দেখেন, তাঁহার পক্ষে গতি ও চঞ্চলতা কোথায় চলিয়া যায়! সর্পে রজ্জুভ্রম হইল। যে ব্যক্তি রজ্জুতে সর্প দেখিতেছে, তাহার পক্ষে রজ্জু কোথায় চলিয়া যায়, আর ভ্রান্তি দূর হইলে সে ব্যক্তি রজ্জুই দেখিতে থাকে, তখন তাঁহার পক্ষে সর্প আর থাকে না।
তাহা হইলে দেখা গেল, একটিমাত্র বস্তুই আছে—তাহাই নানারূপে প্রতীয়মান হইতেছে। ইহাকে আত্মাই বলো আর বস্তুই বলো বা অন্য কিছুই বলো, জগতে কেবল একমাত্র ইহারই অস্তিত্ব আছে। অদ্বৈতবাদের ভাষায় বলিতে গেলে এই আত্মাই ব্রহ্ম, কেবল নামরূপ-উপাধিবশতঃ ‘বহু’ প্রতীত হইতেছে। সমুদ্রের তরঙ্গগুলির দিকে দৃষ্টিপাত কর একটি তরঙ্গও সমুদ্র হইতে পৃথক্ নহে! তবে তরঙ্গকে পৃথক্ দেখইতেছে কেন? নাম ও রূপ-তরঙ্গের আকৃতি রূপ, আর আমরা উহাকে ‘তরঙ্গ’ এই যে নাম দিয়াছি, এই নাম-রূপই তরঙ্গকে সমুদ্র হইতে পৃথক্ করিয়াছে। নাম-রূপ চলিয়া গেলেই তরঙ্গ যে সমুদ্র ছিল, সেই সমুদ্রই হইয়া যায়। তরঙ্গ ও সমুদ্রের মধ্যে কে প্রভেদ করিতে পারে? অতএব এই সমগ্র জগৎ এক সত্তা। নাম-রূপই যত পার্থক্য রচনা করিয়াছে। যেমন সূর্য লক্ষ লক্ষ জলকনার উপরে প্রতিবিম্ব হইয়া প্রত্যেক জলকনার উপরেই সূর্যের একটি পূর্ণ প্রতিকৃতি সৃষ্টি করে, তেমনি সেই এক আত্মা, সেই এক সত্তা অসংখ্য নাম-রূপের বিন্দুতে প্রতিবিম্বিত হইয়া নানারূপে উপলব্ধ হইতেছেন। কিন্তু স্বরূপতঃ উহা এক। বাস্তবিক ‘আমি’ বা ‘তুমি’ বলিয়া কিছুই নাই—সবই এক। হয় বলো—সবই আমি, না হয় বলো—সবই তুমি। দ্বৈতজ্ঞান সম্পূর্ণ মিথ্যা, আর সমুদয় জগৎ এই দ্বৈতজ্ঞানের ফল। বিচারজ্ঞানের উদয় হইলে মানুষ দেখিতে পায় দুইটি বস্তু নাই, একটি বস্তুই আছে, তখন তাহার উপলব্ধি হয়—সে নিজেই এই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। আমি এই পরিবর্তণশীল জগৎ, আমিই আবার অপরিণামী, নির্গুন নিত্যপূর্ণ নিত্যানন্দময়।
অতএব নিত্যশুদ্ধ নিত্যপূর্ণ অপরিণামী অপরিবর্তনীয় এক আত্মা আছেন; তাঁহার কখন পরিণাম হয় নাই, আর এই সকল বিভিন্ন পরিণাম সেই একমাত্র আত্মাতে শুধু প্রতীত হইতেছে। উহার উপরে নাম-রূপ এই-সকল বিভিন্ন স্বপ্নচিত্র অঙ্কন করিয়াছে। রূপ বা আকৃতিই তরঙ্গকে সমুদ্র হইতে পৃথক্ করিয়াছে। মনে কর, তরঙ্গটি মিলাইয়া গেল, তখন কি ঐ আকৃতি থাকিবে? উহা একেবারে চলিয়া যইবে। তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে সাগরের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে; কিন্তু সাগরের অস্তিত্ব তরঙ্গের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে না। যতক্ষন তরঙ্গ থাকে ততক্ষন রূপ থাকে ; কিন্তু তরঙ্গ নিবৃত্ত হইলে ঐ রূপ আর থাকিতে পারে না। এই ‘নাম-রূপকে’ই মায়া বলে। এই মায়াই ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি সৃষ্টি করিয়া একজনকে আর একজন হইতে পৃথক্ মনে করাইতেছে। কিন্তু ইহার অস্তিত্ব নাই। মায়ার অস্তিত্ব আছে, বলা যাইতে পারে না। ‘রূপে’র বা আকৃতির অস্তিত্ব আছে, বলা যাইতে পারে না, কারণ উহা অপরের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে। আবার উহা নাই, একথাও বলা যায় না, কারণ উহাই এই-সকল ভেদ করিয়াছে। অদ্বৈতবাদীর মতে এই মায়া বা অজ্ঞান বা নাম-রূপ—ইওরোপীয়গণের মতে দেশকাল