অতএব এই সংসারগতি-বর্ননার নামই মায়া। সাধারণতঃ লোকে এ কথা শুনিয়া ভয় পায়। আমাদিগকে সাহসী হইতে হইবে। অবস্থার বিষয় গোপন করিলে রোগের প্রতিকার হইবে না। কুকুর দ্বারা অনুসৃত হইয়া শশক যেরূপ মাটিতে মাথা লুকাইয়া নিজেকে নিরাপদ মনে করে, আমরা আশবাদী বা নিরাশাবাদী হইয়া অবিকল সেই শশকের মতো কাজ করিতেছি। ইহা রোগ মুক্তির ঔষধ নহে।
অপর পক্ষে-ইহজীবনে প্রাচুর্য, সুখ ও স্বাচ্ছান্দ্য-ভোগিগণ এই মায়াবাদ সম্বন্ধে বিস্তর আপত্তি উত্থাপন করেন। এদেশে-ইংলণ্ডে নিরাশাবাদী হওয়া কঠিন। সকলেই আমাকে বলিতেছেন-জগতে কাজ কি সুন্দররূপে সম্পন্ন হইতেছে! জগত কি রূপ উন্নতিশীল! কিন্তু তাঁহারা নিজেদের জীবনকেই তাঁহাদের জগৎ বলিয়া জানেন। পুরাতন প্রশ্ন উঠিতেছে-খ্রীষ্টধর্মই পৃথিবী-মধ্যে একমাত্র ধর্ম কারন খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী জাতিমাত্রেই সমৃদ্ধিশালী। কিন্তু এইরূপ উক্তি স্ববিরোধী। যেহেতু অখ্রীষ্টান জাতিদের দুর্ভাগ্যই খ্রীষ্টান-জাতির সৌভাগ্যের কারণ। শোষণযোগ্য কতকগুলি জাতি যে চাই। সমস্ত পৃথিবী খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী হইলে, শিকার স্বরূপ অখ্রীষ্টান জাতির অস্তিত্ব না থাকিলে খ্রীষ্টানজাতিগুলিই দরিদ্র হইয়া যাইবে। সুতরাং এ যুক্তি নিজেকেই খণ্ডন করিয়াছে। উদ্ভিজ্জ পশ্বাদির খাদ্য, মনুষ্য পশ্বাদির ভোক্তা, এবং
সর্বাপেক্ষা গর্হিত ব্যাপার- মনুষ্য পরস্পরের, দুর্বল বলবানের ভক্ষ হইয়া রহিয়াছে। এইরূপ সর্বত্রই বিদ্যমান। ইহাই মায়া।
এ রহস্যের তুমি কী মীমাংসা কর? আমরা প্রত্যহই অভিনব যুক্তি শুনিয়া থাকি। কেহ বলিতেছেন, চরমে কেবল মঙ্গলই থাকিবে। স্বীকার করিয়া লইলাম এরূপ সম্ভব, কিন্তু এইরূপ পৈশাচিক উপায়ে মঙগল উৎপন্ন হইবার কারণ কি? পৈশাচিক রীতি ব্যতীত শুধু মঙ্গলের মধ্য দিয়া কি মঙ্গল সাধিত হয় না? মানবজাতির ভবিষ্যৎ বংশধরগণ সুখী হইবে, কিন্তু এখন কেন এই ভয়ানক দুঃখ যন্ত্রনা! ইহার মীমাংসা নাই। ইহাই মায়া।
এরূপ শোনা যায়, দোষাংশের ক্রমপরিহার ক্রমবিকাশবাদের১ একটি বিশেষত্ব; সংসার হইতে ক্রমাগত এইরূপ দোষভাগ পরিত্যক্ত হইলে অবশেষে কেবল মঙ্গলই থাকিবে। ইহা শুনিতে অতি সুন্দর। এ সংসারে যাহাদের প্রাচুর্য আছে, যাহাদের প্রত্যহ কঠোর যন্ত্রণা সহ্য করিতে হয় না, যাহাদিগকে তথাকথিত ক্রমবিকাশের চক্রে নিষ্পেষিত হইতে হয় না, এরূপ সিদ্ধান্ত তাহাদের দাম্ভিকতা বাড়াইতে পারে। সত্যই ইহা তাহাদের পক্ষে অতিশয় হিতকর ও শান্তিপ্রদ। সাধারণ লোকেরা যন্ত্রনা ভোগ করুক-তাহাদের ক্ষতি কি? সাধারণ লোকেরা মারা যায়-সেজন্য তাহাদের কি? বেশ কথা, কিন্তু এ যুক্তি আগাগোড়া ভ্রমপূর্ণ। প্রথমতঃ তাহারা বিনা প্রমানে স্বীকার করিয়া লয় যে, জগতে অভিব্যক্ত মঙ্গল ও অমঙ্গলের পরিমান নির্দিষ্ট আছে। দ্বিতীয়তঃ ইহা অপেক্ষা দোষাবহ এ কথা স্বীকার করা যে, মঙ্গলের পরিমান ক্রমবর্ধমান, এবং অমঙ্গলের পরিমান নির্দিষ্ট। অতএব এমন সময় উপস্থিত হইবে, যখন অমঙ্গল-ভাগ এইরূপে ক্রমশঃ পরিত্যক্ত হইয়া একেবারে নিঃশেষিত