————-
১ বৃহ. উপ., ৫।১৫ দ্রষ্টব্য
————-
এই শরীর আমি নই, ইহার নাশ অবশ্যম্ভাবী—ইহা তো উপদেশ। কিন্তু এই উপদেশের দোহাই দিয়া লোকে অনেক অদ্ভুত ব্যাপার করিতে পারে। একজন লোক উঠিয়া বলিল, ‘আমি দেহ নই, অতএব আমার মাথাধরা আরাম হইয়া যাক।’ কিন্তু তাঁহার শিরঃপীড়া যদি তাহার দেহে না থাকে তবে আর কোথায় আছে? সহস্র শিরঃপীড়া ও সহস্র দেহ আসুক, যাক্—তাহাতে আমার কি?
‘আমার জন্মও নাই, মৃত্যুও নাই; আমার পিতাও নাই, আমার মাতাও নাই; আমার শত্রুও নাই, মিত্রও নাই; কারণ তাহারা সকলেই আমি। (আমিই আমার বন্ধু, আমিই আমার শত্রু ), আমি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, আমি সেই, আমিই সেই।’ ১
————-
১ ন মে মৃত্যুশঙ্কা ন মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম।
ন বন্ধুর্ন মিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যঃ চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।
—নির্বাণষটকম্,৫, শঙ্করাচার্য
————–
যদি আমি সহস্র দেহে জ্বর ও অন্যান্য রোগ ভোগ করতে থাকি, আবার লক্ষ লক্ষ দেহে আমি স্বাস্থ্য সম্ভোগ করিতেছি। যদি সহস্র দেহে আমি উপবাস করি, আবার অন্য সহস্র দেহে প্রচুর পরিমাণে আহার করিতেছি। যদি সহস্র দেহে আমি দুঃখ ভোগ করিতে থাকি, আবার সহস্র দেহে আমি সুখ ভোগ করিতেছি। কে কাহার নিন্দা করিবে? কে কাহার স্তুতি করিবে? কাহাকে চাহিবে, কাহাকে ছাড়িবে? আমি কাহাকেও চাই না, কাহাকেও ত্যাগ করি না; কারণ আমি সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ। আমিই আমার স্তুতি করিতেছি, আমিই আমার নিন্দা করিতেছি, আমি নিজের দোষে নিজে কষ্ট পাইতেছি; আর আমি যে সুখী, তাহাও আমার নিজের ইচ্ছায়। আমি স্বাধীন। ইহাই জ্ঞানীর ভাব—তিনি মহা সাহসী, অকুতভয়, নির্ভীক। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড নষ্ট হইয়া যাক না কেন, তিনি হাস্য করিয়া বলেন, উহার কখনও অস্তিত্বই ছিল না, উহা কেবল মায়া ও ভ্রমমাত্র। এইরূপে তিনি তাহার চক্ষের সমক্ষে জগদব্রহ্মাণ্ডকে যথার্থই অন্তর্হিত হইতে দেখেন, ও বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করেন, ‘এ জগৎ কোথায় ছিল? কোথায় বা মিলাইয়া গেল?’ ১
এই জ্ঞানের সাধন সম্বন্ধে আলোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে আর একটি আশঙ্কার আলোচনা ও তৎ সমাধানের চেষ্টা করিব। এ পর্যন্ত যাহা বিচার করা হইল, তাহা ন্যায়শাস্ত্রের সীমা বিন্দুমাত্র উল্লঙ্ঘন করে নাই। যদি কোন ব্যক্তি বিচারে প্রবৃত্ত হয়, তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত করে যে, একমাত্র সত্তাই বর্তমান, আর সমুদয় কিছুই নয়, ততক্ষণ তাহার থামিবার উপায় নাই। যুক্তিপরায়ণ মানব