক, কিন্তু এই জগতের ধারণা সত্য। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু এই উভয় ধারণা একই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁহারই কেবল যথার্থ নাস্তিক হইবার অধিকার আছে, যিনি ইহজগৎ পরজগৎ উভয়ই আস্বীকার করেন। উভয়টিই এই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ঈশ্বর হইতে ক্ষুদ্রতম জীব পর্যন্ত, আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সেই মায়ার রাজত্ব। এইপ্রকার যুক্তিতে ইহাদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় বা নাস্তিক সিদ্ধ হয়। যে ব্যক্তি ঈশ্বর ধারণা ভ্রমাত্মক জ্ঞান করে, তাহার নিজ দেহ এবং মনের ধারণাও ভ্রমাত্মক জ্ঞান করা উচিৎ। যখন ঈশ্বর উড়িয়া যান, তখন দেহ ও মন উড়িয়া যায়, আর যখন উভয়ই লোপ পায়, তখনই যাহা যথার্থ সত্তা, তাহা চিরকালের জন্য থাকিয়া যায়।
‘সেখানে চক্ষু যাইতে পারে না, বাক্যও যাইতে পারে না, মনও নয়। আমরা তাহাদিগকে দেখিতে পাই না বা জানিতেও পারি না।’ ১
ইহার তাৎপর্য আমরা এখন বুঝিতে পারিতেছি যে, যতদূর বাক্য, চিন্তা বা বুদ্ধি যাইতে পারে, ততদূর পর্যন্ত মায়ার আধিকার, ততদূর পর্যন্ত বন্ধনের ভিতর। সত্য উহাদের বাহিরে। সেখানে চিন্তা মন বা বাক্য কিছুই পৌঁছিতে পারে না।
এতক্ষণ পর্যন্ত বিচারের দ্বারা তো বেশ বুঝা গেল, কিন্তু এইবার সাধনের কথা আসিতেছে। এইসব ক্লাসে আসল শিক্ষার বিষয় সাধন। এই একত্ব উপলব্ধির জন্য কোন প্রকার সাধনের প্রয়োজন আছে কি?—নিশ্চয়ই আছে। সাধনার দ্বারা যা আপনাদিগকে এই ব্রহ্ম হইতে হইবে তাহা নয়, আপনারা তো পূর্ব হইতেই ‘ব্রহ্ম’ আছেন। আপনাদিগকে ঈশ্বর হইতে হইবে বা পূর্ণ হইতে হইবে, এ কথা সত্য নয়। আপনারা সর্বদা পূর্ণস্বরূপই আছেন, আর যখনই মনে করেন—আপনারা পূর্ণ নন, সে তো একটা ভ্রম। এই ভ্রম—যাহাতে আপনাদের বোধ হইতেছে, আমুক পুরুষ, আমুক নারী তাহা আর একটি ভ্রমের দ্বারা দূর হইতে পারে, আর সাধন বা অভ্যাসই সেই অপর ভ্রম। আগুণ আগুণকে খাইয়া ফেলিবে—আপনারা অপর একটি ভ্রম নাস করিবার জন্য অপর একটি ভ্রমের সাহায্য নিতে পারেন। একখণ্ড মেঘ আসিয়া অপর এই মেঘকে সরাইয়া দিবে, শেষে উভয়ই চলিয়া যাইবে। তবে এই সাধনাগুলি কি? আমাদের সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, আমরা যে মুক্ত হইব তাহা নয়; আমরা সর্বদাই মুক্ত। আমরা বদ্ধ এরূপ ভাবনামাত্রই ভ্রম; আমরা সুখী বা আমরা অসুখী—এরূপ ভাবনামাত্রই গুরুতর ভ্রম। আর এক ভ্রম আসিবে যে, আমাদিগকে মুক্ত হইবার জন্য সাধনা, উপাসনা ও চেষ্টা করিতে হইবে; এই ভ্রম আসিয়া প্রথম ভ্রমটিকে সরাইয়া দিবে; তখন উভয় ভ্রমই দূর হইয়া যাইবে।
