———-
১ গীতা, ৫/১৮-১৯
৩৭. ব্যক্তিত্ব : আমরা যদি ঈশ্বরের সহিত অভিন্ন হই, তবে কি আমাদের ব্যক্তিত্ব নাই? হাঁ আছে। সেই তো ঈশ্বর। আমাদের ব্যক্তিত্বই ঈশ্বর। বর্তমানে তোমার যাহা আছে, তাহা ব্যক্তিত্ব নয়, তবে তুমি ব্যক্তিত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছে। ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দের অর্থ—যাহা আর বিভক্ত করা যায় না। ইহাকে তুমি কেমন করিয়া ব্যক্তিত্ব বলিতে পারো? এই মুহূর্তে তুমি একভাবে চিন্তা করিতেছ, পরমূহূর্তে অন্যভাবে, আবার দু-ঘণ্টা পরে আর একভাবে চিন্তা করিতেছ। যাহা পরিবর্তনীয় নয়, তাহাই ব্যক্তিত্ব—সর্ব বস্তুর পারে অপরিবর্তনীয়। চিরকাল একই অবস্থায় আবদ্ধ থাকা তো অতি ভয়াবহ ব্যাপার, কারণ তাহা হইলে যে চোর সে চিরকাল চোরই থাকিয়া যাইবে, আর যে অভদ্র সে অভদ্রই থাকিযা যাইবে। একটি শিশু মারা গেলে তাহাকে চিরকাল শিশুরূপেই থাকিতে হইবে। যাহার কখনও পরিবর্তন হয় না এবং হইবে না, তাহাই প্রকৃত ব্যক্তিত্ব—আর তাহাই আমাদের অন্তর্যামী ভগবান্।
৩৮. ঈশ্বর যুক্তি-বিচার করেন না। কোন বিষয় জানা থাকিলে তুমি তর্ক করিবে কেন? কতকগুলি তথ্য পাইবার জন্য আমাদের কীটের মতো মন্থর গতিতে অগ্রসর হইতে হইবে, আবার খানিক বাদেই হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া সব কিছু তালগোল পাকাইয়া যাইবে—এ দুর্বলতার চিহ্ন। আত্মা প্রতিফলিত হন মনে ও প্রত্যেক বস্তুতে। আত্মার জ্যোতিই মনকে চেতনাশীল করে। সব কিছুই চৈতন্যের প্রকাশ; মনগুলি তাঁহার দর্পণ মাত্র। যাহাকে তোমরা প্রেম,ভয়,ঘৃণা,পুণ্য ও পাপ বল,সবই আত্মার প্রতিফলক মাত্র। যখন প্রতিফলক নিকৃষ্ট হয়, তখন প্রতিফলনও মন্দ হইবে।
৩৯. এক সময়ে আমরা নিম্নতর জীব ছিলাম। আমরা মনে করি, তাহারা আমাদের অপেক্ষা ভিন্ন প্রকৃতির। আমি পাশ্চাত্য দেশের লোকেদের বলিতে শুনিয়াছি, এ জগৎ আমার জন্যই সৃষ্ট।’ যদি বাঘগুলি বই লিখিতে পারিত, তাহারা লিখিত : মানুষ তাহাদেরই জন্য সৃষ্ট, এবং মানুষ অত্যন্ত পাপী জীব, কারণ তাহারা বাঘকে সহজে ‘মানুষ’ ধরিতে দেয় না। যে-কীট আজ তোমার পায়ের তলা দিয়া চলিয়াছে, সেও ভাবী ঈশ্বর।
৪০. প্রকৃতির নিয়ম মানিয়া চলাই মুক্তি—এই মত আমি মানি না। ইঁহার যে কি অর্থ, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। মানব-প্রগতির ইতিহাস আলোচনা করিলে দেখা যায়, প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে আচরন করিয়াই মানুষ প্রগতিশীল হইয়াছে।
এ-কথা বলা যাইতে পারে যে, উচ্চতর নিয়মদ্বারাই নিম্নতর নিয়ম জয় করা হইয়াছে। কিন্তু তাহাতেও জয়শীল মন মুক্তির চেষ্টাই করিতেছে এবং যেই মাত্র বোঝা গিয়াছে, সংগ্রামও নিয়মের ভিতর দিয়াই চলিয়াছে, তখনই উহাকেও জয় করার চেষ্টা হইয়াছে। সুতরাং প্রতিক্ষেত্রে মুক্তিই ছিল উদ্দেশ্য। গাছ কখনও নিয়ম লঙ্ঘন করে না। গরুকে কখনও চুরি করিতে দেখি নাই, শুক্তি-ঝিনুক কখনও মিথ্যা বলে না—তথাপি তাহারা মানুষের চেয়ে উচ্চতর নয়। এই জীবনই মুক্তির এক প্রচণ্ড ঘোষণা এবং এই নিয়মানুবর্তিতা বেশী দূরে লইয়া গেলে