নিমিত্ত—সেই এক অনন্ত সত্তা হইতে এই বিভিন্নরূপ জগৎসত্তা দেখাইতেছে, পরমার্থতঃ এই জগৎ এক অখণ্ড-স্বরূপ। যতদিন পর্যন্ত কেহ দুইটি বস্তুর কল্পনা করেন ততদিন তিনি ভ্রান্ত। যখন তিনি জানিতে পারেন—একমাত্র সত্তা আছে, তখনই তিনি ঠিক ঠিক জানিয়াছেন। যতই দিন যাইতেছে, ততই আমাদের নিকট এই সত্য প্রমাণিত হইতেছে—কি জড় জগতে, কি মনোজগতে, কি আধ্যাত্মিক জগতে, সর্বত্রই এই সত্য প্রমাণিত হইতেছে। এখন প্রমান হইয়াছে যে তুমি আমি, সূর্য চন্দ্র তারা-এ-সবই এক জড়সমুদ্রের বিভিন্ন অংশের নামমাত্র। এই জড়রাশি ক্রমাগত পরিণামপ্রাপ্ত হইতেছে। যা শক্তিকনা কয়েক মাস পূর্বে সূর্যে ছিল, তাহা আজ হয়তো মনুষ্যের ভিতর আসিয়াছে, কাল হয়তো উহা পশুর ভিতরে, আবার পরশু হয়তো কোন উদ্ভিদে প্রবেশ করিবে। সর্বদাই আসিতেছে, সর্বদা যাইতেছে। উহা একমাত্র অখণ্ড জড়রাশি-কেবল নাম-রূপে পৃথক্। উহার এক বিন্দুর নাম সূর্য, এক বিন্দুর নাম চন্দ্র, এক বিন্দু তারা,এক বিন্দু মানুষ, এক বিন্দু পশু, এক বিন্দু উদ্ভিদ এইরূপ। আর এই যে বিভিন্ন নাম, ইহা ভ্রমাত্মক; কারণ এই জড় রাশির ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটিতেছে। এই জগৎকেই আর একভাবে দেখিলে চিন্তাসমুদ্ররূপে প্রতীয়মান হইবে, উহার এক-একটি বিন্দু এক-একটি মন ; তুমি একটি মন, আমি একটি মন, প্রত্যেকেই এক-একটি মনমাত্র। আবার এই জগৎকে জ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখিলে, অর্থাৎ যখন চক্ষু হইতে মোহাবরণ অপসারিত হয়, যখন মন শুদ্ধ হইয়া যায়, তখন উহাকে নিত্যশুদ্ধ অপরিনামী অবিনাশী অখণ্ড পূর্ণস্বরূপ পুরুষ বলিয়া প্রতীতি হইবে।
তবে দ্বৈতবাদীর পরলোকবাদ—মানুষ মরিলে স্বর্গে যায়, অথবা অমুক অমুক লোকে যায়, অসৎলোকে ভূত হয়, পরে পশু হয়—এ-সব কথার কি হইল? অদ্বৈতবাদী বলেন—কেহ আসেও না, কেহ যায়ও না—তোমার পক্ষে যাওয়া-আসা কিসে সম্ভব? তুমি অনন্তস্বরূপ, তোমার পক্ষে যাইবার স্থান আর কোথায়?
কোন বিদ্যালয়ে কতকগুলি ছোট ছোট বালক-বালিকার পরীক্ষা হইতেছিল। পরীক্ষক ঐ ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে নানারূপ কঠিন প্রশ্ন করিতেছিলেন। অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে এই প্রশ্নটিও ছিল-পৃথিবী পড়িয়া যায় না কেন? অনেকেই প্রশ্নটি বুঝিতে পারে নাই, সুতরাং যাহার যাহা মনে আসিতে লাগিল, সে সেইরূপ উত্তর দিতে লাগিল। একটি বুদ্ধিমতী বালিকা আর একটি প্রশ্ন করিয়া ঐ প্রশ্নের উত্তর দিল-‘কোথায় পড়িবে?’ প্রশ্নটিই তো ভুল। জগতে উঁচু-নীচু বলিয়া তো কিছুই নাই। উঁচু-নীচু জ্ঞান আপেক্ষিক মাত্র। আত্মা সম্বন্ধেও সেইরূপ। আত্মার জন্ম-মৃত্যু সম্বন্ধে প্রশ্ন একেবারে অর্থহীন। কে যায়, কে আসে? তুমি কোথায় নাই? এমন স্বর্গ কোথায় আছে, যেখানে তুমি পূর্ব হইতেই অবস্থিত নও? মানুষের আত্মা সর্বব্যাপী। তুমি কোথায় যাইবে? কোথায় যাইবে না? আত্মা তো সর্বত্র! সুতরাং জ্ঞানী বা সিদ্ধ পুরুষের পক্ষে এই-সব শিশুর কল্পনা, এই জন্মমৃত্যুরূপ বালসুলভ ভ্রম, এই স্বর্গ নরক—সবই একেবারে অন্তর্হিত হইয়া যায় ; যাহারা প্রায়সিদ্ধ, তাঁহাদের পক্ষে উহা ব্রহ্মলোক পর্যন্ত নানাবিধ দৃশ্য দেখাইয়া অন্তর্হিত হয়; অজ্ঞানীর পক্ষে উহা থাকিয়া যায়।