জাতির পক্ষে এই সিদ্ধান্ত-অবলম্বন ব্যতীত গত্যন্তর নাই। কিন্তু এক্ষণে প্রশ্ন এই : যিনি অসীম, সদা পূর্ণ, সদানন্দময়, অখণ্ড সচ্চিদানন্দস্বরূপ, তিনি এই সব ভ্রমের অধীন হইলেন কিরূপে? এই প্রশ্নই জগতের সর্বত্র সকল সময়ে জিজ্ঞাসিত হইয়া আসিতেছে? সাধারণ চলিত কথায় প্রশ্নটি এই ভাবে করা হয় : এই জগতে পাপ কিরূপে আসিল? ইহাই প্রশ্নটির চলিত ও ব্যাবহারিক রূপ, আর অপরটি অপেক্ষাকৃত দার্শনিক রূপ। কিন্তু উত্তর একই। নানা স্তর হইতে নানাভাবে ঐ একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়াছে, কিন্তু নিম্নতরভাবে উপস্থাপিত হইলে প্রশ্নটির কোন মীমাংসা হয় না ;
————–
১ ক্ক গতং কেন বা নীতং কুত্র লীনমিদং জগৎ।—বিবেকচূড়ামণি, ৪৮৫
————–
কারণ আপেল, সাপ ও নারীর গল্পে ১ এই তত্ত্বের কিছুই ব্যাখ্যা হয় না। ঐ অবস্থায় প্রশ্নটিও যেমন বালকোচিত, উহার উত্তরও তেমনি। কিন্তু বেদান্তে এই প্রশ্নটি অতি গুরুতর আকার ধারণ করিয়াছে—এই ভ্রম কিরূপে আসিল? আর উত্তরও সেইরূপ গভীর। উত্তরটি এই : অসম্ভব প্রশ্নের উত্তর আশা করিও না। ঐ প্রশ্নটির অন্তর্গত বাক্যগুলি পরস্পর বিরোধী বলিয়া প্রশ্নটিই অসম্ভব। কেন ? পূর্ণতা বলিতে কি বুঝায়? যাহা দেশ কাল নিমিত্তের অতীত, তাহাই পূর্ণ। তারপর আপনি জিজ্ঞাসা করিতেছেন, পূর্ণ কি রূপে অপূর্ণ হইল? ন্যায়শাস্ত্রসঙ্গত ভাষায় নিবদ্ধ করিলে প্রশ্নটি এই আকারে দাঁড়ায়—‘যে বস্তু কার্য-কারণ-সম্বন্ধের অতীত, তাহা কিরূপে কার্যরূপে পরিণত হয়। এখানে তো আপনিই আপনাকে খণ্ডন করিতেছেন। আপনি প্রথমেই মানিয়া লইয়াছেন, উহা কার্য-কারণ-সম্বন্ধের অতীত, তারপর জিজ্ঞাসা করিতেছেন, উহা কিরূপে কার্যে পরিণত হয়? কার্য-কারণ-সম্বন্ধের সীমার ভিতরেই কেবল প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইতে পারে। যতদূর পর্যন্ত দেশ কাল নিমিত্তের অধিকার, ততদূর পর্যন্ত এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার অতীত বস্তু সম্বন্ধে প্রশ্ন করাই নিরর্থক; কারণ প্রশ্নটি যুক্তিবিরুদ্ধ হইয়া পড়ে। দেশ কাল নিমিত্তের গণ্ডির ভিতরে কোনকালে উহার উত্তর দেওয়া যাইতে পারে না, আর উহাদের অতীত প্রদেশে কি উত্তর পাওয়া যাইবে, তাহা সেখানে গেলেই জানা যাইতে পারে। এই জন্য বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এই প্রশ্নটির উত্তরের জন্য বিশেষ ব্যস্ত হয় না। যখন লোকে পীড়িত হয়, তখন ‘কিরূপে ঐ রোগের উৎপত্তি হইল, তাহা প্রথমে জানিতে হইবে’—এই বিষয়ে বিশেষ জেদ না করিয়া রোগ যাহাতে সারিয়া যায়, তাহারই জন্য প্রাণপণ যত্ন করে।
