কারণ আমি দুঃখ-পীড়িত, সকলেই দুঃখ-পীড়িত হউক-ইহাতেই আমার শান্তি।’ এইরূপে আমরা আশাবাদ হইতে নিরাশাবাদে যাইতেছি। অতঃপর মৃত্যুরূপ ভয়াভহ ব্যাপার-সমগ্র সংসারেই মৃত্যুর মুখে যাইতেছে ; সকলেই মরিতেছে। আমাদিগের উন্নতি, বৃথা আড়ম্বরপূর্ণ কার্যকলাপ, সমাজসংস্কার, বিলাসিতা, ঐশ্বর্য, জ্ঞান-মৃত্যুই সকলের শেষ গতি। একমাত্র ইহাই সুনিশ্চিত। নগরাদি হইতেছে, যইতেছে ; সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন হইতেছে-গ্রহাদি খণ্ড খণ্ড হইয়া ধুলির মতো চূর্ণ হইয়া বিভিন্ন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইতেছে। অনাদি কালই এইরূপ চলিতেছে। ইহার লক্ষ্য কি? মৃত্যুই সকলের লক্ষ্য। মৃত্যু জীবনের লক্ষ্য, সৌন্দর্যের লক্ষ্য, ঐশ্বর্যের লক্ষ্য, শক্তির লক্ষ্য, এমন কি ধর্মেরও লক্ষ্য। সাধু ও পাপি মরিতেছে, রাজা ও ভিক্ষুক মরিতেছে-সকলেই মৃত্যুর পথে ধাবমান। তথাপি জীবনের প্রতি এই বিষম আসক্তি রহিয়াছে। জানি না, কেন আমরা এ জীবনের প্রতি আসক্ত, কেন ইহা পরিত্যাগ করিতে পারি না। ইহাই মায়া।
জননী সন্তানকে সযত্নে লালন করিতেছেন। তাঁহার সমস্ত মন, সমস্ত জীবন ঐ সন্তানের প্রতি আসক্ত। বালক বয়ঃপ্রাপ্ত হইল এবং হয়তো কুচরিত্র ও পশুবৎ হইয়া প্রত্যহ মাতাকে পদাঘাত ও তাড়না করিতে লাগিল। জননী তথাপি পুত্রের প্রতি আসক্ত। যখন তাঁহার বিচারশক্তি জাগরিত হয়, তখন তিনি পুত্রকে স্নেহের আবরনে আবৃত্ত করিয়া রাখেন। তিনি কিন্তু জানেন না, ইহা স্নেহ নহে-এক অজ্ঞেয় শক্তি তা্ঁহার স্নায়ুমণ্ডলী অধিকার করিয়াছে। তিনি ইহা পরিত্যাগ করিতে পারেন না। তিনি যতই চেষ্টা করুন না, এ বন্ধন ছিন্ন করিতে পারেন না। ইহাই মায়া।
আমরা সকলেই কল্পিত সুবর্ণলোমের১ অন্বেষণে ছুটিয়া চলিয়াছি, প্রত্যেকেরই মনে হয়, আমিই ইহা পাইব ; জ্ঞানবান ব্যাক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারেন, এই সুবর্নলোম লাভের সম্ভাবনা তাঁহার হয়তো বিশ লক্ষের মধ্যে এক। তথাপি প্রত্যেকেই উহার জন্য কঠোর চেষ্টা করেন ; ইহাই মায়া।
ইহসংসারে মৃত্যু দিবারাত্র সগর্বে বিচরন করিতেছে ; আমাদের বিশ্বাস-আমরা চিরকাল জীবিত থাকিব। কোন সময়ে রাজা যুধিষ্টিরকে জিজ্ঞাসা করা হয় : এই পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য কি? রাজা উত্তর দিয়াছিলেন, ‘প্রত্যহই চারিদিকে মানুষ মরিতেছে, তথাপি মানুষ মনে করে, সে কখনই মরিবে না।’ ইহাই মায়া।
১ Golden Fleece : গ্রীকপুরানে ইহা Argonautic Expedition নামে খ্যাত।