আমাদের জড়ে পরিণত করিবে—কি সমাজে, কিরাজনীতিতে, কি ধর্মজীবনে। খুব বেশী নিয়ম মৃত্যুরই নিশ্চিত চিহ্ন। যেখানেই সমাজে নিয়মের আধিক্য দেখা দেয়, সেখানে নিশ্চয় বুঝিতে হইবে যে, ঐ সমাজ শীঘ্রই মরিবে। যদি তোমরা হিন্দুভারতের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর, তবে দেখিবে হিন্দুর মতো অন্য কোন জাতির জীবনে এত বেশী নিয়ম প্রচলিত নাই, এবং ফল-স্বরূপ জাতি-হিসাবে হিন্দুর মৃত্যু ঘটিয়াছে। কিন্তু হিন্দুদের একটি বিশেষ ভাব ছিল এই যে, তাহারা কখনও ধর্ম-বিষয়ে কোন মতবাদ বা গোঁড়ামি সৃষ্টি করে নাই, ফলে (তাহাদের) ধর্মের সর্বাধিক পরিপুষ্টি সাধিত হইয়াছে। চিরন্তন নিয়ম কখনও মুক্তি হইতে পারে না, কারণ চিরন্তনকে নিয়মের মধ্যে ফেলার অর্থই হইতেছে তাহাকে সীমাবদ্ধ করা।
৪১. ভগবানের দৃষ্টিতে কোন উদ্দেশ্য নাই, কারণ তাঁহার যদি কোন উদ্দেশ্য থাকিত, তবে তিনি বৃক্ষটি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কিছু হইতেন না। কেন তাঁহার উদ্দেশ্য থাকিবে? যদি তাঁহার উদ্দেশ্য থাকিত, তবে তো তিনি সেই উদ্দেশ্য দ্বারাই বদ্ধ হইয়া পড়িতেন। মনে কর, একজন গালিচা-প্রস্তুতকারী একটি গালিচা বুনিতেছে, বাহিরের কোন মহত্তর ভাবকে রূপ দিতেছে। এখন কোথায় সেই ভাব, যাহার সঙ্গে ভগবান্ নিজেকে খাপ খাওয়াইবেন? বড় বড় সম্রাট্গনও যেমন মাঝে মাঝে পুতুলখেলা করেন, তেমনি ঈশ্বরও এই প্রকৃতির সঙ্গে খেলা করিতেছেন। আমরা বলি, ‘ইহাই নিয়ম।’ আমরা ইহাকে নিয়ম বলি, কারণ ইহার খুব সামান্য অংশই—যাহা সুশৃঙ্খলভাবে চলিতেছে—আমরা বুঝিতে পারি। নিয়ম সম্পর্কে আমাদের সকল ধারণাই এই ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিয়ম অনন্ত—অর্থাৎ অনন্তকাল ধরিয়াই প্রস্তর পড়িতে থাকিবে, ইহা একেবারেই বাজে কথা। যদি সব যুক্তি অভিজ্ঞতার উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে পঞ্চাশ লক্ষ বৎসর পূর্বে পাথর পড়িয়াছিল কি-না, দেখিবার জন্য কে উপস্থিত ছিল? সুতরাং নিয়ম মানুষের স্বভাবগত বস্তু নয়। মানুষ সম্বন্ধে ইহাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত যে, আমরা যেখান হইতে আরম্ভ করি, সেখানেই শেষ করি। কার্যতঃ আমরা ধীরে ধীরে নিয়মের বাহিরে যাই এবং অবশেষে একটা সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা লইয়া একেবারে নিয়মাতীত হই। ঈশ্বর ও মুক্ত অবস্থা হইতেই আমাদের আরম্ভ, আবার ঈশ্বর ও মুক্ত অবস্থাতেই আমাদের পরিসমাপ্তি। নিয়মগুলি যাত্রার মধ্যপথে অবস্থিত এবং এই-সকল নিয়মের মধ্য দিয়াই আমাদের যাইতে হইবে। আমাদের বেদান্তে সর্বদাই মুক্তির উপর জোর দেওয়া হইয়াছে। নিয়মের ভাবটি বেদান্তবাদীকে ভীত করে, আর ঐ চিরন্তন নিয়ম তাহার কাছে অতি ভয়াবহ ব্যাপার, কারণ তাহা হইলে মুক্তির আর কোন উপায়ই থাকে না। যদি এমন কোন চিরন্তন নিয়ম তাহাকে সর্বদাই বাঁধিয়া রাখে, তবে মানুষ ও একখণ্ড তৃণের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আমরা নিয়মের সেই বস্তু-নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্বাস করি না।