কর্ম করিয়াছিলেন তাহারা সমবেত ফল বেগে আসিয়া তাঁহাকে পুনর্বার এই পৃথিবীতে টানিয়া আনে। এইরূপে যাহরা ভূত প্রেত হয়, তাহারা সেই অবস্থায় কোনরূপ নূতন কর্ম না করিয়াই কেবল অতীত কর্মের ফলভোগ করে, তাহার পর পশুজন্ম গ্রহন করিয়া সেখানেও কোন নতুন কর্ম করে না, তাহার পর তাহারা আবার মানুষ হয়।
মনে কর -কোন ব্যক্তি সারা জীবন অনেক মন্দ কাজ করিল,কিন্তু একটি খুব ভাল কাজও করিল, তাহা হইলে সেই সৎকর্মের ফল তৎক্ষণাৎ প্রকাশ পাইবে, আর ঐ কার্যের ফল শেষ হইবামাত্র অসৎ কর্মগুলিও তাহাদের ফল প্রদান করিবে। যাহারা কতকগুলি ভাল ও মহৎ কাজ করিয়াছে, কিন্তু যাহাদের জীবনের অভ্যাস বা আচরণ ঠিক নহে, তাহারা দেবতা হইবে। দেবদেহসম্পন্ন হইয়া দেবতাদের শক্তি কিছুকাল সম্ভোগ করিয়া আবার তাহাদিগকে মানুষ হইতে হইবে। যখন সৎকর্মের শক্তি ক্ষয় হইয়া যাইবে, তখন আবার সেই পুরাতন অসৎকার্যগুলির ফল ফলিতে থাকিবে। যাহারা অতিশয় অসৎকর্ম করে, তাহাদিগকে ভূতশরীর দানবশরীর গ্রহন করিতে হইবে ; আর যখন ঐ অসৎকার্যগুলির ফল শেষ হইয়া যায়, তখন যে সৎকর্মটুকু অবশিষ্ট থাকে—তাহা দ্বারা তাহারা আবার মানুষ হইবে। যে পথে ব্রহ্মলোকে যাওয়া যায়, যেখান হইতে পতন বা প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নাই, তাহাকে ‘দেবযান’ বলে আর চন্দ্রলোকের পথকে ‘পিতৃযান’ বলে।
অতএব বেদান্তদর্শনের মতে মানুষই জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী আর এই পৃথিবীই সর্বশ্রেষ্ঠ স্হান, কারণ এইখানেই মুক্ত হইবার সম্ভাবনা। দেবতা প্রভৃতিকে মুক্ত হইতে হইলে মানব জন্ম গ্রহন করিতে হইবে। এই মানব-জন্মেই মুক্তির সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা।
এখন এই মতের বিরোধী মত আলোচনা করা যাক। বৌদ্ধগন এই আত্মার অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করেন। বৌদ্ধগন বলেন এই শরীর-মনের পশ্চাতে আত্মা বলিয়া একটি পদার্থ আছে, তাহা মানিবার আবশ্যকতা কি? ‘এই শরীর ও মন-রূপ যন্ত্র স্বতঃসিদ্ধ’ বলিলেই কি যথেষ্ট ব্যাখ্যা হইল না? আবার একটি তৃতীয় পদার্থ কল্পনার প্রয়োজন কি? এই যুক্তিগুলি খুব প্রবল। যতদুর পর্যন্ত অনুসন্ধান চলে, ততদূর বোধ হয়, এই শরীর ও মনরূপ যন্ত্র স্বতঃসিদ্ধ, অন্ততঃ আমরা অনেকে এই তত্ত্বটি এই ভাবেই দেখিয়া থাকি। তবে শরীর ও মনের অতিরিক্ত, অথচ শরীর-মনের আশ্রয়স্বরূপ আত্মা-নামক একটি পদার্থের অস্তিত্ব কল্পনায় আবশ্যকতা কি? শুধু শরীর-মন বলিলেই তো যথেষ্ট হয় ; নিয়ত পরিণামশীল জড়স্রোতের নাম ‘শরীর’, আর নিয়ত-পরিণামশীল চিন্তাস্রোতের নাম মন। এই দুয়ের একত্ব-প্রতীতি হইতেছে কিসের দ্বারা? বৌদ্ধ বলেন : এই একত্ব বাস্তবিক নাই। একটি জ্বলন্ত মশাল লইয়া ঘুরাইতে থাকো, একটি অগ্নির বৃত্তস্বরূপ হইবে। বাস্তবিক কোন বৃ্ত্ত নাই, কিন্তু মশালের নিয়ত ঘূর্ণনে উহা ঐ বৃত্তের আকার ধারণ করিয়াছে। এইরূপ আমাদের জীবনেও একত্ব নাই ; জড়ের রাশি ক্রমাগত বহিয়া চলিয়াছে। সমুদয় জড়রাশিকে ‘এক’ বলিতে ইচ্ছা হয় বলো, কিন্তু তদতিরিক্ত বাস্তবিক কোন একত্ব নাই। মনের সম্বন্ধেও তাই ; প্রত্যেক চিন্তা অপর চিন্তা হইতে পৃথক্। এই প্রবল চিন্তাস্রোতই এই একত্বের ভ্রম রাখিয়া যাইতেছে। সুতরাং তৃতীয় পদার্থের আর আবশ্যকতা নাই। দেহ-মনের বিশ্বপ্রপঞ্চ এই জড়স্রোত ও এই চিন্তাস্রোত—কেবল ইহাদেরই অস্তিত্ব আছে ; ইহাদের পশ্চাতে আর কিছু অনুমান করিও না। আধুনিক