ওল্ড টেস্টামেন্টের নিষ্ঠুর জিহোভার বর্ণনায় অনেকে ভীত হয়; কিন্তু কেন? লোকের এরূপ কল্পনা করিবার কি অধিকার আছে যে, প্রাচীন য়াহুদীদিগের জিহোভা আজকালকার ঈশ্বরের মতো হইবেন? আবার আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, আমরা যে ভাবে প্রাচীনদের ধর্ম বা ঈশ্বরের ধারণায় হাসিয়া থাকি, আমাদের পরে যাঁহারা আসিবেন তাঁহারা আমাদের ধর্ম বা ঈশ্বরের ধারণাগুলিকেও সেইভাবে উপহাস করিবেন। তাহা হইলেও এই-সকল বিভিন্ন ঈশ্বর-ধারণার মধ্যে সংযোগসাধক একটি সুবর্ণ-সূত্র বিদ্যমান, আর বেদান্তের উদ্দেশ্য—সেই সূত্র আবিষ্কার করা। শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন—‘ভিন্ন ভিন্ন মণি যেমন এ সূত্রে গ্রথিত, সেইরূপ এই-সকল বিভিন্ন ভাবের ভিতরেও একটি সূত্র রহিয়াছে।’ আর আধুনিক ধারণানুসারে সেগুলি যতই বীভৎস ভয়ানক বা ঘৃণিত বলিয়া মনে হউক না কেন, বেদান্তের কর্তব্য—ঐ-সকল ধারণা ও বর্তমান ধারণাগুলির ভিতর এই যোগসূত্র আবিষ্কার করা। অতীতকালের পটভূমিকায় সেগুলি বেশ সঙ্গতই ছিল, আমাদের বর্তমান ভাব ও ধারণা হইতে সেগুলি বেশী বীভৎস ছিল না। যখন আমরা প্রাচীন পরিবেশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সেই ভাবগুলিকে দেখিতে যাই ,তখনই শুধু ঐগুলির বীভৎসতা প্রকাশ হইয়া পড়ে। প্রাচীন পরিবেশ এখন তো আর নাই। যেমন প্রাচীন য়াহুদী বর্তমান তীক্ষ্মবুদ্ধি য়াহুদীতে পরিণত হইয়াছেন, যেমন প্রাচীন আর্যেরা আধুনিক বুদ্ধিমান্ হিন্দুতে পরিণত হইয়াছেন, সেইরূপ জিহোভার ক্রমোন্নতি হইয়াছে, দেবতাদেরও হইয়াছে। আমরা এইটুকু ভুল করি যে, আমরা উপাসকের ক্রমোন্নতি স্বীকার করিয়া থাকি, কিন্তু উপাস্যের ক্রমোন্নতি স্বীকার করি না। উন্নতির জন্য উপাসকদিগকে আমরা যেটুকু প্রশংসা করি , উপাস্য ঈশ্বরকে সেটুকু করি না । কথাটা এই—তুমি আমি যেমন কোন বিশেষ ভাবের প্রকাশক বলিয়া ঐ ভাবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তোমার আমার উন্নতি হইয়াছে, সেইরূপ দেবতারাও বিশেষ বিশেষ ভাবের দ্যোতক বলিয়া ভাবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদেরও উন্নতি হইয়াছে। তোমাদের আশ্চর্য বোধ হইতে পারে যে , দেবতা বা ঈশ্বরের ও উন্নতি হয়! তোমাদের ভাব—ঈশ্বরের উন্নতি হয় না, তিনি অপরিবর্তনীয়। এইভাবে তো ইহাও বলা যায় যে, প্রকৃত মানুষেরও কখন উন্নতি হয় না। আমরা পরে দেখিব—এই মানুষের ভিতর যে প্রকৃত মানুষ রহিয়াছেন, তিনি অচল অপরিণামী শুদ্ধ ও নিত্যমুক্ত। যেমন এই মানুষ সেই প্রকৃত মানুষের ছায়ামাত্র, সেইরূপ আমাদের ঈশ্বর-ধারণা আমাদের মনেরই সৃষ্টি; উহা সেই প্রকৃত ঈশ্বরের আংশিক প্রকাশ- আভাসমাত্র। ঐ-সকল আংশিক প্রকাশের পশ্চাতে প্রকৃত ঈশ্বর রহিয়াছেন, তিনি নিত্য-শুদ্ধ অপরিণামী। কিন্তু ঐ সকল আংশিক প্রকাশ সর্বদাই পরিণামশীল—ঐগুলি উহাদের অন্তরালে অবস্থিত সত্যের ক্রমাভিব্যক্তি মাত্র; সেই সত্য যখন অধিক পরিমানে প্রকাশিত হয়, তখন উহাকে উন্নতি, আর উহার অধিকাংশ আবৃত থাকিলে তাহাকে অবনতি বলে। এইরূপে যেমন আমাদের উন্নতি হয় , তেমনি দেবতারও উন্নতি হয়। সাধারণ সোজাভাবে বলিতে গেলে বলিতে হয়, যেমন আমাদের উন্নতি হয় , আমাদের স্বরুপের যেমন প্রকাশ হয়, তেমনি দেবগণও তাঁহাদের স্বরূপ প্রকাশ করিতে থাকেন।
——————-
১ গীতা, ৭।৭
——————
এখন আমরা মায়াবাদ বুঝিতে সমর্থ হইব। পৃথিবীর সকল ধর্মই এক প্রশ্ন করিয়াছেন : জগতে এই অসামঞ্জস্য কেন? এই অশুভ কেন? আমরা ধর্মভাবের প্রথম আরম্ভের সময় এই প্রশ্ন দেখিতে পাই না; তাহার কারণ—আদিম মনুষ্যের পক্ষে জগৎ অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোধ হয় নাই। তাহার চতুর্দিকে কোন অসামঞ্জস্য ছিল না, কোন প্রকার মতবিরোধ ছিল না, ভালমন্দের কোন প্রতিদ্বন্দিতা ছিল না। কেবল তাহার হৃদয়ে দুইটি জিনিসের সংগ্রাম হইত। একটি বলিত—‘এই কাজ কর’ আর এক বলিত -‘করিও না।’ আদিম মানুষ আবেগপ্রবণ ছিল। তাহার মনে যাহা উদিত হইত, সে তাহাই করিত। সে নিজের এই ভাব সম্বন্ধে বিচার করিবার বা উহা সংযত করিবার চেষ্টা মোটেই করিত না। এই-সকল দেবতা সম্বন্ধেও সেইরূপ; ইহারাও আবেগের অধীন। ইন্দ্র আসিলেন, আর দৈত্যবল ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া দিলেন জিহোভা কাহারও প্রতি সন্তুষ্ট, কাহারও প্রতি বা রুষ্ট; কেন—তাহা কেহ জানে না, জিজ্ঞাসাও করে না। ইহার কারণ, মানুষের তখনও অনুসন্ধানের অভ্যাসই হয় নাই; সুতরাং সে যাহা করে, তাহাই ভাল। তখন ভালমন্দের কোন ধারনাই হয় নাই। আমরা যাহাকে মন্দ বলি, দেবতারা এমন অনেক কাজ করিতেছেন; বেদে দেখিতে পাই—ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা অনেক মন্দ কাজ করিতেছেন, কিন্তু ইন্দ্রের উপাসকদিগের দৃষ্টিতে সেগুলি পাপ বা অসৎ বলিয়া মনেই হইত না, সুতরাং তাহারা সে সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই করিত না।
নৈতিক ভাবের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে এক যুদ্ধ বাধিল ; মানুষের ভিতরে যেন একটি নূতন ইন্দ্রিয়ের আবির্ভাব হইল। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ভিন্ন জাতি উহাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করিয়াছে; কেহ বলেন, উহা ঈশ্বরের বাণী; কেহ বলেন—উহা পূর্বশিক্ষার ফল। যাহা হউক, উহা প্রবৃত্তির দমনকারী শক্তিরূপে কার্য করিয়াছিল। আমাদের মনের একটি প্রবৃত্তি বলে—এই কাজ কর’ আর এক বলে—‘করিও না।’ আমাদের ভিতরে কতকগুলি প্রবৃত্তি আছে, সেগুলি ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া বাহিরে যাইবার চেষ্টা করিতেছে; আর তাহার পশ্চাতে, যতই ক্ষীণ হউক না কেন, আর একটি স্বর বলিতেছে—‘বাহিরে যাইও না’। এই দুইটি ব্যাপার দুইটি সুন্দর সংস্কৃত শব্দে ব্যক্ত হইয়াছে—প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। প্রবৃত্তিই আমাদের সকল কর্মের মূল। নিবৃত্তি হইতেই ধর্মের উদ্ভব। ধর্ম আরাম্ভ হয় এই ‘করিও না’ হইতে ; আধ্যাত্মিকতাও ঐ ‘করিও না’ হইতেই আরম্ভ হয়। যেখানে এই ‘করিও না’ নাই, সেখানে ধর্মের আরম্ভই হয় নাই, বুঝিতে হইবে। যুধ্যমান দেবতার উপাসনা সত্ত্বেও এই ‘করিও না’ বা নিবৃত্তির ভাবের জন্য মানুষের ধারণা উন্নত হইতে লাগিল।