৪২. আমরা বলি যে, মুক্তি লাভ করিবার চেষ্টা আমাদের করিতেই হইবে। আর সেই মুক্তিই ঈশ্বর বা ভগবান্। সেই এক আনন্দই মানুষ সর্বত্র উপভোগ করে, কিন্তু যখন কেহ সসীম কিছুতে আনন্দ পাইতে চায়, তখন সে তাহার কণিকা মাত্রই পায়। ঈশ্বরের মধ্যে সাধক যে আনন্দ লাভ করে, চুরি করিয়া চোর সেই এক আনন্দই পায়; কিন্তু চোর সেই আনন্দের কণামাত্রই পায়, তাহাও দুঃখরাশির সহিত মিশ্রিত। প্রকৃত আনন্দই ভগবান্। প্রেমই ভগবান্—মুক্তিই ভগবান্। আর যাহা কিছু মানুষকে বদ্ধ করে,তাহা ভগবান্ নয়।
৪৩. প্রকৃত সত্তা অব্যক্ত, প্রকাশশূন্য। আমরা তাহা ধারণা করিতে পারি না, কারণ ধারণা করিতে গেলে মন দিয়াই করিতে হইবে, আর মন তো নিজেই ব্যক্ত পদার্থ। প্রকৃত সত্তার মহিমাই এই যে, তিনি ধারণাতীত, মনেরও অগোচর। আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, জীবনে তীব্রতম ও ক্ষীণতম আলোক-স্পন্দন আমরা দেখিতে পাই না, কিন্তু তাহারা একই সত্তার বিরোধী দুইটি প্রান্ত। এমন কতকগুলি জিনিস আছে, যেগুলি এখন আমরা জানি না, কিন্তু সেগুলি আমরা জানিতে পারি; অজ্ঞানবশতই সেগুলি জানিতে পারি না। আবার এমন অনেক জিনিস আছে, যেগুলি আমার কখনও জানিতে পারি না, কারণ সেগুলি আমাদের জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্পন্দন অপেক্ষা অনেক বেশী উচ্চগ্রামের। কিন্তু যদিও বুঝিতে পারি না, তথাপি আমরা সর্বদাই সেই শাশ্বত সনাতন সত্তা। জ্ঞান সেখানে অসম্ভব। ধারণা বা চিন্তার সসীমত্বই তাহার অস্তিত্বের ভিত্তি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমার মধ্যে আমিত্বের চেয়ে নিশ্চিত আর কিছুই নাই, তথাপি শরীর ও মন, সুখী বা দু্ঃখী, পুরুষ বা স্ত্রীরূপেই কেবল আমিত্বের কথা ভাবিতে পারি, এবং যখনই আমি নিজ যথার্থ স্বরূপকে ধারণা করিতে চেষ্টা করি, তখনই স্বরূপকে শরীর বা মনের নিম্ন স্তরে না নামাইযা কোন উপায়ই দেখিতে পাই না; তথাপি আমি আমার স্বরূপ সম্বন্ধে স্থির নিশ্চিত। ‘প্রিয়ে, পতির জন্যই কেহ পতিকে ভালবাসে না, ভালবাসে কারণ তাহার মধ্যে আত্মা রহিয়াছেন। পতির আত্মায় এবং আত্মার মাধ্যমেই পত্নী পতিকে ভালবাসে। প্রিয়ে, পত্নির জন্যই কেহ পত্নীকে ভালবাসে না, পরন্তু আত্মায় ও আত্মার মাধ্যমেই ভালবাসে।’১ এই আত্মসত্তাই যে একমাত্র বস্তু—তাহা আমারা জানি, কারণ আত্মায় ও আত্মায মধ্য দিয়াই আমরা সব বস্তু উপলব্ধি করিয়া থাকি, তথাপি আমরা ইহার সম্বন্ধে ধরণা করিতে পারি না। জ্ঞাতাকে আমরা কেমন করিয়া জানিব? যদি আমরা জ্ঞাতাকে জানিতেই পারিতাম, তবে তো সে আর জ্ঞাতা থাকিবে না, জ্ঞেয় হইয়া যাইবে—জ্ঞানের বিষয় হইয়া যাইবে।
———-
১ বৃহদারণ্যক উপ.,২/৪/৫