এই প্রশ্ন আর একটি আকারে জিজ্ঞাসিত হইয়া থাকে। ইহা একটু নিম্নস্তরের কথা বটে, কিন্তু ইহাতে আমাদের কর্মজীবনের সঙ্গে অনেকটা সম্বন্ধ আছে এবং ইহাতে তত্ত্ব অনেকটা স্পষ্টতর হইয়া আসে। প্রশ্নটি এই : এই ভ্রম কে উৎপন্ন করিল? কোন সত্য কি কখনও ভ্রম জন্মাইতে পারে? কখনই নয়। আমরা দেখিতে পাই, একটা ভ্রমই আর একটা ভ্রম জন্মাইয়া থাকে। সেটি আবার একটি ভ্রম জন্মায়, এইরূপ চলিতে থাকে। ভ্রমই চিরকাল ভ্রম উৎপন্ন করিয়া থাকে। রোগ হইতেই রোগ জন্মায়, স্বাস্থ্য হইতে কখন রোগ জন্মায় না। জল ও জলের তরঙ্গে কোন ভেদ নাই-কার্য কারণেই আর এক রূপমাত্র। কার্য যখন ভ্রম, তখন তাহার কারণও অবশ্য ভ্রম হইবে। এই ভ্রম কে উৎপন্ন করিল? আবশ্য আর একটি ভ্রম। এইরূপে তর্ক করিলে তর্কের আর শেষ হইবে না—ভ্রমের আর আদি পাওয়া যাইবে না। এখন আপনাদের একটি মাত্র প্রশ্ন অবশিষ্ট থাকিবে : ভ্রমের অনাদিত্ব স্বীকার করিলে আপনার অদ্বৈতবাদ খণ্ডিত হইল না? কারণ আপনি জগতে দুইটি সত্তা স্বীকার করিতেছেন—একটি আপনি আর একটি ঐ ভ্রম। ইহার উত্তর এই যে, ভ্রমকে সত্তা বলা যাইতে পারে না। আপনারা জীবনে সহস্র সহস্র স্বপ্ন দেখিতেছেন, কিন্তু সেগুলি আপনাদের জীবনের অংশস্বরূপ নয়। স্বপ্ন আসে, আবার চলিয়া যায়। উহাদের কোন অস্তিত্ব নাই। ভ্রমকে একটি সত্তা বা অস্তিত্ব বলিলে উহা আপাততঃ যুক্তিসঙ্গত মনে হয় বটে, বাস্তবিক কিন্তু উহা অযৌক্তিক কথামাত্র। অতএব জগতে নিত্যমুক্ত ও নিত্যানন্দস্বরূপ একমাত্র সত্তা আছে, আর তাহাই আপনি। অদ্বৈতবাদীদের ইহাই চরম সিদ্ধান্ত। এখন জিজ্ঞসা করা যাইতে পারে, এই যে সকল বিভিন্ন উপাসনাপ্রণালী রহিয়াছে, এগুলির কি হইবে?- এগুলি সবই থাকিবে। এসব কেবল আলোর জন্য অন্ধকারে হাতড়ানো, আর ঐরূপ হাতড়াইতে হাতড়াইতে আলোক আসিবে। আমরা এইমাত্র দেখিয়া আসিয়াছি যে, আত্মা নিজেকে দেখিতে পায় না। আমাদের সমুদয় জ্ঞান মায়ার (মিথ্যার) জালের মধ্যে অবস্থিত, মুক্তি উহার বাহিরে; এই জালের মধ্যে দাসত্ব, ইহার সবকিছুই নিয়মাধীন। উহার বাহিরে আর কোন নিয়ম নাই। এই ব্রহ্মাণ্ড যতদূর, ততদূর পর্যন্ত নিয়মাধীন, মুক্তি তাহার বাহিরে। যে পর্যন্ত আপনি দেশ-কাল-নিমিত্তের জালের মধ্যে রহিয়াছেন, সে পর্যন্ত আপনি মুক্ত—এ কথা বলা নিরর্থক। কারণ ঐ জালের মধ্যে সবই কঠোর নিয়মে—কার্য কারণ শৃঙ্খলে বদ্ধ। আপনি যে-কোন চিন্তা করেন, তাহা পূর্ব কারণের কার্যস্বরূপ, প্রত্যেক ভাবই কারণের কার্য-রূপ। ইচ্ছাকে স্বাধীন বলা একেবারে নিরর্থক। যখনই সেই অনন্ত সত্তা যেন এই মায়াজালের মধ্যে পড়ে, তখনই উহা ইচ্ছার আকার ধারণ করে। ইচ্ছা মায়াজালে আবদ্ধ সেই পুরুষের কিঞ্চিদংশমাত্র, সুতরাং ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ বাক্যটির কোন অর্থ নাই, উহা সম্পূর্ণ নিরর্থক। স্বাধীনতা বা মুক্তি সম্বন্ধে এই সকল বাগাড়ম্বরও বৃথা। মায়ার ভিতর স্বাধীনতা নাই।