৪৮. আমরা প্রতিক্রিয়া করিলেই দাস হইয়া পড়ি। কোন লোক আমার উপর দোষারোপ করিলে সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধের আকারে আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। লোকটি যে সামান্য একটি আন্দোলন সৃষ্টি করিল, তাহাই আমাকে দাস করিয়া তোলে। সুতরাং আমাদিগকে আমাদের মুক্তস্বভাব প্রকাশ করিতে হইবে। ‘তাঁহারাই জ্ঞানী—যাঁহারা শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, নিম্নতম প্রাণী বা মানবসমাজের অত্যন্ত ঘৃণিত দুষ্টের মধ্যে মানুষ, মুনি বা জন্তু দেখেন না, পরন্তু সকলের মধ্যে এক ভগবান্কেই দেখেন। ইহজীবনেই তাঁহারা স্বর্গ জয় করিয়াছেন এবং এই সাম্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। ভগবান্ শুদ্ধ ও সর্বত্র সমভাবাপন্ন। সুতরাং ঈদৃশ দেহধারী ঈশ্বর।’১ এই লক্ষ্যের দিকেই আমরা চলিয়াছি এবং মানুষের বিভিন্ন উপাসনা-পদ্ধতি ও প্রত্যেকটি কর্ম এই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিবার এক-একটি পথ। যে লোক অর্থ চায়, সেও মুক্তির জন্য চেষ্টা করিতেছে—দারিদ্রের বন্ধন হইতে মুক্তি চাহিতেছে। মানুষের প্রত্যেক কর্মই উপাসনা, কারণ সর্বত্রই মুক্তিলাভের ভাব প্রকটিত; এবং সকল কর্মই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তির অভিমুখী, শুধু যে-সকল কাজ মুক্তিপথের বাধাস্বরূপ, সেগুলি পরিহার করিতে হইবে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সমগ্র বিশ্ব ভগবানের উপাসনাই করিতেছে; কেবল জানে না যে, যখন ভগবানের নিন্দা করিতেছে, তখনও একভাবে তাঁহার পূজাই করিতেছে, কারণ যাহারা ভগবানের নিন্দা করিতেছে, তাহারাও মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করিতেছে। তাহারা কখনও চিন্তা করে না যে, কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হইয়া তাহারা সেই বিষয়েরই দাস হইয়া পড়িতেছে। সামান্য খোঁচার পরিবর্তে জোরে আঘাত করা কঠিন কাজ।
৪৯. যদি আমরা আমাদের সীমাবদ্ধ বিশ্বাস হইতে মুক্ত হইতে পারিতাম, তবে এখনই সব কিছু করিয়া ফেলা আমাদের পক্ষে সম্ভব হইত। ইহা কেবল সময়ের প্রশ্ন। যদি তাই হয়, তবে আরও শক্তি প্রয়োগ কর, এবং এইভাবে সময় সংক্ষিপ্ত কর। সেই অধ্যাপকের কথা স্মরণ কর, যিনি মর্মর প্রস্তরের গঠন রহস্য আয়ত্ত করিয়া বারো বৎসরে মর্মর প্রস্তুত করিয়াছিলেন , আর প্রকৃতির উহা করিতে শত শত বৎসর লাগিয়াছিল।
———-
১ গীতা, ৫/১৮-১৯
০৪. তথ্যপঞ্জী
০১. দর্শন ও দার্শনিক-পরিচিতি
[জ্ঞানযোগে যে-সকল পাশ্চাত্য মনীষীর কথা বারংবার উল্লিখিত হইয়াছে, তাঁহাদের
সংক্ষিপ্ত পরিচয় এইখানে লিপিবদ্ধ হইল—উপাধি-নামের বর্ণানুক্রমে]
কমতে—Auguste Comte (১৭৯৮—১৮৫৭) ফরাসী দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য—Course Of Positive Philosophy(১৮৩০-৪২)।
কমতেকে প্রত্যক্ষবাদ ( Positivism)-এর স্রষ্টা বলা হয়। তিনি ফরাসী সংশয়বাদের (French Scepticism)-এর অন্যতম ধারক। সংশয়-বাদের মধ্যেও যে নির্দিষ্ট (Positive) জ্ঞানের স্থান আছে, ইহাই তাঁহার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। তাঁহার মতে—দর্শনে পরাবিজ্ঞানের (Metaphysics) কোন স্থান নাই। বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলি সম্বন্ধে সমালোচনামূলক ব্যাখ্যাই দার্শনিকের কাজ। চিরাচরিত প্রথায় ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে তিনি তাঁহার দর্শন রচনা করিয়াছেন এবং ইহাকে মানবতাবাদের (Humanism) উপর প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন।
জেমস্—William James (১৮৪২—১৯১০) আমেরিকান দার্শনিক। তাঁহার প্রধান রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—The Principles of Psychology(১৮৯০), The Will to Believe(১৮৯৭), Varieties of Religious Experience(১৯০২), A Pluralistic Universe(১৯০৯), The Meaning of Truth(১৯০৯) ইত্যাদি।
ইংলণ্ডের দার্শনিক হিউমের প্রভাব জেমসের দর্শনে খুবই স্পষ্ট। সত্যের প্রকৃতি এবং পরীক্ষা-বিষয়ে জেমস্ প্রয়োগবাদে (Pragmatism) বিশ্বাস করেন এবং তিনিই এই মতবাদের স্রষ্টা। সত্যের প্রকৃতি ও তাহার জ্ঞান সম্বন্ধে জীবনে উপযোগিতার প্রসঙ্গ জেমসের রচনায় একটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। জৈবিক প্রয়োজন ব্যাতীত কোন কিছুই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। তাঁহার Pragmatism (১৯০৭) নামক গ্রন্থে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতার উল্লেখ করেন।
টিণ্ডাল—John Tyndall (১৮৩০—৯৩) ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী। তাহার প্রণীত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—The Glaciers of the Alps(১৮৬০), Heat as a Mode of Motion(১৮৬৩) ইত্যাদি।
তিনি Royal Institution-এ প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন (১৮৫৩)। তাপসংক্রান্ত বহুবিধ মৌলিক গবেষণা করেন। বায়ুমণ্ডল ও আলোর পরিক্রমা সম্বন্ধে তিনি অনেক গবেষণা করিয়াছেন।
ডয়সন—Paul Deussen(১৮৪৫—১৯১৯) জার্মান দার্শনিক। তাঁহার রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Elements of Metaphysics. বেদান্তশাস্ত্রের উপর তাঁহার দুইখানি রচনা পাওয়া যায়—একখানি ‘বেদান্তদর্শন’ সম্বন্ধে (১৮৮৩), অন্যটি ‘বেদান্তসূত্র’ সম্বন্ধে (১৮৮৭)। হিন্দুদর্শন—বিশেষভাবে বেদান্ত-দর্শনের প্রতি তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁহার পাণ্ডিত্য অসাধারণ।—১০ ম খণ্ডে স্বামীজীর প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
ডারুইন—Charles Robert Darwin (১৮০৯—৮২) ইংরেজ বৈজ্ঞানিক। তাঁহার রচনা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—On the Origin of Species by means of Natural Selection or the Preservation of the Favoured Races in the Struggle for Life (১৮৫৯), The Variation of Animals and Plants under Domestication (১৮৬৮)ইত্যাদি।