তাঁহাদের সহিত যতই তর্ক কর না কেন, তাঁহারা তোমার কথায় শুধু হাসিবেন, তাঁহারা উহা শিশুর আবোল-তাবোল বলিয়া মনে করিবেন। শিশুর আধ-আধ কথায় তাঁহারা বাধা দেন না। তাঁহারা সত্য উপলব্ধি করিয়া ‘ভরপুর’ হইয়া আছেন। মনে কর তুমি একটি দেশ দেখিয়া আসিয়াছ, আর আর একজন ব্যক্তি তোমার নিকট আসিয়া তর্ক করিতে লাগিল—ঐ দেশের কখন অস্তিত্ব ছিল না; এইভাবে সে ক্রমাগত তর্ক করিয়া যাইতে পারে, কিন্তু তাহার প্রতি তোমার এই মনোভাব হইবে যে, এই ব্যক্তি উন্মাদাগারে যাইবারই উপযুক্ত। এইরূপ যিনি ধর্মের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, তিনি বলেন ‘জগতে ধর্ম সম্বন্ধে যে-সকল কথা শুনা যায়, সে-সকল কেবল শিশুর আধ আধ কথামাত্র। প্রত্যক্ষানভূতিই ধর্মের সার কথা।’ ধর্ম উপলব্ধি করা যাইতে পারে। প্রশ্ন এই, তুমি কি উহার জন্য প্রস্তুত হইয়াছ? তুমি কি ধর্ম উপলব্ধি করিতে চাও? যদি তুমি ঠিক ঠিক চেষ্টা কর, তবে তোমার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হইবে, তখনই তুমি প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক হইবে। যতদিন না তোমার এই উপলব্ধি হইতেছে, ততদিন তোমাতে এবং নাস্তিকে কোন প্রভেদ নাই। নাস্তিকেরা তবু অকপট, কিন্তু যে বলে, ‘আমি ধর্ম বিশ্বাস করি’, অথচ কখন উহা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করে না, সে অকপট নহে।
পরবর্তী প্রশ্ন এই যে—উপলব্ধির পরে কি হয়? মনে কর উপলব্ধি করিলাম—আমরা জগতের এক অখণ্ড সত্তা, আমরাই যে সেই একমাত্র অনন্ত পুরুষ; মনে কর, আমরা জানিতে পারিলাম—আত্মাই একমাত্র আছেন, আর তিনি বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পাইতেছেন; এইরূপ জানিতে পারিলে আমাদের কি হইবে? তাহা হইলে আমরা কি এক কোণে নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া মরিয়া যাইব? ইহা দ্বারা জগতের কি উপকার হইবে? আবার সেই পুরাতন প্রশ্ন! প্রথমতঃ জিজ্ঞাসা করি, উহা দ্বারা জগতের উপকার হইবে কেন? ইহার কি কোন যুক্তি আছে? লোকের এই প্রশ্ন করিবার কি অধিকার আছে,-ইহাতে কি জগতের উপকার হইবে? ইহার অর্থ কি? ছোট ছেলে মিষ্টান্ন ভালবাসে। মনে কর, তুমি তড়িতের বিষয়ে কিছু গবেষনা করিতেছ; শিশু তোমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ইহাতে কি মিষ্টি কেনা যায়?’ তুমি বলিলে, ‘না’। ‘তবে ইহাতে কি উপকার হইবে?’ তত্ত্বজ্ঞানের আলোচনায় ব্যাপৃত দেখিলেও লোকে এইরূপ জিজ্ঞাসা করিয়া বসে, ‘ইহাতে জগতের কি উপকার হইবে? ইহাতে কি আমাদের টাকা হইবে?’ ‘না।’ ‘তবে ইহাতে আর উপকার কি?’ জগতের হিত করা অর্থে মানুষ এইরূপই বুঝিয়া থাকে। তথাপি ধর্মের এই প্রত্যক্ষানুভূতিই জগতের যথার্থ উপকার করিয়া থাকে। লোকের ভয় হয়, যখন সে এই অবস্থা লাভ করিবে, যখন সে উপলব্ধি করিবে—সবই এক, তখন তাহার প্রেমের প্রস্রবণ শুকাইয়া যাইবে; জীবনের যাহা কিছু মূল্যবান্ সব চলিয়া যাইবে ; ইহজীবনে ও পরজীবনে তাহাদের ভালোবাসার আর কিছুই থাকিবে না। কিন্তু লোকে একবার ভাবিয়া দেখে না যে, যে-সকল ব্যক্তি নিজ সুখচিন্তায় একরূপ উদাসীন, তাঁহারাই জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী হইয়াছেন। তখনই মানুষ যথার্থ ভালোবাসে, যখন সে দেখিতে পায়- তাহার ভালোবাসার জিনিস কোন ক্ষুদ্র মর্ত্য জীব