৪৪. পুরানো সংস্কারগুলি দূর করিবার জন্য আমাদের যুক্তি-বিচারের প্রয়োজন আর সংস্কারগুলি বিদূরিত হইলে যাহা থাকে, তাহাই বেদান্ত। একটি সুন্দর কবিতায় ঋষি নিজেকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, ‘বন্ধু, তুমি কেন কাঁদছ? তোমার কোন ভয় নেই, মরণ নেই, কেন তুমি কাঁদছ? তোমার কোন দুঃখ নেই, কারণ সুনীল অনন্ত আকাশের মতো তুমি স্বরূপতঃ অপরিণামী। নানা বর্ণের মেঘগুলি আকাশের কোলে এসে কয়েক মুহূর্ত বর্ণচ্ছটা বিকিরণ ক’রে মিলিয়ে যায়—কিন্তু আকাশ যা ছিল, তাই থাকে। তোমাকে কেবল এই অজ্ঞানের মেঘ অপসারণ করতে হবে।’১ আমাদের শুধু জলাবরোধক কপাটগুলি খুলিয়া দিতে হইবে, এবং পথ পরিষ্কার করিতে হইবে। জলরাশি স্বভাবতই সবেগে প্রবেশ করিবে এবং খাতগুলি পূর্ণ করিয়া দিবে, কারণ জলরাশি তো সেখানে পূর্ব হইতেই রহিয়াছে।
৪৫. মানুষ অনেকটা সচেতন প্রাণী, কতকটা অচেতন, আবার চেতনার অতীতে যাইবার সম্ভাবনাও তাহার আছে। কেবল যখন আমরা ঠিক ঠিক মনুষ্যপদবাচ্য হই, তখন আমরা যুক্তি-বিচারের বাহিরে যাইতে পারি। ‘উচ্চতর’ বা ‘নিম্নতর’ ইত্যাদি শব্দগুলি কেবল ব্যাবহারিক জগতেই প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু পারমার্থিক জগতে এইগুলি বিরোধী, কারণ সেখানে কোন পৃথক্-ভাব নাই। ব্যাবহারিক জগতে মনুষ্যত্বরূপ বিকাশই চরম অভিব্যক্তি। বেদান্তবাদী বলেন, মানুষ দেবতা অপেক্ষাও উচ্চে। দেবতাদেরও একদিন মরিতে হইবে এবং মানুষ হইয়া জন্মাইতে হইবে। দেবতারাও মানব-শরীরেই সিদ্ধ বা পূর্ণ হইতে পারেন।
৪৬. মুক্তি তো মানুষের করতলগত, তবে তাহাকে এ-তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে হইবে। সে মুক্তই, কেবল প্রতি মূহূর্তে সে তাহা ভুলিয়া যায়। এই সত্যকে আবিষ্কার করাই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রত্যেক মানুষের সমগ্র জীবন-প্রচেষ্টা। জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য এই যে, জ্ঞানী জ্ঞাতসারে ইহা করেন, আর অজ্ঞানী করে অজ্ঞাতসারে। প্রত্যেকেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে—পরমাণু হইতে নক্ষত্ররাশি পর্যন্ত। অজ্ঞানী একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মুক্তি পাইলেই সন্তুষ্ট হয়—ক্ষুধা ও তৃষ্ণা বন্ধন হইতে মুক্ত হইলেই সে খুশী; কিন্তু জ্ঞানী বোধ করেন, তাঁহাকে প্রবলতর বন্ধন ছিন্ন করিতে হইবে। তিনি রেড ইণ্ডিয়ানদের স্বাধীনতার ভাবকে মুক্তি বলিয়া মনে করেন না।
———-
১ তুলনীয়—অবধূতগীতা, ৩/৩৪
৪৭. আমাদের দার্শনিকদের মতে মুক্তিই লক্ষ্য। জ্ঞান লক্ষ্য হইতে পারে না, কারণ জ্ঞান যৌগিক পদার্থ। জ্ঞান শক্তি ও মুক্তির মিশ্রণ। একমাত্র মুক্তিই আমাদের কাম্য। ইহারই জন্য মানুষ চেষ্টা করিতেছে। কেবল শক্তি লাভ করিলেই জ্ঞান হইবে না। উদাহরণস্বরূপ, একজন বিজ্ঞানী একটি বৈদ্যুতিক তরঙ্গকে এক মাইল দূরে প্রেরণ করিতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতি উহাকে অসীম দূরত্বে পাঠাইতে পারে। তাহা হইলে কেন আমরা প্রকৃতির পূজা করিব না? নিয়ম আমরা চাইনা ;নিয়ম ভাঙিবার শক্তি চাই। আমরা নিয়মাতীত হইতে চাই। যদি তুমি নিয়মবদ্ধ হও তো এক তাল কাদার সমান হইবে। এই মুহূর্তেই তুমি নিয়মাতীত কি-না—এটি প্রশ্ন নয়, কিন্তু আমরা যে নিয়মাতীত, এই ভাবের উপরেই সকল মানব-প্রগতির ইতিহাস রচিত। উদাহরণস্বরূপ মনে করঃ একটি লোক অরণ্যে বাস করে; সে কোন বিদ্যাশিক্ষা করে নাই, তাহার কোন জ্ঞানও নাই। সে দেখিতেছে যে, একটি পাথর নীচে পড়িতেছে—একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটিতেছে, আর সে ভাবিতেছে ইহাই মুক্তি। সে ভাবে—পাথরটার আত্মা আছে, তাহার কেন্দ্রীয় ভাবটি হইতেছে মুক্তি। কিন্তু যেই মাত্র সে জানিবে যে, পাথরটা নীচে পড়িতে বাধ্য, সে বলিবে, ইহা প্রকৃতি—ইহা জড় যান্ত্রিক কর্ম। আমি পথে বাহির হইতে পারি, নাও পারি। মানুষ হিসাবে এই স্বাতন্ত্র্যই আমার মহিমা। কিন্তু যখনই আমি নিশ্চয় জানি যে, আমি সেখানে যাইবই, তখনই আমি নিজ স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করিয়া যন্ত্রে পরিণত হই। অনন্ত শক্তি সত্ত্বেও প্রকৃতি একটি যন্ত্রমাত্র; মুক্তিই চেতন জীবের মূল উপাদান। বেদান্তমতে অরণ্যচারী মানুষের ভাবটি ঠিক—তাহার দৃষ্টি ঠিক, কিন্তু ব্যাখ্যা ভুল। সে এই প্রকৃতিকে স্বাধীন মনে করে, নিয়মদ্বারা পরিচালিত ভাবে না।যাবতীয় মানবিক অভিজ্ঞতার পরই আমরা আবার ঠিক এইকথাই চিন্তা করিব, কিন্তু অধিকতর দার্শনিক অর্থে। উদাহরণস্বরূপ : আমি পথে বাহির হইতে চাই; ইচ্ছা-শক্তির অনুপ্রেরণা লাভ করিলাম এবং তারপর থামিলাম; আমার যাইবার ইচ্ছা ও পথে যাওয়া এই দুইটির অন্তর্বর্তী কালে আমি একইভাবে কাজ করিয়াছি। কর্মের এই একতানতাকেই আমরা নিয়ম বলিয়া থাকি। আমি দেখিতেছি, আমার কর্মের এই একতানতা মাঝে মাঝে ব্যাহত হয়; সুতরাং আমি আমার কর্মকে নিয়মবদ্ধ বলি না। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করি। আমি পাঁচ মিনিট হাঁটিয়াছি। কিন্তু ঐ একটানা পাঁচমিনিট হাঁটার পূর্বক্ষণে ইচ্ছা-শক্তি ক্রিয়াশীল ছিল—যা আমাকে হাঁটার প্রবৃত্তি দিয়াছিল। তাই মানুষ মনে করে সে স্বাধীন, কারণ তাহার সমুদয় কাজকর্মকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালে ভাগ করা যায় ঐ ক্ষণগুলির মধ্যে একটা একতানতার রেশ থাকিলেও কালের বাহিরে ঐ ধরনের ঐক্য ছিল না। এই অনৈক্যবোধেই মানবের মুক্তভাব নিহিত। প্রকৃতিতে আমরা দীর্ঘকালস্থায়ী ঐক্য দেখিতে পাই, কিন্তু প্রারম্ভে ও শেষে অবশ্য মুক্তির প্রেরণা থাকিবে। আদিতেই মুক্ত হইবার এই প্রেরণা দেওয়া হইয়াছিল, তাহাই আবর্তিত হইতেছে। কিন্তু এই প্রেরণা আমাদের কালের তুলনায় খুবই দীর্ঘ। দার্শনিক রীতি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করিতে গেলে আমরা দেখি যে, আমরা মুক্ত নই। কিন্তু এই চেতনা সব সময়েই থাকিয়া যায় যে, আমি মুক্ত। ঐ ভাব কেমন করিয়া আসে এটুকুই আমাদের ব্যাখ্যা করিতে হইবে। আমরা দেখিতে পাই যে, আমাদের দুইটি বৃত্তি আছে। আমাদের বিচারবুদ্ধি বলে, আমাদের সকল কাজেরই কারণ আছে, আবার প্রত্যেকটি প্রেরণার সঙ্গে আমরা আমাদের ভিতরে মু্ক্তভাব ঘোষণা করিতেছি। বেদান্তের মীমাংসা এই যে, আমাদের ভিতরে মুক্তভাব আছে—কারণ আত্মা প্রকৃতপক্ষে মুক্ত, কিন্তু আত্মার ক্রিয়া যে শরীর ও মনকে আশ্রয় করিয়া পাইতেছে, সেই শরীর ও মন মুক্ত নয়।