তখন এই জগৎ আর সেই পূর্বের জগৎ থাকিবে না। তবে এইরূপ জ্ঞান-সাধনে একটি বিপদের আশঙ্কা আছে। আমরা দেখিতে পাই, প্রতি দেশেই লোকে এই বেদান্তদর্শনের মত গ্রহণ করিয়া বলে, ‘আমি ধর্মাধর্মের অতীত, আমি বিধিনিষেধের অতীত, সুতরাং আমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারি।’ এই দেশেই দেখিবে, অনেক নির্বোধ ব্যক্তি বলিয়া থাকে, ‘আমি বদ্ধ নহি, আমি সয়ং ঈশ্বরস্বরূপ; আমি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিব।’ ইহা ঠিক নহে, যদিও ইহা সত্য যে, আত্মা শারীরিক মানসিক বা নৈতিক—সর্বপ্রকার নিয়মের অতীত। ইহা সত্য যে, নিয়মের মধ্যেই বন্ধন, নিয়মের বাহিরে মুক্তি। ইহাও সত্য যে, মুক্তি আত্মার জন্মগত স্বভাব, উহা তাহার জন্মপ্রাপ্ত স্বত্ব, আর আত্মার যথার্থ মুক্তস্বভাব জড়ের আবরণের মধ্য দিয়া মানুষের আপাত প্রতীয়মান মুক্তস্বভাবরূপে প্রতীত হইতেছে। তোমার জীবনের প্রতি মুহূর্তই তুমি নিজেকে মুক্ত বলিয়া অনুভব করিতেছ। আমরা নিজেকে মুক্ত অনুভব না করিয়া এক মুহূর্তও বাঁচিয়া থাকিতে পারি না, কথা কহিতে পারি না, কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসও ফেলিতে পারি না। কিন্তু আবার অল্প চিন্তায় ইহাও প্রমাণিত হয় যে, আমরা যন্ত্রের মতো, আমরা মুক্ত নহি। তবে কোন্টি সত্য? এই যে ‘আমি মুক্ত’—এই ধারণাটিই কি ভ্রমাত্মক! একদল বলেন ‘আমি মুক্ত-স্বভাব’ এই ধারণা ভ্রমাত্মক, আবার অপর দল বলেন-‘আমি বদ্ধভাবাপন্ন’ এই
ধারণাই ভ্রমাত্মক। ইহা কিভাবে সম্ভব? মানুষ প্রকৃতপক্ষে মুক্ত। মানুষ পরমার্থতঃ মুক্ত ব্যতীত আর কিছুই হইতে পারে না; কিন্তু যখনই তিনি মায়ার জগতে আসেন, যখনই তিনি নাম-রূপের মধ্যে পড়েন, তখনই তিনি বদ্ধ হইয়া যান। ‘স্বাধীন ইচ্ছা’—কথাটিই ভুল। ইচ্ছা কখনও স্বাধীন হইতেই পারে না। কি করিয়া হইবে? প্রকৃত মানুষ যখন বদ্ধ হইয়া যান, তখনই তাঁহার ইচ্ছার উদ্ভব হয়, তাহার পূর্বে নহে। মানুষের ইচ্ছা বদ্ধভাবাপন্ন, কিন্তু উহার মূল অধিষ্ঠান নিত্যকালের জন্য মুক্ত। সুতরাং বন্ধনের অবস্থাতেও এই মনুষ্যজীবনেই হউক, দেবজীবনেই হউক, স্বর্গে অবস্থানকালেই হউক, আর মর্ত্যে অবস্থানকালেই হউক, আমাদের বিধিদত্ত অধিকারস্বরূপ এই মুক্তির স্মৃতি থাকিয়া যায়। আর জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা সকলেই সেই মুক্তির দিকেই চলিয়াছি। যখন মানুষ মুক্তিলাভ করে, তখন আর সে নিয়মের দ্বারা কিরূপে বদ্ধ হইতে পারে? জগতের কোন নিয়মই তাহাকে বদ্ধ করিতে পারে না। কারন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই যে তাহার।
মানুষ তখন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। হয় বলো—তিনিই সমুদয় জগৎ, না হয় বলো—তাঁহার পক্ষে জগতের অস্তিত্বই নাই। তবে তাঁহার স্ত্রী-পুরুষবোধ, দেশবিদেশ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাব কিরূপে থাকিবে? তিনি কিরূপে বলিবেন—আমি পুরুষ, আমি স্ত্রী অথবা আমি বালক? এগুলি কি মিথ্যা কথা নহে? তিনি জানিয়াছেন—এ-সব মিথ্যা। তখন তিনি এইগুলি পুরুষের অধিকার, এইগুলি নারীর অধিকার—একথা কিরূপে বলিবেন? কাহারও কিছুই অধিকার নাই, কাহারও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই। পুরুষ নাই, স্ত্রীও নাই; আত্মা লিঙ্গহীন, নিত্যশুদ্ধ। আমি পুরুষ বা স্ত্রী, অথবা আমি অমুক-দেশবাসী—এরূপ বলা মিথ্যা কথা মাত্র। সারা পৃথিবী আমার দেশ, সমুদয় জগৎই আমার; কারন ইহারই দ্বারা আমি নিজেকে আবৃত্ত করিয়াছি, জগৎই আমার শরীর হইয়াছে। কিন্তু আমরা দেখিতেছি—অনেক লোকে বিচারের সময় এইসব কথা বলিয়া কার্যের সময় অপবিত্র কার্য করিয়া বেড়ায়; আর যদি আমরা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেন তোমরা এইরূপ করিতেছ?’ তাহারা উত্তর দিবে, ‘এ তোমাদের বুঝিবার ভ্রম। আমাদের দ্বারা কোন অন্যায় কার্য হওয়া অসম্ভব।’ এই সকল লোককে পরীক্ষা করিবার উপায় কি? উপায় এই- যদিও ভালো-মন্দ উভয়ই আত্মার খণ্ড প্রকাশমাত্র, তথাপি অসৎ-ভাব আত্মার বাহ্য আবরণ, আর সৎ-ভাব মানুষের প্রকৃত স্বরূপ যে আত্মা—তাঁহার অপেক্ষাকৃত নিকটতর আবরণ। যতদিন না মানুষ ‘অসৎ’-এর স্তর ভেদ করিতে পারিতেছে, ততদিন সৎ-এর স্তরে পৌঁছিতেই পারিবে না; আর যতদিন না মানুষ সদসৎ উভয় স্তর ভেদ করিতে পারিতেছে, ততদিন আত্মার নিকট পৌঁছিতেই পারিবে না । আত্মার নিকট পৌঁছিলে আর কি অবশিষ্ট থাকে? অতি সামান্য কর্ম, অতীত জীবনের কার্যের অতি সামান্য বেগই অবশিষ্ট থাকে, কিন্তু এ বেগ শুভকর্মেরই বেগ। যতদিন না অসৎ কর্মের গতিবেগ একে বারে রহিত হইয়া যাইতেছে,যতদিন না পূর্বের অপবিত্রতা একেবারে দগ্ধ হইয়া যাইতেছে, ততদিন কোন ব্যক্তির পক্ষে সত্যকে প্রত্যক্ষ এবং উপলবব্ধি করা অসম্ভব। সুতরাং যিনি আত্মার নিকট পৌঁছিয়াছেন, যিনি সত্য কে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহার কেবল অতীত-জীবনের শুভ সংস্কার, শুভ বেগগুলি অবশিষ্ট থাকে। শরীরে বাস করিলেও এবং অনবরত কর্ম করিলেও তিনি কেবল সৎ কর্ম করেন; তাঁহার মুখ সকলের প্রতি কেবল আশীর্বাদ বর্ষণ করে, তাঁহার হস্ত কেবল সৎকার্যই করিয়া থাকে, তাঁহার মন কেবল সৎ চিন্তা করিতেই সমর্থ, তাঁহার উপস্থিতিই—তিনি যেখানেই যান না কেন—সর্বত্র মানবজাতির মহাকল্যাণকর। এরূপ ব্যক্তির দ্বারা কোন অসৎকর্ম কি সম্ভব? তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত ‘প্রত্যক্ষানুভূতি’ এবং ‘শুধু মুখে বলা’র মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। অজ্ঞান ব্যক্তিও নানা জ্ঞানের কথা বলিয়া থাকে। তোতাপাখিও ঐরূপ বকিয়া থাকে। মুখে বলা এক, উপলব্ধি আর এক। দর্শণ-মতামত-বিচার, শাস্ত্র-মন্দির-সম্প্রদায় প্রভৃতি কিছুই মন্দ নয়, কিন্তু এই প্রত্যক্ষানুভূতি হইলে ও-সব আর থাকে না। মানচিত্র অবশ্য উপকারী, কিন্তু মানচিত্রে অঙ্কিত দেশ প্রত্যক্ষ করিয়া আসিয়া তারপর আবার সেই মানচিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত কর, তখন দেখিতে পাইবে কত প্রভেদ ! সুতরাং যাঁহারা সত্য উপলব্ধি করিয়াছেন, তাঁহাদিগকে আর উহা বুঝিবার জন্য যুক্তিতর্ক প্রভৃতি মানসিক ব্যায়ামের আশ্রয় লইতে হয় না।উহা তাঁহাদের মর্মে মর্মে প্রবিষ্ট হইয়াছে-উহা তাঁহাদার জীবনের জীবন। বেদান্তবাদীদের ভাষায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, উহা যেন তাহার ‘করামলকবৎ’ হইয়াছে। প্রত্যক্ষ উপলব্ধিকারীরা অসঙ্কোচে বলিতে পারেন, ‘এই যে, আত্মা রহিয়াছে’। তুমি