অনেক সম্প্রদায় বৌদ্ধদের এই মত গ্রহন করিয়াছেন, কিন্তু তাঁহারা সকলেই এই মতকে তাঁহাদের নিজেদের আবিষ্কার বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে ইচ্ছা করেন। অধিকাংশ বৌদ্ধ-দর্শনেরই মোট কথাটা এই যে এই পরিদৃশ্যমান জগৎ পর্যাপ্ত ; ইহার পশ্চাতে আর কিছু আছে কি না, তাহা অনুসন্ধান করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎই সব—কোন বস্তুকে এই জগতের আশ্রয়রূপে কল্পনা করিবার প্রয়োজন কি? সবই গুণসমষ্টি। এমন আনুমানিক পদার্থ কল্পনা করিবার কি আবশ্যকতা আছে,যাহাতে সেগুলি লাগিয়া থাকিবে? গুণরাশির দ্রুত আদানপ্রদানবশতই পদার্থের জ্ঞান হয়, কোন অপরিণামী পদার্থ বাস্তবিক উহাদের পশ্চাতে আছে বলিয়া নয়। আমরা দেখিলাম এই যুক্তিগুলি কি চমৎকার! আর এগুলি মানবের অভিজ্ঞতাকে সহজেই নাড়া দেয়। বাস্তবিক লক্ষে একজনও এই দৃশ্যজগতের অতীত কিছুর ধারণা করিতে পারে কি না সন্দেহ। অধিকাংশ লোকের পক্ষে প্রকৃতি নিত্যপরিণামশীল। আমাদের মধ্যে খুব অল্প লোকই পটভূমিস্থ সেই স্থির সমুদ্রের সামান্য
আভাস পাইয়াছেন। আমাদের পক্ষে এই জগৎ কেবল তরঙ্গ মাত্র। তাহা হইলে আমরা দুইটি মত পাইলাম। একটি –এই শরীর-মনের পশ্চাতে এক অপরিণামী সত্তা রহিয়াছে ; আর একটি মত—এই জগতে অচল অপরিণামী বলিয়া কিছুই নাই, সবই চঞ্চল পরিবর্তনশীল—পরিণামী ; পরিণাম ছাড়া কিছু নয়! যাহা হউক অদ্বৈতবাদেই এই দুই মতের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়।
অদ্বৈতবাদী বলেনঃ ‘জগতের একটি অপরিণামী আশ্রয় আছে’—দ্বৈতবাদীর এই বাক্য সত্য; অপরিণামী কোন পদার্থ কল্পনা না করিলে আমরা পরিণাম কল্পনা করিতে পারি না। কোন অপেক্ষাকৃত অল্পপরিণামী পদার্থের তুলনায় কোন পদার্থকে পরিণামিরূপে চিন্তা করা যাইতে পারে,আবার তাহা অপেক্ষাও অল্পপরিণামী পদার্থের সহিত তুলনায় উহাকে আবার পরিণামিরূপে নির্দেশ করা যাইতে পারে, যতক্ষন না একটি পূর্ণ অপরিণামী পদার্থ বাধ্য হইয়া স্বীকার করিতে হয়। এই জগৎপ্রপঞ্চ অবশ্য এমন এক অবস্থায় ছিল, যখন উহা শান্ত ও নিঃশব্দ ছিল, যখন উহা বিপরীত শক্তির সাম্যাবস্থায় ছিল, অর্থাৎ যখন প্রকৃত পক্ষে কোন শক্তি ক্রিয়াশীল ছিল না; কারণ বৈষম্য না হইলে শক্তির বিকাশ হয় না। এই ব্রহ্মাণ্ড আবার সেই সাম্যাবস্থা-প্রাপ্তির জন্য দ্রুতবেগে চলিয়াছে যদি আমাদের কোন বিষয় সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান থাকে তবে এই বিষয়েই আছে। দ্বৈতবাদীরা যখন বলেন কোন অপরিণামী পদার্থ আছে, তখন তাঁহারা ঠিকই বলেন, কিন্তু উহা যে শরীর-মনের সম্পূর্ণ অতীত, শরীর-মন হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্, এ কথা বলা ভুল। বৌদ্ধেরা যে বলেন, সমুদয় জগৎ পরিনামপ্রবাহ মাত্র—এ কথাও সত্য; কারণ যতদিন আমি জগৎ হইতে পৃথক্,যতদিন আমি আমার অতিরিক্ত আর কিছুকে দেখি, মোট কথা যতদিন দ্বৈতভাব থাকে, ততদিন এই জগৎ পরিমাণশীল বলিয়াই প্রতীত হইবে। কিন্তু প্রকৃত কথা—এই জগৎ পরিণামীও বটে,আবার অপরিনামীও বটে। আত্মা, মন ও শরীর—তিনটি পৃথক্ বস্তু নহে উহারা একই। একই বস্তু কখন দেহ, কখন মন, কখন বা দেহ-মনের অতীত আত্মা বলিয়া প্রতীত হয়। যিনি শরীরের দিকে দেখেন, তিনি আত্মা দেখিতে পান না; আর যিনি আত্মা দেখেন, তাঁহার পক্ষে শরীর ও মন উভয়ই কোথায় চলিয়া যায়! যিনি কেবল গতি দেখেন, তিনি পরম শান্ত স্থিরভাব দেখিতে পান না; আর যিনি সেই পরম শান্তভাব