ন্যায়দর্শনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গৌতম-প্রণীত ‘ন্যায়সূত্র’ এবং বৈশেষিক দর্শনের—কণাদের বৈশেষিক-সূত্র। বাৎস্যায়ন ন্যায়সূত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছেন (চতুর্থ শতক)। বৈশেষিক সূত্রের ব্যাখ্যা না করিয়াও প্রশস্তপাদ ভাষ্য রচনা করিয়াছেন (পঞ্চম শতক)। ইহা ব্যাতীত ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের প্রকরণ-গ্রন্থ হিসাবে বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চাননের ‘ভাষা-পরিচ্ছেদ’ পাওয়া যায়। ন্যায়দর্শনকে ভিত্তি করিয়া রচিত উদয়নের ‘কুসুমাঞ্জলি’ অতি প্রাচীন এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
বৈশেষিক-দর্শন ন্যায়দর্শন অপেক্ষা প্রাচীন এবং এই দুইটি পৃথকরূপেই রচিত হইয়াছিল। কিন্তু উভয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এক হওয়ায় পরবর্তী কালে ইহারা একত্র আলোচিত হইয়াছে। এই দুইটি দর্শনই বস্তুতন্ত্রবাদী। আবার এই দুইটি দর্শনেই বহুতত্ত্ববাদ স্বীকৃত। বৈশেষিক দর্শনে সপ্ত পদার্থ এবং পরমাণুবাদের সাহায্যে সমগ্র জগৎসৃষ্টির ব্যাখ্যা করা হইয়াছে এবং ইহা ন্যায়দর্শনেও স্বীকৃত হইয়াছে।
ন্যায়দর্শনের বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রমাণভাগই ইহাতে মুখ্যস্থান লাভ করিয়াছে। ন্যায় ও বৈশেষিক এই উভয় দর্শনেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকৃত ও প্রমাণিত হইয়াছে। ‘ন্যায়’ অর্থে আমরা যুক্তিতর্ক বুঝিয়া থাকি। বিচার-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে বলিয়া এই দর্শনের নাম ‘ন্যায়দর্শন’।
‘বৈশেষিক’ শব্দটি ‘বিশেষ’ হইতে উদ্ভুত। বিশেষ অর্থে নিত্যদ্রব্যসমূহের পরস্পর-ভেদক এক নিত্যপদার্থ বুঝায়। বৈশেষিক দর্শনে আমরা দেখিতে পাই, সমগ্র বিশ্বের মূল তত্ত্ব হিসাবে ঐক্য অপেক্ষা বৈচিত্র্যের উপর গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। ‘বিশেষ’ পদার্থ স্বীকার করা হয় বলিয়া এই দর্শনকে বৈশেষিক দর্শন বলা হয়।
(২) সাংখ্য ও যোগ : সাংখ্য দর্শনের প্রণেতা মহর্ষি কপিল এবং যোগদর্শনের প্রণেতা পতঞ্জলি। সাংখ্যদর্শনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘সাংখ্যকারিকা’ এবং কপিলের ‘সাংখ্যসূত্র’। যোগদর্শনের পতঞ্জলি-কৃত ‘যোগসূত্র’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইহা ব্যাতীত ব্যাস-কৃত ‘যোগ-ভাষ্য’ এবং বিজ্ঞানভিক্ষু-কৃত ‘যোগ-বার্তিক’, বাচস্পতি-কৃত ‘তত্ত্ববৈশারদী’ উল্লেখযোগ্য।
সাংখ্যদর্শনের নামকরণ সম্পর্কে বহুবিধ মত রহিয়াছে। কাহারও মতে ‘সংখ্যা শব্দের অর্থ ‘সম্যগ্ জ্ঞান’ , কাহারও মতে ইহাতে প্রকৃতির চতুর্বিংশতে ‘সংখ্যক তত্ত্ব রহিয়াছে বলিয়া ইহার ঐ নাম।
যোগ-দর্শনে অষ্ট যোগাঙ্গের সাহায্যে মোক্ষ বা সমাধি লাভের পন্থা বর্ণিত হইয়াছে। যোগসাধনার উপর প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে বলিয়া ইহাকে ‘যোগদর্শন’ বলা হইয়া থাকে।