মুসলমানেরা শিয়ালকে অতিশয় পবিত্র মনে করিয়া থাকে, হিন্দুরাও তেমনি কুকুরকে অশুচি ভাবিয়া থাকে। অতএব শিয়াল বা কুকুর খাবার ছুঁইলে উহা ফেলিয়া দিতে হয়, উহা আর কাহারও খাইবার উপায় নাই। কোন মুসলমানের বাটিতে একটি শিয়াল প্রবেশ করিয়া টেবিল হইতে কিছু খাদ্য খাইয়া পালাইল। লোকটি বড়ই দরিদ্র ছিল। সে নিজের জন্য সেদিন অতি উত্তম ভোজের আয়োজন করিয়াছিল, আর সেই ভোজ্যদ্রব্যগুলি শিয়ালের স্পর্শে অপবিত্র হইয়া গেল! আর তাহার খাইবার উপায় নাই। কাজে কাজেই সে একজন মোল্লার কাছে গিয়া নিবেদন করিল, ‘সাহেব’ গরিবের এক নিবেদন শুনুন। একটি শিয়াল আসিয়া আমার খাদ্য হইতে খানিকটা খাইয়া গিয়াছে, এখন ইহার একটা উপায় করুন। আমি অতি সুখাদ্য সব প্রস্তুত করিয়াছিলাম। আমার বড়ই বাসনা ছিল যে, পরম তৃপ্তির সহিত উহা ভোজন করিব। একটা শিয়াল আসিয়া সব নষ্ট করিয়া দিয়া গেল। আপনি ইহার যাহা হয় একটা ব্যবস্থা দিন। মোল্লা মুহূর্তের জন্য একটু ভাবিলেন, তারপর উহার একমাত্র সিদ্ধান্ত করিয়া বলিলেন, ইহার একমাত্র উপায়—একটা কুকুর লইয়া আসিয়া যে থালা হইতে শিয়ালটা খাইয়া গিয়াছে, সেই থালা হইতে তাহাকে একটু খাওয়ানো। এখন কুকুর শিয়ালের নিত্য বিবাদ। তা শিয়ালের উচ্ছিষ্টটাও তোমার পেটে যাইবে, কুকুরের উচ্ছিষ্টটাও যাইবে, এ দুই উচ্ছিষ্ট পরস্পর সেখানে ঝগড়া লাগিবে, তখন সব শুদ্ধ হইয়া যাইবে।’ আমরাও অনেকটা এইরূপ সমস্যায় পড়িয়াছি। আমরা যে অপূর্ণ, ইহা একটি ভ্রম; আমরা উহা দূর করিবার জন্য আর একটি ভ্রমের সাহায্য লইলাম—পূর্ণতা লাভের জন্য আমাদিগকে সাধনা করিতে হইবে। তখন একটি ভ্রম আর একটি ভ্রমকে দূর করিয়া দিবে, যেমন আমরা একটি কাঁটা তুলিবার জন্য আর একটি কাঁটার সাহায্য লইতে পারি এবং শেষে উভয় কাঁটাই ফেলিয়া দিতে পারি। এমন লোক আছেন, যাঁহাদের পক্ষে একবার ‘তত্ত্বমসি’ শুনিলে তৎক্ষণাৎ জ্ঞানের উদয় হয়। চকিতের মধ্যে এই জগৎ উড়িয়া যায়, আর আত্মার যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ পাইতে থাকে, কিন্তু আর সকলকে এই বন্ধনের ধারণা দূর করিবার জন্য কঠোর চেষ্টা করিতে হয়।
প্রথম প্রশ্ন এই : জ্ঞানযোগী হইবার অধিকারী কাহারা? যাহাদের নিম্নলিখিত সাধন-সম্পত্তিগুলি আছেল। প্রথমতঃ ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগ’—এই জীবনে বা পরজীবনে সর্বপ্রকার কর্মফল ও সর্বপ্রকার ভোগবাসনা ত্যাগ। যদি আপনিই এই জগতের স্রষ্টা হন, তবে আপনি যাহা বাসনা করিবেন, তাহাই পাইবেন; কারণ আপনি উহা স্বীয় ভোগের জন্য সৃষ্টি করিবেন। কেবল কাহারও শীঘ্র, কাহারও বা বিলম্বে ঐ ফললাভ হইয়া থাকে। কেহ কেহ তৎক্ষণাৎ উহা প্রাপ্ত হয়; অপরের পক্ষে অতীত সংস্কার সমষ্টি তাহাদের বাসনাপুর্তির ব্যাঘাত করিতে থাকে। আমরা ইহজন্ম বা পরজন্মের ভোগবাসনাকে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দিয়া থাকি। ইহজন্ম, পরজন্ম বা আপনার কোনরূপ জন্ম আছে-ইহা একেবারে অস্বীকার করুন; কারণ জীবন মৃত্যুরই নামান্তরমাত্র। আপনি যে জীবনসম্পন্ন প্রাণী, ইহাও অস্বীকার করুন। জীবনের জন্য কে ব্যস্ত? জীবন একটা ভ্রমমাত্র, মৃত্যু উহার আর এক দিক মাত্রল সুখ এই ভ্রমের এক দিক, দুঃখ আর একটা দিক। সকল বিষয়েই এইরূপ। আপনার জীবন বা মৃত্যু লইয়া কি হইবে? এ-সকলই তো মনের সৃষ্টিমাত্র। ইহাকে ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগ’ বলে।
তারপর ‘শম’ বা মনঃসংযমের প্রয়োজন। মনকে এমন শান্ত করিতে হইবে যে, উহা আর তরঙ্গাকারে ভগ্ন হইয়া সর্ববিধ বাসনার লীলাক্ষেত্র হইবে না।