নহে। তখনই মানুষ যথার্থ ভালোবাসিতে পারে, যখন সে দেখিতে পাই—তাহার ভালোবাসার পাত্র খানিকটা মৃত্তিকাখণ্ড নহে, তাহার প্রেমাস্পদ স্বয়ং ভগবান। স্ত্রী যদি ভাবেন –স্বামী সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ। তবে তিনি স্বামীকে আরও অধিক ভালোবাসিবেন। স্বামীও স্ত্রীকে অধিক ভালোবাসিবেন,যদি তিনি জানিতে পারেন -স্ত্রী স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ। সেইরূপ মাতাও সন্তানগণকে বেশী ভালোবাসিবেন, যিনি সন্তানগণকে ব্রহ্মস্বরূপ দেখেন। যিনি জানেন-ঐ শত্রু সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ, তিনি তাহার মহাশত্রুকেও ভালোবাসিবেন।যিনি জানেন-সাধু সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপ, তিনি সাধুকেও ভালোবাসিবেন। সেই লোকই আবার অতিশয় অসাধু ব্যক্তিকেও ভালোবাসিসেন, যদি তিনি জানেন- অসাধুতম পুরুষেরও পশ্চাতে সেই প্রভু রহিয়াছেন। যাঁহার জীবনে এই ক্ষুদ্র ‘অহং’ একবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে এবং ঈশ্বর সেই স্থান অধিকার করিয়া বসিছেন, সেই ব্যক্তি পৃথিবীকে নাড়া দিয়া যান। তাঁহার নিকট সমুদয় জগৎ সম্পূর্ণ অন্যভাবে প্রতিভাত হয়। দুঃখকর ক্লেশকর যাহা কিছু, সবই চলিয়া যায়; সকল প্রকার গোলমাল দ্বন্দ্ব মিটিয়া যায়। যেখানে আমরা প্রতিদিন একটুকরো রুটির জন্য ঝগড়া-মারামারি করি- সেই জগৎ তখন তাহার পক্ষে কারাগার না হইয়া ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিণত হইবে। তখন জগৎ কি সুন্দর ভাবই না ধারণ করিবে! এইরূপ ব্যক্তিরই কেবল বলিবার অধিকার আছে—‘এই জগৎ কি সুন্দর !’ তিনিই কেবল বলিতে পরেন যে সবই মঙ্গল-
স্বরূপ। এইরূপ প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হইতে জগতের এই মহৎ কল্যাণ হইবে যে, সকল বিবাদ গণ্ডগোল দূর হইয়া পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপিত হইবে। যদি সকল মানুষ আজ এই মহান্ সত্যের এক বিন্দুও উপলব্ধি করিতে পারে, তাহা হইলে সারা পৃথিবী আর এক রূপ ধারণ করিবে; অন্যায়ভাবে তাড়াতাড়ি করিয়া সকলকে অতিক্রম করিবার প্রবৃত্তি জগৎ হইতে চলিয়া যাইবে; উহার সঙ্গে সঙ্গেই সকল প্রকার অশান্তি, সকল প্রকার ঘৃণা, সকল প্রকার ঈর্ষা এবং সকল প্রকার অশুভ চিরকালের জন্য চলিয়া যাইবে। তখন দেবতারা এই জগতে বাস করিবেন, তখন এই জগৎই স্বর্গ হইয়া যাইবে।আর যখন দেবতায় দেবতায় খেলা, যখন দেবতায় দেবতায় কাজ, যখন দেবতায় দেবতায় প্রেম, তখন কি আর অশুভ থাকিতে পারে? ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির এই মহা সুফল। সমাজে তোমরা যাহা কিছু দেখিতেছ, সবই তখন পরিবর্তিত হইয়া অন্যরূপ ধারণ করিবে। তখন তোমরা মানুষকে আর খারাপ বলিয়া দেখিবেনা; ইহাই প্রথম মহালাভ। তখন তোমরা আর কোন অন্যায়কারী দরিদ্র নরনারীর দিকে ঘৃণার সহিত দৃষ্টিপাত করিবে না। হে মহিলাগন, যে-দুঃখিনী নারী রাত্রিতে পথে ভ্রমন করিয়া বেড়ায়, আপনারা আর তাহার দিকে ঘৃণাপূর্বক দৃষ্টিপাত করিবেন না; কারণ আপনারা সেখানেও সাক্ষাৎ ঈশ্বরকে দেখিবেন। তখন আপনাদের মনে আর ঈর্ষা বা অপরকে শাস্তি দিবার ভাব উদিত হইবে না; ঐ-সবই চলিয়া যাইবে। তখন প্রেম এত প্রবল হইবে যে, মাবজাতিকে সৎপথে পরিচালিত করিতে আর চাবুকের প্রয়োজন হইবে না।