সাংখ্য ও যোগ এই উভয় দর্শনেই দ্বৈতবাদ স্বীকৃত; পুরুষ-সহ পঞ্চ-বিংশতিতত্ত্ব-সাহায্যে জগতের সৃষ্টি ও প্রলয় ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। এই দর্শন দুইটির মধ্যে একমাত্র পার্থক্য—সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হন নাই, কিন্তু যোগদর্শনে জ্ঞানীগুরুরূপে ঈশ্বর স্বীকৃত। অপর বিষয়ে এই দুইটি দর্শন সদৃশ বলিয়া যোগদর্শনকে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ নামেও অভিহিত করা হয়।
(৩) পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা : পূর্বমীমাংসাসূত্রের প্রণেতা জৈমিনি এবং উত্তরমীমাংসা বা বেদান্তসূত্রের প্রণেতা ব্যাসদেব। জৈমিনির মীমাংসা সূত্রের উপর শবরস্বামী ভাষ্য এবং ভাষ্যের উপর কুমারিল বার্তিক ও প্রভাকর বৃহতী টিকা প্রভৃতি রচনা করেন। আচার্য শঙ্কর রামানুজ প্রভৃতি ব্যাসের বেদান্তসূত্রের ভাষ্য রচনা করিয়াছেন।
মীমাংসা’ শব্দের অর্থ হইল সদ্বিচার ও সমস্যার সমাধান। পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা—এই উভয় দর্শনেই জাগতিক দুঃখসমূহের নিরসন করিবার উপায় আলোচিত হইয়াছে। এই উভয় দর্শনেই বেদের স্বতঃপ্রামাণ্য-প্রভাব বিশেষভাবে স্বীকৃত। কিন্তু পূর্বমীমাংসায় বেদের পূর্বভাগ কর্মকাণ্ড অর্থাৎ বেদবিহিত যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের উপর প্রাধান্য আরোপিত হইয়াছে। প্রাচীন মীমাংসকগণ বলেন, বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান দ্বারা স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, এবং পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মত—নিষ্কাম কর্ম ও আত্মজ্ঞান দ্বারা মোক্ষলাভ ঘটে। বেদসমূহের পূর্বভাগ অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের উপর প্রাধান্য আরোপ করার জন্য এই মীমাংসাদর্শনে ‘পূর্বমীমাংসা’বলা হইয়া থাকে। অপর পক্ষে উত্তরমীমাংসাদর্শনে বেদের উত্তরভাগ বা জ্ঞানকাণ্ডকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে। আত্মানুভূতিই এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য। এই দর্শনকে ‘বেদান্তদর্শন’ বলা হইয়াছে, কারণ ইহা বেদের অন্তভাগ বা উপনিষদ। উপনিষদই বেদান্ত। আবার কাহারও মতে বেদের সারতত্ত্ব অর্থাৎ ব্রহ্মের স্বরূপ বেদান্তদর্শনে আলোচিত হইয়াছে বলিয়াই ইহাকে ঐ নামে অভিহিত করা হয়।
মীমাংসা-দর্শনে বেদের প্রামাণ্য পূর্ণরূপে স্বীকৃত হইয়াছে। এই মতে বেদে অপৌরুষেয় ও নিত্য। মীমাংসা-দর্শনে বেদের কর্মকাণ্ডের অর্থবিচার করা হইয়াছে; বেদান্তে বেদের জ্ঞানকাণ্ডের অর্থ আলোচিত হইয়াছে।
বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য বলিয়া স্বীকৃত। জীব, জগৎ ও সৃষ্টিকে ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত বলা হইয়াছে। এই মতে ব্রহ্মজ্ঞানলাভই মোক্ষলাভ।
অবৈদিক নাস্তিক দর্শন : চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধ এই তিনটি দর্শন বেদ অস্বীকার করে, ইহারা বেদ-বিরোধী।
(১) চার্বাকদর্শন : লোকায়ত দর্শন নামেও পরিচিত—জড়বাদী ও দেহাত্মবাদী। কেহ কেহ ‘বৃহস্পতিসূত্র’কে এই দর্শনেরে মূল বলেন; ইহা পাওয়া যায় না, অন্যান্য গ্রন্থে কিছু কিছু উদ্ধৃতিমাত্র পাওয়া যায়। চার্বাক কোন ঋষির নাম কিনা সন্দেহ, ‘চারু বাক্ যস্য’ এই ভাবেই ‘চার্বাক’ শব্দ নিষ্পন্ন। ‘চর্ব্’ ধাতু হইতেও চর্বক বা চার্বাক শব্দ নিষ্পন্ন হয়।