আমাদের বুদ্ধি জ্ঞান ও জীবনের প্রতি ঘটনার মধ্যে সর্বত্রই এই বিষম বিরুদ্ধভাব রহিয়াছে। একজন সংস্কারক আবির্ভূত হইয়া জাতি-বিশেষের দোষসমূহ প্রতিকার করিবার জন্য যত্নবান্ হইলেন; প্রতিকারের পূর্বেই অপর দিকে অন্য সহস্রপ্রকার দোষ দেখা দিল। এ যেন পতনোন্মুখ অট্টালিকার মতো, এক স্থানে জীর্ণসংস্কার করিতে করিতে অপরদিকে ভাঙন ধরে। ভারতীয় নারীগণের বাধ্যতামূলক বৈধব্য-জনিত দুঃখ প্রতিকারের জন্য আমাদের সংস্কারকগণ প্রচার করিতেছেন। পাশ্চাত্যে বিবাহ না হওয়াই প্রধান দোষ। একস্থানে কুমারীদের সাহায্য করিতে হইবে, তাহারা দু্ঃখ পাইতেছে ; অন্য স্থানে বিধবাদের সাহায্য করিতে হইবে,তাহারা কষ্ট পাইতেছে। দেহের পুরাতন বাতব্যাধির মতো মাথা হইতে তাড়িত হইয়া ইহা শরীরের অন্য স্থান আশ্রয় করিতেছে; আবার সেখান হইতে পাদদেশ আক্রমন করিতেছে। সংস্কারক আসিয়া সাধারনের মধ্যে প্রচার করিলেন-বিদ্যা ধন কৃষি কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিবে না, তাহারা এইগুলি সকলের আয়ত্তের মধ্যে আনিবার চেষ্টা করিলেন। ইহাতে কেহ কেহ এক হিসাবে কতকটা সুখী হইল বটে, কিন্তু জ্ঞানানুশীলন যতই বেশী লাগিল, শারীরিক সুখ ততই হয়তো অন্তর্হিত হইতে লাগিল। এখন সুখের জ্ঞান হইতেই যে দুঃখের জ্ঞান আসিতেছে! কোন পথে যাইব? আমরা যে সামান্য সুখ ভোগ করিতেছি, অন্য কোথাও সেই পরিমান দুঃখ উৎপন্ন হইতেছে। ইহাই নিয়ম। যুবকেরা হয়তো ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু যাঁহারা দীর্ঘদিন জীবিত আছেন, অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন, তাঁহারা ইহা উপলব্ধি করিতে পারিবেন। ইহাই মায়া।
দিবারাত্র এই-সকল ব্যপার ঘটিতেছে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব। এইরূপ হইবার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অসম্ভব। কারণ প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গতভাবে উথ্থাপিতই হইতে পারে না; যাহা ঘটিতেছে তাহার না আছে ‘কেন’, না আছে ‘কি ভাবে’ ; আমরা শুধু জানি ইহা ঘটিতেছে, আমরা
আর কিছুই করিতে পারি না। আমরা ইহাকে এক মুহূর্তও স্থির রাখিতে পারি না-প্রতি মুহূর্তে ইহা আমাদের হাতের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। এ অবস্থায় কি ভাবে আমরা এ সমস্যার সমাধান করিব-আমরা যে কখন কখন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিয়াছি পরোপকারের চেষ্টা করিয়াছি সেইগুলি স্মরন করিয়া ভাবিতে পারি-কেন, ঐ কাজগুলি তো আমরা বুঝিয়া-সুঝিয়া ভাবিয়া-চিন্তিয়া করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা সে গুলি না করিয়া থাকিতে পারি নাই বলিয়াই ঐরূপ করিয়াছিলাম। আমাকে এই স্থানে দাঁড়াইয়া বক্তৃ্তা দিতে হইতেছে আর আপনাদিগকে বসিয়া উহা শ্রবন করিতে হইতেছে-ইহাও আমরা না করিয়া থাকিতে পারি না বলিয়াই করিতেছি। আপনারা গৃহে ফিরিয়া যইবেন, হয়তো কেহ ইহা হইতে যৎসামান্য শিক্ষালাভ করিবেন, অপরে হয়তো মনে করিবেন লোকটা অনর্থক বকিতেছে। আমি বাড়ি যাইয়া ভাবিব, আমি বক্তৃতা দিয়াছি। ইহাই মায়া।