হইবে, তখন কেবল মঙ্গলই থাকিবে। এরূপ বলা অতি সহজ। কিন্তু অমঙ্গল যে ক্রমশঃ কমিতেছে, ইহা কি প্রমান করা যায়? অমঙ্গল কি ক্রমশই বাড়িতেছে না? একজনঅরণ্যবাসী মানুষ, যে মনোবৃত্তি-পরিচালনায় অনভিজ্ঞ-একখানি পুস্তকপাঠেও অসমর্থ,হস্তলিপি কাহাকে বলে তাহা শোনে নাই, আজ তাহাকে ক্ষতবিক্ষত কর, কাল সে সুস্হ হইয়া উঠিবে। শাণিত অস্ত্র তাহার শরীরের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া বাহির করিয়া আনো, তথাপি সে শীঘ্রই
১ Darwin’s Theory of Evolution
আরোগ্যলাভ করিবে; কিন্তু পথ চলিতে একটু আঁচড় লাগিলেই আমরা মরিয়া যাই। শিল্পযন্ত্র দ্রব্যাদি সুলভ করিতেছে, উন্নতি ও ক্রমবিকাশ হইতেছে; কিন্তু একজন ধনী হইবে বলিয়া লক্ষ লোককে নিষ্পেষিত করিতেছে; একজন ধনশালী হইতেছে, একইকালে সহস্র সহস্র ব্যক্তি দরিদ্র হইতে দরিদ্রতর হইতেছে,দলকে দল মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হইতেছে। এইভাবেই চলিয়াছে। পশুমানবের অনুভূতি ইন্দ্রিয়েই আবদ্ধ; যদি সে প্রচুর আহার না পায়,কিংবা যদি তাহার শারীরিক অসুস্থতা ঘটে, সে দুর্দশাগ্রস্ত হয়। ইন্দ্রিয়েই তাহার সুখ-দুঃখের আরম্ভ ও শেষ। যখন এরূপ ব্যক্তির উন্নতি হইতে থাকে, সুখের সীমারেখার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার দুঃখের পরিধিও সমপরিমাণে বর্ধিত হয়। অরণ্যবাসী মানুষ ঈর্ষা জানে না, বিচারালয় জানে না, নিয়মিত কর দিতে জানে না, সমাজকর্তৃক নিন্দিত হইতে জানে না, পৈশাচিক মানব-প্রকৃতি-সম্ভূত যে ভীষণ শাসনযন্ত্র প্রত্যেকটি মানুষের মনের গোপন কথাও জানিয়া লইতে চায়, তাহা দ্বারা সে দিবারাত্র শাসিত হইতে জানে না। সে জানে না-ভ্রান্ত গর্বিত মানুষ কিরূপে পশু অপেক্ষাও সহস্রগুণে পৈশাচিকস্বভাব প্রাপ্ত হয়। এইরূপে আমরা যখনই স্থূল ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকি, আমাদের সুখানুভবের উচ্চতর শক্তির উন্মেষের সহিত দু্ঃখানুভবের শক্তি ও বিকশিত হয়। স্নায়ুমন্ডল সূক্ষ্মতর হইয়া অধিক যন্ত্রনা অনুভব করিতে সমর্থ হয়। শক্তিও বিকশিত হয়। সকল সমাজেই ইহা অহরহঃ দেখা যাইতেছে যে,মূর্খ সাধারণ মানুষ তিরস্কৃত হইলে বেশী দুঃখ অনুভব করে না, কিন্তু প্রহারের আতিশয্য হইলে ক্লিষ্ট হইয়া থাকে। শিক্ষিত ভদ্রলোক কিন্তু একটি কথার তিরস্কারও সহ্য করিতে পারেন না, তাঁহার স্নায়ুমন্ডল এত সূক্ষ্ম হইয়াছে! তাঁহার সুখানুভূতি সহজ হইয়াছে বলিয়া তাঁহার দুঃখও বাড়িয়াছে। দার্শনিক পণ্ডিতগণের-ক্রমবিকাশবাদীদের মত ইহার দ্বারা বিশেষ প্রমাণিত হয় না। আমাদের সুখী হইবার শক্তি যতই বৃদ্ধি পায়, যন্ত্রনাভোগের শক্তি সেই পরিমাণে বর্ধিত হইয়া থাকে। কখন কখন আমার মনে হয়, আমাদের সুখী হইবার শক্তি যদি সমযুক্তান্তর শ্রেণীর১ নিয়মে অগ্রসর হয়, অপর দিকে অসুখী হইবার শক্তি সমগুণিতান্তর শ্রেণীর২ নিয়মে বর্ধিত হইবে। অরণ্যবাসী মানুষ সমাজ সম্বন্ধে বেশী অভিজ্ঞ নহে। কিন্তু উন্নতিশীল আমরা জানি, যতই আমরা উন্নত হইব, ততই আমাদের সুখদুঃখের অনুভবশক্তি তীব্র হইবে। ইহাই মায়া।